বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি জনগণের প্রত্যাশা ছিল ব্যাপক। আন্দোলন চলাকালে বিভিন্ন স্থানে দেখা গিয়েছিল ‘সংস্কার’ শব্দটি লেখা নানা গ্রাফিতি, যা জনগণের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করে। সেই দাবি বিবেচনায় নিয়ে সরকার কয়েকটি সংস্কার কমিশন গঠন করে। পরে ঐকমত্যের ভিত্তিতে একটি কমিশন গঠিত হয়, যেখানে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধি অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই প্রতিনিধিদের মতামতের ওপর নির্ভর করেই নির্ধারিত হচ্ছে কোন সংস্কার গ্রহণযোগ্য হবে এবং কোনটি নয়।

তবে এখানেই শুরু হয় সংকট। কারণ অনেক দল অতীতে নির্বাচনি প্রতিশ্রুতি দিয়ে তা রক্ষা করেনি এবং তৃণমূলে জনগণের সঙ্গে কোনো সংযোগও গড়ে তুলতে পারেনি। ফলে জনগণ তাদের ওপর আস্থা হারিয়েছে। তাই চব্বিশের যে জুলাই বিপ্লব হয়েছে, তা কোনো রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে নয়, বরং ছাত্র ও সাধারণ জনগণের নেতৃত্বেই সফল হয়েছে।

এই বাস্তবতায় রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে সংস্কার আনা দুরূহ। ফলে তারা বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে। তাই সংস্কার বিষয়ে কীভাবে জনগণকে অধিকতর সম্পৃক্ত করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে জরুরি ভিত্তিতে। কিছু নেতার জনগণের প্রতিনিধি সেজে তাদের মতের ভিত্তিতে আর সংস্কার কমিশনের কিছু ব্যক্তির টেবিল মেকিং রিপোর্ট নামক যে সংস্কার প্রতিবেদন হাজির করা হচ্ছে, তা দেশের কোনো কাজে আসবে না বলেই মনে হচ্ছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সংস্কার কমিশনের রিপোর্ট থেকে এটি স্পষ্ট, তাতে চব্বিশের চেতনা ও জনআকাঙ্ক্ষা ধারণ করছে না। জনগণ কী চান, সে অনুযায়ী সংস্কারের বিষয় নির্ধারণ করতে হবে। সে কারণে যেভাবেই হোক জনমত জানার ব্যবস্থা করতে হবে। তা না হলে বারবার এভাবেই মানুষকে মুক্তির জন্য রাজপথে জীবন দিতে হবে। তাই আজ সময় এসেছে অধিকতর জনগণের সরাসরি অংশগ্রহণ এবং গণভোটের মাধ্যমে নতুন শাসন কাঠামো, নতুন ব্যবস্থা প্রণয়ন করতে হবে। নয়তো সামনে অপেক্ষা করছে বড় ধরনের অনিশ্চয়তা। আবার ঘুরেফিরে আমাদের আগের জায়গাতেই নিয়ে যাবে আমাদের নেতারা।

অতীতে প্রতিটি সরকার ক্ষমতায় গিয়ে দেশের পরিবর্তে ব্যক্তি ও দলের স্বার্থে, ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে অনেক আইন পাস এবং সংস্কার করেছে। এ ধরনের রাজনীতিবিদ ও দল আবার নির্বাচিত হয়ে সংসদে গিয়ে সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করবে কি নাÑসে বিষয়ে জনমনে বড় ধরনের প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।

যেহেতু এই বিপ্লব কোনো রাজনীতি দলের আহ্বানে হয়নি, সেহেতু এই বিপ্লবের নায়ক এই দেশের জনতা। যদি দেশের সংস্কার ও নতুন শাসনব্যবস্থা নির্ধারণ করতে হয়, তাহলে তা করতে হবে জনগণের মতের ভিত্তিতে। সব বিষয়ে সাধারণ মানুষের মতামত গ্রহণের জন্য প্রয়োজন একটি গণপরিষদ গঠন, যাদের অনেক শাখা থাকবে সারা দেশে। খোলা মাঠে হতে হবে এসব জনমত সংগ্রহের কাজ, যেখানে সাধারণ মানুষ এসে তারা তাদের মত জানাতে পারবেন। এভাবে তৈরি করা গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ের ক্ষেত্রে সবশেষে গণভোটের মাধ্যমে চূড়ান্ত করতে হবে।

পৃথিবীর প্রত্যেক দেশে বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে বিপ্লবী সরকার গঠিত হয়েছিল। তারাই বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে এসেছিল। কিন্তু বাংলাদেশে বিপ্লব-পরবর্তী সময়ে বৈপ্লবিক সরকার গঠন করা সম্ভব হয়নি রাজনৈতিক দলের অনিচ্ছা ও অসহযোগিতার কারণে। আবার জাতীয় সরকার গঠনের আলোচনা থাকলেও সেটিও বাস্তবায়ন হয়নি রাজনৈতিক দলের বিরোধিতার কারণে।

ফলে বিপ্লব-পরবর্তী সময়েও নানা অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। তাই এখনো সময় আছে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারে জনআকাঙ্ক্ষা ‍অনুযায়ী বড় ধরনের পরিবর্তন আনা। অন্যথায় এ সরকারের পক্ষে চব্বিশের চেতনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না।

যেহেতু রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকে জাতীয় সরকার, বিপ্লবী সরকার গঠনে বাধা এসেছে, দলীয় স্বার্থে তাই তারা ভবিষ্যতেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেশ ও জনগণের স্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দেবেÑএটাই স্বাভাবিক।

তাই, সংস্কারকাজে রাজনৈতিক দল ও নেতাদের পাশাপাশি অধিকসংখ্যক ছাত্র এবং সাধারণ মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া চব্বিশের চেতনার আলোকে আধুনিক রাষ্ট্রগঠন সম্ভব হবে না।

লেখক : শিক্ষার্থী, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগ

বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর

সূত্র, আমার দেশ