ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার শাসনামলে ২০১২ সালের ২৫ জুন সেনাপ্রধানের দায়িত্ব গ্রহণ করেন জেনারেল ইকবাল করিম ভূঁইয়া। ২০১৫ সালের ২৫ জুন তিনি মেয়াদ শেষ করে অবসরে যান। তারপর থেকে তার তেমন কোনো খোঁজ ছিল না। অনেকটা লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলেন। ২০২৪ সালে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় হঠাৎ করেই যেন তিনি দৃশ্যপটে আবির্ভূত হন। বিপ্লবী হয়ে ওঠেন। ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে আন্দোলনের পক্ষে অবস্থান নেন। তার অনুগত অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মর্তাদের অভ্যুত্থানের পক্ষে মাঠে নামান। বলা হয়ে থাকে, ৫ আগস্ট হাসিনার পতনের পর ইকবাল করিম ভূঁইয়া আশা করেছিলেন, সেনা প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে দেবেন এবং সেই সরকারের গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠবেন তিনি। তার এ আশা পূরণ হয়নি। তারপর থেকে তিনি অনেকটা অসন্তুষ্ট অবস্থায় রয়েছেন। ফেসবুকে তার নিজস্ব আইডিতে দেয়া পোস্টে থেকে তা সকলেই বুঝতে পারেন। সম্প্রতি তিনি বাংলা ও ইংরেজিতে ‘আগামী পাঁচ বছরে আমরা কোথায় যাচ্ছি?’ শিরোনাম দিয়ে ধারাবাহিকভাবে বেশ কয়েকটি পোস্ট দেন। পাস্টে তিনি নির্বাচন, অন্তর্বর্তী সরকার আরও ১-২ বছর থাকবে, প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রেসিডেন্ট করে ঐকমত্যের জাতীয় সরকার গঠিত হবে, বিএনপি ক্ষমতায় এলেও পুরো মেয়াদ শেষ করতে পারবে কিনা, তা নির্ভর করবে কিছুটা ভারতের কৌশলগত অবস্থানের ওপর এবং কিছুটা আওয়াগী লীগের প্রত্যাবর্তন ও শক্তি সঞ্চয়ের ওপর ইত্যাদি মতামত তুলে ধরেন। পাশাপাশি এ কথাও বলেছেন, যদি বিএনপি তার (আওয়ামী লীগ) বিরুদ্ধে পরিচালিত পরিকল্পিত সহিংসতাবিরোধী আন্দোলন দমনে ব্যর্থ হয় তবে ১/১১-এর পুনরাবৃত্তি ঘটবে। এছাড়া পোস্টে নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা প্রকাশস আগামী পাঁচ বছর দেশ বিভ্রান্তি, অস্থিরতা, প্রতিবাদ, আন্দোলন, হরতাল-অবরোধ, সহিংসতা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে যাবে বলে উল্লেখ করেন। প্রশ্ন আসতে পারে, হঠাৎ করে ইকবাল করিম ভূঁইয়া কেন এ ধরনের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও উসকানিমূলক বয়ান দেয়া শুরু করেছেন? এর নেপথ্যে কি রয়েছে?

ইকবাল করিম ভূঁইয়া সেনাপ্রধানের দায়িত্ব পালনকালেই বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন সব ঘটনা ঘটে, যা বাংলাদেশকে এক অন্ধকার যুগে প্রবেশ করায়। তার সময়কালেই শেখ হাসিনা সরকার ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ইতিহাসের নিকৃষ্টতম ভোটারবিহীন নির্বাচন করে। সে নির্বাচনে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা সিং কীভাবে সরাসরি হস্তক্ষেপ করেছেন, তা দেশের মানুষ দেখেছে। সে সময়ের সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভূঁইয়ার বিন্দুমাত্র টনক নড়েনি, বিবেক জাগ্রত হয়নি। পর্যবেক্ষকরা স্পষ্ট করেই বলেছেন, এই ভুয়া নির্বাচনের মধ্য দিয়েই শেখ হাসিনা ফ্যাসিস্ট হয়ে ওঠেন। ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা এবং তার আধিপত্যবাদ কায়েম করতে দিয়ে বাংলাদেশকে ভারতের করদরাজ্যে পরিণত করেছিলেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ভারতের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। পর্যবেক্ষকদের মতে, ইকবাল করিম ভূঁইয়া আশা করেছিলেন, ভোটারবিহীন নির্বাচনে সহায়তা করে অবসরে যাওয়ার পর হাসিনা পুরস্কার হিসেবে তাকে মন্ত্রী-এমপি বানাবেন। তবে হাসিনা সে সুযোগ না দিয়ে তাকে পাওয়ার প্ল্যান্টসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়েছেন। সেই সুবিধা আজও ভোগ করছেন। ইকবাল করিম ভূঁইয়ার সময়েই ২০১৪ সালের ৫ মে শাপলা চত্ত্বরের ট্র্যাজিক ঘটনা ঘটে। সে সময় ডিজিএফআই ও র‌্যাবে থাকা কতিপয় সেনাসদস্যর পরিকল্পনায় শাপলা চত্ত্বরে নিরীহ আলেম-ওলামা ও মাদরাসা শিক্ষার্থীদের ওপর বর্বর হামলা চালানো হয়। সে সময়ও ইকবাল করিম ভূঁইয়ার বিবেকবোধ জাগেনি। ভারতের প্রেসক্রিপশনে শাহবাগে কথিত গণজাগরণ মঞ্চের নামে দেশকে ভারতের হুকুমের গোলামে পরিণত করার পরিকল্পনার সময়ও তিনি ‘স্পিকটি নট’ হয়েছিলেন। সেনাপ্রধান হওয়ার ছয় মাস আগে যে বিডিআর ম্যাসাকার হয় এবং এতে যারা জড়িত ছিল, তাদের ব্যাপারেও কোনো ব্যবস্থা নেননি। দেশকে হাসিনা ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিলেও নিজস্বার্থ লাভের আশায় তিনি চুপ করে বসেছিলেন। হাসিনা তাকে নানা সুযোগ-সুবিধা দিয়েছিলেন বটে, তবে মন্ত্রী-এমপি হওয়ার সুযোগ দেননি। বলা যায়, সেনাপ্রধান থাকাকালে তিনি নীরব থেকে ভারত ও হাসিনার সব চাওয়া এবং অন্যায় কাজকে সমর্থন দিয়ে গেছেন। চব্বিশের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে এসে যেন তার সুবিধাবাদী চেতনা জেগে ওঠে। ছাত্র-জনতার রক্তের বিনিময়ে হাসিনার পতন অনিবার্য টের পেয়ে তার অনুগত অবসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তাদের নিয়ে মাঠে নেমে পড়েন। আশা ছিল, হাসিনার পতনের পর, তার পরামর্শে সেনাবাহিনী অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করে দেবে এবং তাতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ পদ, এমনকি প্রধান উপদেষ্টার পদও পেয়ে যাবেন। হাসিনার সময়ে তার অতৃপ্ত আশা পূরণ হবে। তবে তার পাতা এমন ফাঁদে সেনাবাহিনী পা দেয়নি। এতে ইকবাল করিম ভূঁইয়ার মধ্যে অতৃপ্তি ও অসন্তোষ থাকা অস্বাভাবিক নয়। এখনও তিনি সেই আশা ছাড়েননি বলে পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। এজন্য এখন নানা বয়ান বা ছবক দেয়া শুরু করেছেন। আগামী নির্বাচন যাতে সময়মতো না হয়, অন্তর্বর্তী সরকার আরও এক-দুই বছর থাকে এবং তার ভাষায় ঐকমত্যের জাতীয় সরকার গঠিত হয়ে ড. মুহাম্মদ ইউনূস যাতে প্রেসিডেন্ট হন, এখন এমন পরামর্শ ও মতামত তুলে ধরেছেন। তার ভবিষদ্বাণী অনুযায়ী, যদি তা হয়, তাহলে প্রধান উপদেষ্টা কে হবেন, এ জায়গাটি কৌশলে উহ্য রেখেছেন। এ থেকে এ পদের প্রতি তার খায়েশের বিষয়টি বুঝতে অসুবিধা হয় না। দেশ যখন নির্বাচনমুখী, দেশের মানুষ উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট দেয়ার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে এবং নির্বাচনের সকল প্রস্তুতি চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে, তখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ইকবাল করিম ভূঁইয়ার এসব কথাবার্তায় নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্রের আভাস পাওয়া যায়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, তিনি নিজস্ব চিন্তা, অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতা পর্যবেক্ষণের নামে যেসব কথাবার্তা বলেছেন, তা প্রকরান্তরে ভারতের এজেন্ডা বা প্রেসক্রিপশনের ওপর ভিত্তি করেই তুলে ধরেছেন। আগামী নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় এলেও পুরো মেয়াদ শেষ করতে পারবে না এবং অন্তর্বর্তী সরকার আরও এক-দুই বছর থাকবে, তার এমন দ্বিমুখী প্রেডিকশনের মধ্যে উসকানি, ধূরজাল সৃষ্টি ও দেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার যে ইঙ্গিত রয়েছে, তা বুঝতে অসুবিধা হয় না।

ইকবাল করিম ভূঁইয়া যে ‘ঝোপ বুঝে কোপ’ মারতে পারদর্শী, তা ইতোমধ্যে বিশ্লেষকরা বুঝে গেছেন। তার এই মতামতের মধ্যে তারা ষড়যন্ত্র ও ভারতের স্বার্থ রক্ষার ইঙ্গিত রয়েছে। তাদের মতে, যেখানে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস নির্বাচন হওয়ার ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ, নির্বাচন কমিশন ডিসেম্বরের প্রথমার্ধে নির্বাচনের তফশিল ঘোষণা করবে, নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্নের লক্ষ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সেনাবাহিনীকে পুরোপুরি প্রস্তুত করা হচ্ছে, সেখানে ইকবাল করিম ভূঁইয়ার অনবরত নানা বিভ্রান্তিকর, বিতর্কিত ও উসকানিমূলক কথা বলা গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ কিনা, তা খতিয়ে দেখা জরুরি। একে হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ নেই। এ ধরনের সুবিধাবাদী ও উচ্চাভিলাসী ইনফ্লুয়েন্সিয়াল ব্যক্তির উসকানিমূলক বক্তব্যের ব্যাপারে সকলকে সচেতন থাকতে হবে। নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমানের উচিৎ, এ ব্যাপারে সতর্ক দৃষ্টি রাখা। নির্বাচনকে সামনে রেখে ইকবাল করিম ভূঁইয়ার মতো যারা নানা কথা ও কার্যক্রমের মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল ও অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিতে তৎপর, তাদের ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। নির্বাচন নিয়ে কোনো ধরনের শঙ্কা বা সংশয় নেই, এ ব্যাপারে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আবারও দেশবাসীর সামনে পরিস্কারভাবে বলতে হবে।

সূত্র, ইনকিলাব