ভারত আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী রাষ্ট্র। কিন্তু এই প্রতিবেশীর মুখোশের আড়ালে সীমান্তে লাগাতার হত্যাকাণ্ডের এক গভীর ক্ষত বারবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। প্রতিনিয়তই ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) হাতে প্রাণ হারাচ্ছে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ। এই ঘটনাগুলো শুধু ভুক্তভোগীদের ব্যক্তিজীবনেই নয়, দুই দেশের সম্পর্কের ওপরও এক কালো ছায়া ফেলছে। বিভিন্ন সময় দুই দেশের উচ্চপর্যায় থেকে সীমান্ত হত্যা বন্ধে নানা প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলেও, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তার কার্যকর প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি না। একের পর এক হত্যাকাণ্ড ঘটেই চলছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম দিকে প্রতিবাদ জানালেও এখন ন্যূনতম প্রতিবাদও জানাচ্ছে না!
ফলে, সীমান্তের মানুষ ভয়াবহ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন। তাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, এমনকি চাষাবাদও ব্যাহত হচ্ছে। এই বুঝি বিএসএফের হাতে মারধর বা আটকের শিকার হতে হয়Ñসেই ভয় তাদের তাড়া করে ফেরে। এমনকি এই হত্যাকাণ্ডগুলো শুধু সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকছে না; আমাদের সীমান্তরক্ষীরাও কখনো কখনো এর শিকার হচ্ছেন। ঘটছে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশি নারী ধর্ষণের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাও!
২০২৪-এর ৭ সেপ্টেম্বর ভারতের রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়াকে (পিটিআই) দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এ-সংক্রান্ত এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘সীমান্তে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা বা পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে সেটির সমাধানের জন্য আইনগত পথপদ্ধতি রয়েছে। কাউকে হত্যা করা কখনো কোনো সমাধান নয়। সীমান্তে হত্যার যে ব্যাপারটি নিয়ে বেশ কয়েক বছর ধরে আলোচনা চলছে... এসব হত্যাকাণ্ড কিন্তু একতরফা। যারা সীমান্ত অতিক্রম করে, তারা নিতান্তই সাধারণ লোকজন। আপনাদের রাষ্ট্র দখল করার কোনো ইচ্ছা, পরিকল্পনা বা ক্ষমতা তাদের নেই। তাই তাদের হত্যা করা আসলে একপ্রকার নিষ্ঠুরতা এবং এই নিষ্ঠুরতা বন্ধ হওয়া প্রয়োজন।’
তার এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে জনমনে আশার সঞ্চার হয়েছিল যে, সীমান্ত হত্যা বন্ধে কার্যকর পদক্ষেপ নেবে অন্তর্বর্তী সরকার। এরপর গত ফেব্রুয়ারি-২০২৫-এ ঢাকা-নয়াদিল্লি সীমান্ত সম্মেলনে বিএসএফ এবং বিজিবি ‘জিরো কিলিং’ মানদণ্ডে পৌঁছানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। দুঃখজনক হলেও সত্য, ভারত নানাভাবে প্রতিশ্রুতি দিলেও এখন পর্যন্ত সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন ‘অধিকার’-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফের গুলিতে কমপক্ষে ৫৮৮ বাংলাদেশি নিহত হয়েছে এবং আহত হয়েছে ৭৭১ জন। এরপর হিসাবের বাইরেও কিছু হত্যাকাণ্ড আছে, যা গণমাধ্যমে আসেনি, ফলে চোখের আড়ালেই রয়ে গেছে।
চলতি বছরের এপ্রিল, মে, জুন ও জুলাই মাসের কয়েকটি সাম্প্রতিক ঘটনা এই উদ্বেগকে আরো বাড়িয়ে তুলেছে। চলতি বছরের ২৫ এপ্রিল রাস্তা ধরে হেঁটে যাওয়া ২৮ বছর বয়সি আসাদুল ইসলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া গ্রামে বিএসএফের গুলির আঘাতে প্রাণ হারান। ঢাকা ট্রিবিউনের সংবাদের বরাতে জানা যায়, অবৈধ প্রবেশের অভিযোগে তাকে লক্ষ্য করে তিন রাউন্ড রাবার বুলেট চালানো হয়েছিল। প্রশ্ন হলো, আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী, অবৈধ প্রবেশকারীকেও কি প্রাণঘাতী গুলির বদলে আটক করে আইনের আওতায় আনা যায় না? ভারতীয় বাহিনী অতীতে ‘জিরো কিলিং’ এবং গুলির বদলে ‘নন-লেথাল ওয়েপনস’ (প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্র) ব্যবহারের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু তা আর আলোর মুখ দেখেনি।
মে মাসের ৫ তারিখের ঘটনা আরো মর্মান্তিক। কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্তে মারা যায় ১৭ বছরের কিশোর সাকিব। বলা হয়, সে চুরি করা মোটরসাইকেল আনতে গিয়েছিল। সেই যাত্রায় তার আর ফেরা হলো না; কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে তাকে মৃত ঘোষণা করা হলো। নিউএইজ পত্রিকার তথ্যমতে, ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিলের মধ্যে ২৪ জন নিহত হয়েছে এবং প্রতিটি ক্ষেত্রেই প্রথমে শোক প্রকাশ করে পরে বলা হয়েছেÑতারা অবৈধ ছিল... গুলি চালানো হয়েছে আত্মরক্ষায়। এমন ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটছে। আবার গত ৩ জুলাই দর্শনা সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারান ৩০ বছর বয়সি ইব্রাহিম বাবু। তার অপরাধ(!) হলোÑতিনি গরুর ঘাস কাটার জন্য ভারতের সীমান্তের কাছাকাছি গালার মাঠে গিয়েছিলেন।
একসময় সীমান্ত হত্যা নিয়ে প্রতিবাদের ঢেউ বেশ তীব্র ছিল। ফেলানী খাতুনের হত্যাকাণ্ড জনমনে যে আলোড়ন তুলেছিল, তা ভোলার নয়। সে সময় ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় সর্বোচ্চ পর্যায়ের প্রতিবাদ হয়েছিল এবং বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও আলোচিত হয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এসে সীমান্তের হত্যাকাণ্ডগুলো নিয়ে তেমন কোনো প্রতিবাদ দেখা যাচ্ছে না। রাজনৈতিক দলগুলোর পক্ষ থেকেও কোনো জোরালো বিবৃতি আসেনি। মনে হয় যেন সীমান্ত হত্যা মেনে নেওয়া যায়, এমন ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিক্ত বাস্তবতা হলো, সর্বশেষ চলতি মাসেও সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন অন্তত তিনজন বাংলাদেশি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দায়সারা প্রতিবাদ জানিয়ে দায়িত্ব শেষ করছে। মোদ্দাকথা, সীমান্ত হত্যা বন্ধে সরকারের কার্যকর ভূমিকা পরিলক্ষিত হচ্ছে না।
বিশ্বে সবচেয়ে বেশি সীমান্ত হত্যা ঘটে ‘বাংলাদেশ-ভারত’ সীমান্তে। মানবাধিকার সংস্থা ও স্থানীয় রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০০০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত প্রায় ১,২০০–১,৩০০ জন বাংলাদেশি ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে। তাদের অধিকাংশই গ্রামীণ কৃষক, খেটে খাওয়া মানুষ কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, যাদের জীবন-জীবিকা সীমান্তঘেঁষা এলাকায় গড়ে উঠেছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন অনুযায়ী, ‘জীবনের অধিকার’ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত একটি অধিকার। এই আইনের বিধান অনুসারে, গুলি চালানোর আগে অবশ্যই সম্ভাব্য ঝুঁকি মূল্যায়ন, সতর্কসংকেত প্রদান, গ্রেপ্তারের চেষ্টা এবং প্রাণঘাতী নয় এমন অস্ত্র (নন-লেথাল ওয়েপন) ব্যবহারের মতো বিকল্প সব পথ পর্যালোচনা করা বাধ্যতামূলক। অথচ এসব বিধি লঙ্ঘন করেই সীমান্তে নিয়মিত ঘটছে মৃত্যুর ঘটনা, যা কোনো সভ্য ও মানবিক রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।
ভারতের স্থলসীমান্ত রয়েছে মোট সাতটি দেশের সঙ্গেÑবাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, ভুটান, মিয়ানমার, চীন এবং আফগানিস্তান (পূর্বের)। কিন্তু এসব দেশের মধ্যে একমাত্র বাংলাদেশের সঙ্গেই বিএসএফ এই মাত্রায় প্রাণঘাতী আচরণ করে থাকে। চোরাচালান, অবৈধ অনুপ্রবেশÑএসব ঘটনা সীমান্ত এলাকায় সব দেশের ক্ষেত্রেই ঘটে থাকে। অধিকাংশ দেশ তা আটক, জিজ্ঞাসাবাদ ও আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মোকাবিলা করে থাকে। অথচ বাংলাদেশ সীমান্তে সামান্য সন্দেহেই গুলি করে হত্যা করা হয়। কিছু চোরাচালান হয় ঠিকই, কিন্তু বহু নিরপরাধ মানুষও বিএসএফের গুলিতে প্রাণ হারিয়েছে। ফলে এটা আর শুধু চোরাচালান প্রতিরোধের প্রশ্ন নয়Ñএটি এক ধরনের ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ এবং বাংলাদেশের প্রতি একপ্রকার ক্ষমতার অপপ্রয়োগ।
সীমান্তে প্রতিটি হত্যাকাণ্ড শুধু একজন কৃষক বা গ্রামের ছেলের জীবন কেড়ে নেয় না; এটি দেশের আত্মসম্মানের প্রশ্ন। যদি আমরা আজ সক্রিয় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা এবং জনসচেতনতা সৃষ্টির মাধ্যমে এই বর্বরোচিত ঘটনার বিরুদ্ধে সরব না হই, আজকের এই নীরবতা আগামীকাল এক গভীর ক্ষতরূপে রূপান্তরিত হবে। সীমান্তে বাংলাদেশিদের দিকে ছুটে আসা প্রতিটি গুলিই রাষ্ট্রের ব্যর্থতা। তাই এই দায় এড়ানোর যেমন কোনো সুযোগ নেই, তেমনি শুধু প্রতিবাদে সীমাবদ্ধ না থেকে স্থায়ী সমাধানের পথ খুঁজে বের করা জরুরি। মানুষ যখন সীমান্তের আশপাশে যেতেই ভয় পায়, তখন সেই দেশের স্বাধীনতা এবং প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্ক অর্থহীন হয়ে পড়ে। কূটনৈতিক প্রজ্ঞা এবং দৃঢ় পদক্ষেপের মাধ্যমেই এ সমস্যার টেকসই সমাধান সম্ভব।
লেখক : যুগ্ম সদস্যসচিব, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)