ড্যাম, ব্যারাজ এসব নিছক সেচ ও বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প নয়; বরং একেকটি ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র। প্রতিপক্ষকে নতজানু করতে পানি আটকে শুকিয়ে মারা আবার পানি ছেড়ে দিয়ে ভাসিয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে। গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, সিন্ধু, নীল নদসহ বিশ্বের বিভিন্ন নদী বা রিভার সিস্টেম নিয়ন্ত্রণ নিয়ে দেশে দেশে দ্বন্দ্ব-সংঘাত ক্রমেই অনিবার্য হয়ে উঠছে। ভবিষ্যতে যেসব ইস্যু ঘিরে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বড় ধরনের দ্বন্দ্ব এবং সংঘাত ঘটতে পারে, তার মধ্যে অন্যতম একটি হলো নদীর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা।

দীর্ঘকাল ধরে যুদ্ধের সময় প্রতিপক্ষের সহজ শিকারে পরিণত হচ্ছে ড্যাম ও ব্যারাজ। অনেক সময় প্রতিপক্ষের অগ্রযাত্রা রোধে নিজেরাই নিজেদের ড্যাম, ব্যারাজ ভেঙে দিয়ে বিপর্যয় সৃষ্টি করে। ১৯৩৭ সালে জাপানি আগ্রাসন প্রতিরোধে ইয়াংসি নদীর ড্যাম ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। এ ঘটনায় ৯ লাখ বেসামরিক মানুষ নিহত হয়। এছাড়া চীনা তিন লাখ এবং জাপানের এক লাখ সেনাও মারা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ এয়ার ফোর্স জার্মানির মোহনি এবং এডার ড্যাম ধ্বংসে ‘ডামবাস্টার অপারেশন’ পরিচালনা করে। এর লক্ষ্য ছিল জার্মানশিল্পের প্রাণকেন্দ্র অচল করা। জার্মানিও ইতালির ড্যাম ধ্বংস করে বন্যা সৃষ্টি করে। কোরিয়া ও ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্র উত্তর কোরিয়া এবং উত্তর ভিয়েতনামের অনেক ড্যাম ধ্বংস করে।

১৯৭৭ সালে জেনেভা কনভেনশনে নিষিদ্ধ করা হয় যুদ্ধের সময় ড্যাম ও ব্যারাজে হামলা। কিন্তু তাতে মোটেও কমেনি এসব অবকাঠামোকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহারের ঝুঁকি। ভারতনিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের পেহেলগামে ২২ এপ্রিল কথিত সন্ত্রাসী হামলার পর ভারত একতরফাভাবে স্থগিত করে সিন্ধু নদীর পানি চুক্তি। সিন্ধু পাকিস্তানের প্রধান নদী। মিসর যেমন নীল নদের দান, তেমনি পাকিস্তানের প্রাণশক্তি সিন্ধু নদী। ফলে ভারত যখন এ ধরনের একটি নদীর পানি চুক্তি বাতিল করে পানিপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করতে চায়, তখন এটি স্পষ্ট যে, ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে দেশটিকে নতজানু ও কাবু করার জন্য। সিন্ধু নদীর পানি যেহেতু পাকিস্তানের জীবন-মরণের প্রশ্ন, তাই দেশটির সেনাপ্রধান ফিল্ড মার্শাল জেনারেল অসিম মুনির গত ৮ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের বুকে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দিয়েছেন সিন্ধু নদীর পানি আটকাতে ভারত যদি কোনো ড্যাম নির্মাণ করে, তাহলে দশটি মিসাইল মেরে তা উড়িয়ে দেওয়া হবে।

ভারত সিন্ধু নদীর ‍পানি চুক্তি বাতিলের পর পাকিস্তানের পক্ষ থেকে কঠোর হুঁশিয়ার করে বলা হয়েছে, ভারত যদি এ নদীর পানি ন্যায্য হিস্যা থেকে তাদের বঞ্চিত করে, তাহলে সিন্ধু নদী দিয়ে হয় পানি প্রবাহিত হবে, নয়তো রক্ত প্রবাহিত হবে।

১৫ আগস্ট স্বাধীনতা দিবসে লাল কেল্লায় দাঁড়িয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন, তিনি সিন্ধু নদীর পানি চুক্তি আবার চালু করবেন না। বস্তুত নরেন্দ্র মোদির এ ঘোষণার মাধ্যমে ভারত পানিকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে একটি অস্ত্র হিসেবেই দাঁড় করাল। আর মোদির এ ঘোষণার মাত্র ১২ দিনের মাথায় পাকিস্তানের পক্ষ থেকে চলমান বন্যার জন্য ভারতকে দায়ী করা হয়েছে। পাকিস্তানের পরিকল্পনামন্ত্রী আহসান ইকবাল ২৮ আগস্ট বলেছেন, ভারত পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। তারা ইচ্ছাকৃতভাবে আকস্মিক বিভিন্ন ড্যাম থেকে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে পাকিস্তানে বন্যা সৃষ্টি করেছে।

১৯৭৫ সালের ফারাক্কা বাঁধ চালুর পর থেকে ভারতের নির্মম পানি আগ্রাসনের শিকার বাংলাদেশ। বাংলাদেশকে নতজানু রাখতে ভারত পাঁচ দশক ধরে শুকনো মৌসুমে পানি না দিয়ে শুকিয়ে মারছে এবং বর্ষাকালে অতিরিক্ত পানি ছেড়ে বন্যায় ভাসিয়ে দিচ্ছে। এবার ভারতের বিরুদ্ধে একই অভিযোগ করল পাকিস্তান।

বাংলাদেশ-ভারত আন্তঃসীমান্ত নদীর সংখ্যা ৫৪টি। এর মধ্যে ৩৬টি নদীর ওপর ভারত ৫৪টি ড্যাম ও ব্যারাজ নির্মাণ করে পানির ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করছে। এর মধ্যে চারটি ড্যাম ও ব্যারাজ রয়েছে, যা ভারত বাংলাদেশের প্রবেশ মুখে নির্মাণ করেছে। এগুলো হলো পদ্মার উজানে ফারাক্কা, তিস্তার উজানে গজলডোবা, কুশিয়ারার উজানে বরাক নদীতে টিপাইমুখ এবং গোমতী নদীর উজানে ত্রিপুরার ডম্বুর ড্যাম।

বাংলাদেশ ও পাকিস্তান যখন ভারতের পানি অস্ত্রের শিকার এবং সিন্ধু নদীর পানি নিয়ে যখন ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা চলছে, তখন সামনে এলো ব্রহ্মপুত্র নদীর উৎসমুখে চীনের সুপার ড্যাম নির্মাণের খবর। গত ১৯ জুন চীন বিশ্বের সবচেয়ে বড় পানিবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ শুরু করেছে। চীন একে শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ অবকাঠামো প্রকল্প হিসেবে ঘোষণা দিয়েছে। দৈনিক এর বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ৬০ হাজার মেগাওয়াট। নির্মাণ খরচ ১৬৭ বিলিয়ন ডলার। ব্রহ্মপুত্র নদী হিমালয়ের কৈলাশ শৃঙ্গের কাছে মানস সরোবর হৃদ থেকে উৎপত্তি হয়ে চীনের তিব্বত থেকে ভারতের অরুণাচল, আসামের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী পানি সিস্টেম হলো এই ব্রহ্মপুত্র। চীনের সুপার ড্যামকে ভারতের পক্ষ থেকে ‘জলবোমা’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলা হয়েছে ভবিষ্যতে চীন এ ড্যামকে ভারতের বিরুদ্ধে পানি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবে। চীন যাতে সুপার ড্যামকে ভারতের বিরুদ্ধে পানি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে, সে জন্য ভারত তাদের অংশে দুটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। অরুণাচল প্রদেশে ভারত একটি ড্যাম নির্মাণ করবে ১১ হাজার ৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতাসম্পন্ন। এটি হবে ভারতের সবচেয়ে বড় পানি বিদ্যুৎ প্রকল্প। ইতোমধ্যে ভারত এ প্রকল্পের সম্ভাব্য যাচাই শুরু করেছে।

তিব্বতে চীনের সুপার ড্যাম এবং এর পাল্টা হিসেবে ভারতের একাধিক ড্যাম নির্মাণ তথা ভবিষ্যতে চীন ভারতের পানিযুদ্ধের নির্মম শিকার হতে পারে বাংলাদেশ।

বিভিন্ন গবেষণা প্রতিবেদন অনুসারে ফারাক্কা ব্যারাজ চালুর আগের সময়ের তুলনায় বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান নদী পদ্মায় পানিপ্রবাহ কমেছে ৮০ শতাংশ। ৫০ বছরের ব্যবধানে নদীর আয়তনও কমেছে ৫০ শতাংশের বেশি। পানির অভাবে শুকিয়ে মরে গেছে পদ্মার অনেক শাখা নদী। বর্ষাকালে দুই মাসে পদ্মায় পানি থাকে। এছাড়া শুকনো মৌসুমে ‍পানির পরিবর্তে চোখে পড়ে শুধু ধু ধু বালুচর। ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের সার্বিক ক্ষতি লিপিবদ্ধ করা হলে হাজার পৃষ্ঠা ছাড়িয়ে যাবে। ফারাক্কার মতো ভারত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পানি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে তিস্তা, গোমতী ও কুশিয়ারার উজানে নির্মিত ড্যাম ব্যারাজ। এ অবস্থায় দেশের প্রধান নদী যমুনার উজানেও যদি ভারত ড্যাম নির্মাণ করে বাংলাদেশের জন্য পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে, তাহলে দেশের অস্তিত্ব রক্ষা অসম্ভব হয়ে উঠতে পারে।

তাই বর্তমানে বাংলাদেশের অন্যতম অগ্রাধিকার কর্মসূচি হওয়া উচিত ভারতের পানি অস্ত্র থেকে দেশকে রক্ষায় দীর্ঘমেয়াদি কৌশল নির্ধারণ ও জরুরি ভিত্তিতে তা বাস্তবায়ন করা। বাংলাদেশ যদি চায়, তাহলে ভারতের সব পানি অস্ত্রকে অকার্যকর করা সম্ভব। সে জন্য দরকার একটি ‍সুদূরপ্রসারী মহাপরিকল্পনা। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে পারলে পদ্মা, তিস্তা, কুশিয়ারা, গোমতীর উজানে নির্মিত ভারতের সব ড্যাম ও ব্যারাজের ভবিষ্যৎ ক্ষতি থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব হবে। একই সঙ্গে যমুনা নদীর উজানেও ভারতের সম্ভাব্য ড্যামের ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে বাংলাদেশ।

সে জন্য বাংলাদেশে নদী ও খাল খননের এক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এর অংশ হিসেবে প্রথমেই পদ্মা ও পদ্মার মরে যাওয়া সব শাখা-প্রশাখা এমনভাবে খনন করতে হবে, যাতে সেগুলো ফারাক্কা-পূর্ব গভীরতা এবং আয়তন ফিরে পায়। একই সঙ্গে সারা দেশে অন্তত ৫০ বছরে যত নদী ও খাল মরে গেছে বা মৃতপ্রায়, সেগুলোও ৫০ বছর আগের গভীরতা এবং আয়তন অনুযায়ী খনন করতে হবে। খনন করতে হবে দেশের অন্য যেসব নদীতে চর সৃষ্টিসহ বিভিন্ন কারণে ভরাট ও সরু হয়ে গেছে, এর সব। দখলমুক্ত করতে হবে সব নদী, খাল ও জলাশয়।

পদ্মা, তিস্তা, সুরমা, কুশিয়ারসহ বাংলাদেশের উজানে ভারত যেসব নদীতে ড্যাম ও ব্যারাজ নির্মাণ করেছে, সেসব এলাকা প্রচণ্ড বৃষ্টিপ্রবণ। প্রতিবছর অতিবৃষ্টির কারণে ড্যাম ও ব্যারাজ থেকে ভারত অতিরিক্ত পানি ভাটিতে ছাড়তে বাধ্য হয়, যা বাংলাদেশে বন্যা সৃষ্টি করে। কিন্তু পদ্মাসহ মরে যাওয়া ও বিপন্ন এসব নদী, খাল, জলাশয় যদি ব্যাপকভিত্তিক খননের মাধ্যমে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনা যায়, তাহলে ভারত বর্ষাকালে যতই অতিরিক্ত পানি ছাড়ুক, বাংলাদেশে বন্যা হবে না। এসব নদী, খাল ও জলাশয় বিপুল পানি ধরে রাখতে সক্ষম হবে এবং অতিরিক্ত পানি বঙ্গোপসাগরে বয়ে নিয়ে যেতে পারবে। একইভাবে বর্ষাকালে এসব নদীতে জমা হওয়া পানি বছরের দীর্ঘ একটি সময় পর্যন্ত টিকে থাকবে, যা পরিবেশে রক্ষায়ও ভূমিকা পালন করবে। যেহেতু বর্ষাকালে ভারতকে পানি ছাড়তেই হবে, তাই আমাদের উচিত সেই পানিকে উপযুক্ত ব্যবহারের কৌশল গ্রহণ। একই সঙ্গে শুষ্ক মৌসুমে আন্তঃসীমান্ত সব নদীর পানির উপযুক্ত হিস্যা আদায়ে ভারতকে বাধ্য করার ব্যবস্থা করতে হবে।

চীনের সুপার ড্যাম বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য এখনো প্রকাশ করেনি চীন সরকার। এ বিষয়ে চীন সরকারের কাছে সব তথ্য দাবি করতে হবে বাংলাদেশকে। এরপর সে তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে তা বাংলাদেশের জন্য কোনো হুমকি বহন করে কি না। যদি তা বাংলাদেশের জন্য হুমকি হয়, তাহলে চীনকে বোঝাতে হবে কোনো দেশের ক্ষতি করে সেই দেশের সঙ্গে টেকসই সম্পর্ক উন্নয়ন করা যায় না। যেমন : ভারত বাংলাদেশের ক্ষতি করে, বাংলাদেশের মানুষকে শত্রু বানিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করতে পারেনি।

লেখক : সহকারী সম্পাদক, আমার দেশ

সূত্র, প্রথম আলো