ফুটপাথ হাঁটার জন্য। পথিকের পথ চলার জন্য। এটিই নিয়ম। দেশে দেশে ফুটপাথ তৈরি এ জন্য। ব্যত্যয় বাংলাদেশ। বিশেষ করে রাজধানী ঢাকাসহ চট্টগ্রাম ও অন্যান্য বড় বড় শহরে যেমনটা দেখা যায়। এসব শহরের যারা নির্বাচিত হয়ে আসেন তাদের বিভিন্ন স্তরের পোষ্য পাতিনেতা, ছাত্রনেতা, যুবনেতা, শ্রমিক নেতার সেবা করতে গিয়ে হারিয়ে যায় জনকল্যাণ। তাদের অর্থ কামাইয়ের এই অবৈধ উপায়ের প্রতিযোগিতায় হারিয়ে যায় নগরবাসীর স্বপ্নের ফুটপাথ। হারিয়ে যায় তাদের সকাল-বিকেল ফুটপাথ দিয়ে হাঁটার ইচ্ছেটা।

যারা অবৈধ অর্থ লাভের জন্য ফুটপাথ দখল করে ইজারা দেন তারা কমবেশি সবাই শিক্ষিত কিংবা কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া। এরা দেশের ভবিষ্যৎ নেতা-পথপ্রদর্শক। নিজ স্বার্থের জন্য যারা নগরবাসীর প্রয়োজনকে বিকিয়ে দেন, তারা ভবিষ্যতে দেশের কল্যাণ করবেন, ক্ষমতা হাতে পেয়ে তারা জনকল্যাণের কাজ করবেন এটি কিভাবে বিশ্বাস করা যায়। দেশের ভবিষ্যৎ কাণ্ডারিরা এই অবৈধ প্রক্রিয়ার দখলদারিত্বের জন্য যখন পারস্পরিক বিরোধে জড়ায়, খুনোখুনিতে জড়িয়ে পড়ে, তখন লজ্জায় নিজেকে শিক্ষিত দাবি করার কথা ভাবলেই ঘৃণায় গা গুলিয়ে ওঠে। অথচ এদের ওপর ভরসা করেই দেশের রাজনীতি আবর্তিত। গত ১৫-২০ বছরে আমরা দেখেছি ফুটপাথ দখলে নেয়ার মচ্ছব। হকারদের সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা ও পুনর্বাসন নগরীর ফুটপাথ রক্ষণাবেক্ষণের কথা কখনো উচ্চারিত হয়েছে বলে শোনা যায়নি। সাধারণ মানুষ ফুটপাথ ছেড়ে মূল সড়কে নেমেছে। বেড়েছে দুর্ঘটনা, অকাল মৃত্যু আর পঙ্গুত্বের সংখ্যা।

বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহরগুলোর একটি ঢাকা মহানগরী। প্রায় দুই মিলিয়ন জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ শহরে গাড়িসহ প্রায় ১.৩ মিলিয়ন রিকশা চলাচলের জন্য মহানগরীতে রয়েছে এক হাজার ২৫০ বর্গকিলোমিটার সড়কসহ ৬৬৮ বর্গকিলোমিটার ফুটপাথ। জনসাধারণের পায়ে চলার জন্য নির্মিত এই ফুটপাথে হেঁটে চলা দায়। বিভিন্ন পসরা সাজিয়ে বসা হকারদের হাঁকডাক এর ওপর মাঝে মধ্যেই মোটরসাইকেলের ফুটপাথ দিয়ে চলাচল ফুটপাথকে সবসময় ঝুঁকিপূর্ণ করে রাখে। প্রায়ই ঘটে থাকে দুর্ঘটনা।

৬৬৮ বর্গকিলোমিটার ফুটপাথের বেশির ভাগ অংশজুড়ে আধিপত্য প্রায় ছয় লাখ হকারের। নগরবাসীদের করের টাকায় নগরবাসীর চলাচলের জন্য নির্মিত ফুটপাথ দিয়ে চলাফেরা করার কোনো অবস্থা নেই। এই দখলের বদৌলতে বছরে অবৈধভাবে প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার লেনদেন হয়ে থাকে। এই বিশাল অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হয় না। পুরোটাই চলে যায় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় আশ্রিত মাস্তান, বিভিন্ন স্তরের নেতা, হকার সমিতি ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু অসৎ কর্মকর্তার হাতে। ২০১৬ সালে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকার হকারদের ওপর একটি জরিপ চালায়। জরিপে উঠে আসে, হকারদের কাছে থেকে সংগৃহীত অর্থের পরিমাণ দুই সিটি করপোরেশনের মোট বার্ষিক বাজেটের চেয়েও বেশি।

এই বিশাল অর্থের ভাগ বসানোর জন্য বিশেষ ব্যবস্থাপনায় ফুটপাথ বাণিজ্য চলে আসছে অব্যাহতভাবে। পরিণতিতে ঢাকা মহানগরীর ব্যস্ততম এলাকা মতিঝিল, পল্টন, বায়তুল মোকাররম, জিপিওসংলগ্ন রাস্তা, গুলিস্তান, নিউমার্কেট, এলিফ্যান্ট রোড দিয়ে পথচারীদের পথচলা দায়। এ ব্যাপারে সিটি করপোরেশনের দায়িত্বপ্রাপ্তরা নির্বিকার। নইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মূল ফটক লাগোয়া সড়কের ফুটপাথে হকারদের রমরমা ব্যবসার আয়োজন কিভাবে সম্ভব? একই সাথে আমাদের স্বাচ্ছন্দ্য বিধানের দায়িত্ব যাদের তারা কিভাবে এসব দেখেও না দেখার ভান করে নিজেরা নির্বিঘ্ন নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন?

ফুটপাথ পায়ে চলার জন্য। নগরবাসীর বয়স্কদের প্রাতঃ ও বৈকালিক ভ্রমণের জন্য। পরিবার-পরিজনসহ বৈকালিক ভ্রমণের সাধ কার নেই? কিন্তু ফুটপাথ বেদখল থাকায় নগরবাসীকে ঘরের চার দেয়ালের ভেতর আটকে থাকতে হয়। এর মারাত্মক প্রভাব পড়ে দৈহিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর; বিশেষ করে শিশুদের ওপর।

পৃথিবীর বিভিন্ন বড় বড় শহরে হকারদের পরিচয়পত্র রয়েছে। প্রতি বছর নির্দিষ্ট পরিমাণ ফি জমা দিয়ে এটি নবায়ন করা যায়। এর ফলে নগরকর্তারা সঠিকভাবে জানতে পারেন মোট কতজন হকার আছেন। অন্য দিকে রেজিস্ট্রেশন ও নবায়নের বদৌলতে নগর কর্তৃপক্ষের তহবিলে আয়ের একটি খাত সৃষ্টি হয়। রেজিস্ট্রেশনকৃত হকারদের দায় নগর কর্তৃপক্ষের। নিয়তই রাস্তা দখল না করে শহরের বাইরে গড়ে তোলা যায় হকারপল্লী। এতে যাতায়াতের সুবিধার জন্য থাকবে গণপরিবহনের ব্যবস্থা।

একই সাথে সপ্তাহের এক এক দিনে শহরের এক এক এলাকায় সান্ধ্যকালীন হকার বাজারের ব্যবস্থা রয়েছে বিভিন্ন দেশে। এতে এক দিকে যেমন ফুটপাথ পায়ে চলার উপযোগী থাকে, সাথে সাথে কমে যানজট, দুর্ঘটনার আশঙ্কা। সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে ফুটপাথগুলো নগরবাসীদের চলাচলের উপযোগী হোক এই প্রত্যাশা রইল।

লেখক : চক্ষুরোগ বিশেষজ্ঞ

সূত্র, নয়া দিগন্ত