মৌলিক মীমাংসার যে তত্ত্ব আমরা দিচ্ছি, সে পশ্চিমা অনুমোদনের দিকে না তাকিয়ে চিন্তার আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সে উচ্চারণ করে চিন্তার তত্ত্বগত স্বাধীনতা (theoretical autonomy) এবং জ্ঞান-উৎপাদনের ন্যায্যতা পুনরুদ্ধারের ডাক। আমরা প্রশ্ন করি- চিন্তা কখন বৈধ? যে জবাব হাজির আছে, সে বলে চিন্তা তখনই বৈধ, যখন সে স্বীকৃত হয়। আমরা বলি ভিন্ন কথা। চিন্তা তখনই বৈধ, যখন তা হয় সত্যনিষ্ঠ, ন্যায়ের অনুগামী, বাস্তবতার সাথে যুক্ত এবং অভ্যন্তরীণভাবে সুসংহত। একে বৈধতা দিতে পশ্চিমের স্বীকৃতি লাগবে না। কারণ, সত্য তার উৎস থেকেই স্বয়ংসম্পূর্ণ।

পরিচিতি ও সূত্রবিন্দু : মৌলিক মীমাংসা একটি জ্ঞানতাত্ত্বিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক প্রক্রিয়া, যা সমাজের চিন্তার বুনিয়াদকে পুনরায় যাচাই করে। সেটি করে ন্যায়-সত্য ও ঐতিহাসিক চেতনার আলোকে। সমাজ রূপান্তরের গভীর স্তর হিসেবে একে দেখা যেতে পারে। কারণ অর্থনীতি বা রাজনৈতিক পরিকাঠামোর পরিবর্তনই তার অন্বেষা নয়; বরং সে মানুষের জ্ঞান-দৃষ্টি, নৈতিক ধারণা ও ইতিহাস-ভাবনার একান্ত পরিবর্তনের সূত্রপাত ঘটায়।

page-top-ad

২. ধ্বংস ও নির্মাণের যুগপৎ প্রক্রিয়া : মীমাংসার ভাষা মৌলিক কিছু সওয়াল হাজির করে। সত্য কার? ইতিহাস কে লিখে? ভাষ্য কে নির্ধারণ করে? সওয়ালগুলো শুধু উচ্চারিত হবার জন্য নয়, দার্শনিক মামলা হিসেবে দাঁড়াবার জন্য। আধিপত্য সত্যকে নিজের মনে করে, ইতিহাসকে নিজের কলমে আকার দিতে চায় এবং সবার ভাষ্য হিসেবে নিজের ভাষ্যকে পাকা করে নেয়।

মীমাংসার ভাষা এই আধিপত্য ভাঙবে। একচ্ছত্রতাবাদী যুক্তির সে মোকাবেলা করবে। অপশ্চিমা সত্যকে পাশ্চাত্য একধরনের নির্দিষ্ট ধারণায় বন্দী রাখতে চায়। এই বলয়ও ভাঙতে হবে। দলীয় মতাদর্শে নির্মিত ইতিহাস ও জ্ঞানতত্ত্বের একচোখা ব্যাখ্যাও নস্যাৎ করতে হবে।

গঠন করতে হবে ন্যায়নিষ্ঠ ও ইতিহাস-সচেতন চিন্তার নতুন ভিত্তি। সে আকার দেবে বহুস্বরিক বয়ানের। পরিচয়ের বিকল্প পাঠ নির্মাণে সক্ষম হবে সে।

৩. মৌলিক মীমাংসার উদ্দেশ্য

ক. তাত্ত্বিক ভিত্তি পুনঃনির্ধারণ : তাত্ত্বিক ভিত্তি পুনঃনির্ধারণে কতিপয় প্রশ্নের জবাব পেতে হবে। যেমন সমাজ, রাষ্ট্র ও পরিচয় বলতে আদতে কী বোঝায়? যা বোঝায়, তাকে আমরা কিভাবে সত্য বলে জানি? এই হচ্ছে মৌলিকভাবে জ্ঞানতাত্ত্বিক ও চেতনতাত্ত্বিক সওয়াল। এ ধরনের সওয়ালের জবাব হকের ভিত্তিতে পুনর্বিবেচনা করতে হবে। এর মানে হলো- ক. প্রতিষ্ঠিত, কিন্তু অপার প্রশ্নহীন ধারণাগুলোর উৎস সন্ধান করে; খ. সত্য ও মিথ্যার পর্দা সরিয়ে; গ. চূড়ান্ত ন্যায়ের ভিত্তিতে নতুন করে জবাবের ভিত্তি নির্মাণ। তাত্ত্বিক ভিত্তির প্রয়োজনে আমাদেরকে পুরনো সওয়ালগুলো আবারো উচ্চারণ করতে হবে। যেসব সওয়ালের জবাব জানা বলে মনে করি, সেসব জানাকে আবারো পরীক্ষায় ফেলতে হবে। অতএব কে রাষ্ট্র তৈরি করে, কারা সমাজের সীমা নির্ধারণ করে, পরিচয় কি একটি আরোপিত, না স্বতঃস্ফূর্ত আত্মপ্রকাশ? ইত্যাদি প্রশ্নের জানা জবাবও ভেঙেচুরে পুনর্গঠন করতে হবে।

খ. ঐতিহাসিক সত্যের অনুসন্ধান : ইতিহাসবিষয়ক অন্তঃসারশূন্যতার বিরুদ্ধে এই অনুসন্ধান চলবে। এটি মূলত একধরনের দার্শনিক প্রতিবাদ। বিজয়ীর ভাষ্য, ইতিহাসকে একমাত্রিক করে তোলে, তা ইতিহাসকে সারবর্জিত বানিয়ে ফেলে। কারণ তার হাতে ইতিহাস হয়ে ওঠে ক্ষমতার প্রতিচ্ছবি। মৌলিক মীমাংসা এখানে ইতিহাসকে ‘বহুস্বরিক’ করতে চায়। যাতে উপেক্ষিত, চেপে-রাখা, অথবা নীরব কণ্ঠস্বরও ইতিহাস গঠন করে, কথা বলে। যাতে প্রান্তিক কণ্ঠস্বর মৌলিক সত্যের অংশ হিসেবে আপন জায়গা বুঝে নেয়।

গ. চিন্তার আজাদি পুনরুদ্ধার : এই আজাদি নিছক রাজনৈতিক বা অ্যাকাডেমিক নয়। এতে নিহিত আছে অন্তর্মুখী মুক্তি- যেখানে চিন্তা নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করে। ঔপনিবেশিক বয়ান থেকে মুক্তির মানে কী? কেবল ভূ-রাজনৈতিক ক্ষমতা থেকে সরে গেলেই কি এই মুক্তি হাসিল হয়? না। বরং যে পদ্ধতি, ভাষা ও শ্রেণিবিন্যাস আমাদের চিন্তাকে আকার দিয়েছে, তা থেকে উত্তরণের মধ্যেই নিহিত আছে সেই আজাদি। আত্মনির্ভর চিন্তা মানে নতুন উৎপত্তির অধিকার। এই অধিকার আমাদেরকে কর্তৃত্ববান করবে। ফলে নিজেদের ধরনে আমরা স্থির করব- আমরা কী নিয়ে চিন্তা করব, কিভাবে চিন্তা করব এবং কেমন ভাষা ও ভাষ্যে চিন্তা করব!

ঘ. বিকল্প ভাষা নির্মাণ : এই জায়গা সবচেয়ে জটিল। আবার সবচেয়ে মৌলিক। ভাষা কেবল যোগাযোগের মাধ্যম নয়। বরং সে বিশ্বদর্শনের বাহক। প্রচলিত শব্দাবলি এবং ব্যাখ্যাগুলো যে কাঠামোর ওপর দাঁড়িয়ে আছে, তা নিজের কারণেই পক্ষপাতদুষ্ট। ধারণাগত অর্থে আগ্রাসী। তার মানে বিকল্প ভাষা নির্মাণ জরুরি। বিকল্প ভাষা নির্মাণ মানে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি নির্মাণ। সে নিউ লেক্সিকনের ওসিলায় চিন্তার রাহা বদলায়। সে শোনে ‘উন্নয়ন’, ‘গণতন্ত্র’, ‘মানবাধিকার’ ইত্যাদি বুলি। সাথে সাথে এসবের অন্তর্নিহিত দর্শনকে সে প্রশ্ন করে। এগুলোর বিপরীতে এমন পরিভাষা গড়ে তোলে, যা স্থানিক, নৈতিক ও আত্মসঞ্জাত চিন্তা ধারণ করতে পারে।

এই চার উদ্দেশ্য সমবেতভাবে একটি দার্শনিক রূপান্তরের অভ্যুদয় ঘটাতে চায়। হয়ে ওঠে একটি মূলান্বেষী চিন্তাতত্ত্ব (foundational hermeneutics)। যেখানে নিজেকে বোঝার উপায় বদলানো হয়, নিজেকে বোঝার ভাষা বদলানো হয়, এমনকি বোঝা মানে কী- তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়। মৌলিক মীমাংসা এভাবেই এগোয়। সে কেবল একটি চিন্তা-প্রকল্প হয়ে বসে থাকে না। সে হয় একটি নতুন বাস্তবতার সম্ভাব্য ভাষ্য।

৪. মৌলিক মীমাংসার প্রধান ক্ষেত্রগুলো

মৌলিক মীমাংসা তৈরি করতে চায় দার্শনিক পরিভ্রমণের মানচিত্র। যেখানে জিজ্ঞাসা আবর্তিত হয় ইতিহাস, পরিচয় ও রাষ্ট্রের মতো পরিসরে। এগুলো অস্তিত্ববোধ, ন্যায়বিচার ও জ্ঞানচর্চার তলদেশে প্রবহমান থাকে। অন্তলোজিক্যাল জলধারার মতো। সেটি কিভাবে? ব্যাখ্যা করছি।

ক. ইতিহাসচিন্তা : ইতিহাস এখানে নিছক তথ্যের মহাফেজখানা নয়। ইতিহাস এখানে স্মৃতি, ক্ষমতা ও অর্থ-বিনির্মাণের একটি বহুস্তরবিশিষ্ট ফিল্ড। ইতিহাসচর্চাই একটি ডিসকার্সিভ ফর্মেশন। এখানে কোন কণ্ঠ উচ্চারিত হবে, কোনটি হবে না- তা নির্ধারণ করে দেয় ক্ষমতার কাঠামো। মৌলিক মীমাংসা ইতিহাসচিন্তাকে কিভাবে গ্রহণ করবে? তার কাছে ইতিহাস মানে তথ্যের পুনরাবৃত্তি নয়। ইতিহাসকে সে দেখবে অর্থ ও ব্যাখ্যার সংগ্রাম হিসেবে। সে টেলোলজিক্যাল ইতিহাসবোধ কবুল করে না। কারণ টেলোলজির কাছে ইতিহাস একরৈখিক অগ্রগতির ধারা। মীমাংসার দৃষ্টিতে ইতিহাস হলো একটি গিরিখাত- যেখানে কেবল বিজয়ীর আওয়াজ নয়, পরাজিতের নিঃশ্বাসও শ্রবণযোগ্য।

এই চিন্তা আমাদেরকে প্রথাগত দলীয় ইতিহাস বা ঔপনিবেশিক সময়রেখার বাইরে যেতে শেখায়। ক্ষমতাসীনরা ইতিহাসের নামে যা চাপিয়ে দেয়, তাকে না বলা ও প্রকৃত ইতিহাস হাজির করবার রসদ জোগায়। সে এমন এক সত্য অনুসন্ধান করতে বলে, যা ন্যায়ের সাথে সংলগ্ন, ক্ষমতার সাথে নয়। এই অর্থে ইতিহাসচিন্তা হলো একপ্রকার নৈতিক দর্শনচর্চা।

খ. পরিচয়বোধ : একেবারে মৌলিক অস্তিত্বগত প্রশ্ন থেকে পরিচয়ের শুরু। সেই প্রশ্নের নাম- কে আমি? হ্যাঁ, এখান থেকেই শুরু হবে আত্মসন্ধান। তবে ব্যাপারটা নিছক আত্মজিজ্ঞাসার নয়, বরং সাংস্কৃতিকও। একই সাথে রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে গভীরতর এক দার্শনিক সঙ্কটও। ধরেন ‘আমি কে’ প্রশ্নটির উত্তর স্থির করলেন বিদেশী প্রিজমে বা পশ্চিমা বয়ানের আলোকে। তখন কী ঘটে? তখন ‘আমি’টা বহিরাগত দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিবিম্বে পরিণত হয়। মৌলিক মীমাংসার দিক থেকে এতে আছে আত্মপরিচয়হীনতা, যা আত্ম-অস্তিত্বের অপহরণে পরিণত হয়েছে। কারণ স্বাধীন বিচারে আমি আমার আত্মপরিচয়ের উৎস তালাশ করব নিজস্ব ইতিহাস, অভিজ্ঞতা এবং ঈমানি আত্মবিশ্বাসের ভেতর।

এখানে পরিচয় মানে জাতীয়তা, ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতির অন্তর্গত রূপান্তরকে উপলব্ধি করা। বাইরে থেকে আরোপিত পরিচয়ে চলবে না, বরং অভ্যন্তরীণ আত্মবোধ থেকে তা হবে উৎসারিত। আত্ম-অস্তিত্ব হাজির করবে নিজের সাংস্কৃতিক ব্যাখ্যা। সে বলবে- আমি কেবল ‘আছি’ না, আমি আমার ‘থাকার অর্থ’ খুঁজে ফিরছি।

গ. রাষ্ট্রচিন্তা : রাষ্ট্রচিন্তা এখানে দার্শনিকভাবে নিরপেক্ষ কোনো প্রতিষ্ঠানগত চর্চা নয়। এ হচ্ছে এমন কাঠামোর অনুসন্ধান, যে কাঠামো শাসন দিয়ে নয়, ন্যায়বোধ নিয়ে গঠিত। রাষ্ট্র কি আইন প্রয়োগের সেই হাতিয়ার, যা মানুষের ওপরে আরোপ হয়? নাকি রাষ্ট্র হবে মূল্যবোধ ও হকের বহিঃপ্রকাশ, যা মানুষের অন্তর্গত আকাক্সক্ষা ও ন্যায়ের মোহনায় পরিণত হয়? মৌলিক মীমাংসা এমন এক চোখ দিয়ে রাষ্ট্রকে দেখে, যেখানে সে লেভিয়াথান নয়, আধিপত্যতত্ত্বের কাঠামো নয়। মৌলিক মীমাংসার দাবি হলো, রাষ্ট্র হবে কল্যাণ ও দায়বদ্ধ প্রতিষ্ঠান, যার গঠন ইরতিফাকাত (সহজাত প্রাকৃতিক বিকাশ)-এর ধারাবাহিকতায়। রাষ্ট্র হলো দায়বদ্ধ মানুষের সম্মিলিত নৈতিক চুক্তি।

এখানে প্রশাসনব্যবস্থা ঔপনিবেশিক কাঠামোর প্রতিলিপি হবে না। রাষ্ট্রচিন্তা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের বুনিয়াদে থাকবে ন্যায়, হক ও আত্মমর্যাদা। এ হচ্ছে নৈতিক রাষ্ট্রচিন্তা- যেখানে শাসনব্যবস্থার মূল স্তম্ভে থাকবে মকসুদ (সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য), মান এবং মাশরাফাত (সম্মানিত সত্তা)

৫. জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামো (Epistemic Order)

মৌলিক মীমাংসার চতুর্থ প্রধান ক্ষেত্র জ্ঞানতত্ত্ব। এ হচ্ছে সমগ্র চিন্তানির্মাণের ভিত্তিভূমি। এই স্তরে প্রশ্ন ওঠে : কাকে বলব জ্ঞান? যা জ্ঞান, তাকে আমরা কিভাবে জানি? কাদের জ্ঞানকে গ্রহণযোগ্য মানব? কোন বয়ান ‘তথ্য’? আর কোনটিকে বলব মতামত বা মিথ? জিজ্ঞাসাগুলো গুরুতর। নিছক তথ্যসূত্র বা তথ্যসূচক আলোচনায় তা আবদ্ধ নয়; বরং এগুলো গভীর দার্শনিক ও অস্তিত্বগত প্রশ্ন। জ্ঞানতাত্ত্বিক এই আলোচনা মূলত জ্ঞানের উপনিবেশায়নের সমালোচনা। কারণ মীমাংসার জন্য আমরা বিকল্প এক জ্ঞানতাত্ত্বিক মুক্তির ভিত্তি তালাশ করছি। এই আলাপের কিছু প্রশ্ন ও প্রসঙ্গকে আমরা বোঝার চেষ্টা করব।

কার জ্ঞান প্রামাণ্য?

সওয়ালটি মূলত ক্ষমতাতাত্ত্বিক। আধুনিক বিশ্বে প্রমাণ প্রমাণে নিহিত নয়, অনেকটা ক্ষমতায় নিহিত। এখানে জ্ঞানচর্চা গড়ে উঠেছে এমন কাঠামোতে, যেখানে ‘প্রামাণ্যতা’ নির্ধারিত হয় প্রধানত পশ্চিমা অ্যাকাডেমিয়ায়। মানে প্রমাণের বৈধতা ও স্বীকৃতি সেখান থেকে প্রবাহিত হয়। এটি ঠিক যে জ্ঞান নিরপেক্ষ থাকে কম। কারণ তা ক্ষমতার একটি রূপ। যে-জ্ঞান রাষ্ট্র, বিশ্ববিদ্যালয় বা আন্তর্জাতিক মঞ্চে স্বীকৃতি পেয়ে যায়, সে প্রভাব হাসিল করে। কেবল তার প্রামাণ্যতা ও যুক্তি দিয়েই সে প্রভাবশালী হয়ে যায় না; বরং পেছনে থাকা সামাজিক-রাজনৈতিক ক্ষমতাও তাকে বলীয়ান করে। এখান থেকেই ধরতে পারবেন বহু জিজ্ঞাসার জবাব।

পাহাড়ে বাস করা ধ্যানীর জীবনজ্ঞান কেন জ্ঞান নয়? গ্রামীণ নারীর চিকিৎসাজ্ঞান কেন স্বীকৃত হয় না? উপনিবেশিত সমাজের ঈমানভিত্তিক ইতিহাসবোধ কেন জ্ঞান হিসেবে প্রভাবক নয়? আমরা এই অন্যায়ের অবসান চাইব। আমাদের কাছে জ্ঞান কেবল ‘অবজেক্টিভ মেটা-ডাটা’ নয়। জ্ঞান হচ্ছে প্রতিটি সমাজের ভাষা, বিশ্বাস, অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতা থেকে উৎসারিত এক চেতনা। প্রামাণ্যতার পশ্চিমা ধারণা জ্ঞানকে শাসন করতে পারে না। কারণ প্রামাণ্যতার ধারণা যদি এককেন্দ্রিক হয়, তবে সেখানে ন্যায় বঞ্চিত হয়, অস্বীকৃতির কবলে পড়ে।

কার ভাষা ‘প্রকৃত’?

জ্ঞানতাত্ত্বিক দাসত্বের অন্যতম হাতিয়ার হচ্ছে ভাষা। কী বলা হলো, তা-ই নয়; বরং কোন ভাষায় বলা হলো, সেটিও আজ প্রামাণ্যতার মানদণ্ড। আজকের বিশ্বে যে জ্ঞান ইংরেজিতে বলা হলো, তা বেশি ‘বৈজ্ঞানিক’ বলে বিবেচিত; আর যে জ্ঞান স্থানীয় ভাষায় বলা হলো, তাকে ‘স্থানীয় অভিজ্ঞতা’ বলে গৌণ করা হয়। যেন সেটি অনুন্নত বা অসম্পূর্ণ।

একে আমরা বলছি ভাষিক উপনিবেশ। যেখানে একটি ভাষা বৈধতার দণ্ডবিধি হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ইংরেজি বা ফরাসি বা স্পেনিশ-জার্মান কেন হবে ন্যায্য হবার মানদণ্ড? অগ্রগণ্য বা বৈধ হবার বিচারপতি? বস্তুত যেখানে যে মানুষ যে ভাষায় ভাবেন, সেই ভাষার মধ্য দিয়েই তার বাস্তবতা গঠিত হয়। সেই ভাষাই তার সত্য ও জ্ঞান প্রকাশের অগ্রগণ্য, ন্যায়ভিত্তিক ও শ্রদ্ধাভাজন মাধ্যম। মৌলিক মীমাংসা এখানে একটি পরিকল্পিত ভাষাগত বিপ্লব চায়। নিজস্ব চিন্তাধারা, বিশ্বাস ও সংস্কৃতির আলোকে ভাষা নির্মাণ করতে হবে, যা কেবল অনুবাদ নয়, চর্বিতচর্বন নয়; বরং ধারণাগত বিকল্প তৈরির কাজ করে।

অনুমোদনহীন চিন্তার স্বীকৃতি

মৌলিক মীমাংসার যে তত্ত্ব আমরা দিচ্ছি, সে পশ্চিমা অনুমোদনের দিকে না তাকিয়ে চিন্তার আত্মমর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সে উচ্চারণ করে চিন্তার তত্ত্বগত স্বাধীনতা (theoretical autonomy) এবং জ্ঞান-উৎপাদনের ন্যায্যতা পুনরুদ্ধারের ডাক।

আমরা প্রশ্ন করি- চিন্তা কখন বৈধ? যে জবাব হাজির আছে, সে বলে চিন্তা তখনই বৈধ, যখন সে স্বীকৃত হয়। আমরা বলি ভিন্ন কথা। চিন্তা তখনই বৈধ, যখন তা হয় সত্যনিষ্ঠ, ন্যায়ের অনুগামী, বাস্তবতার সাথে যুক্ত এবং অভ্যন্তরীণভাবে সুসংহত। একে বৈধতা দিতে পশ্চিমের স্বীকৃতি লাগবে না। কারণ সত্য তার উৎস থেকেই স্বয়ংসম্পূর্ণ।

একটি ন্যায়ভিত্তিক জ্ঞানব্যবস্থার সম্ভাবনা

এই জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামোর চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো- একটি ন্যায়ভিত্তিক জ্ঞানব্যবস্থা গঠন করা, যেখানে জ্ঞানের বৈধতা নির্ধারিত হবে পারিপার্শ্ব, প্রজ্ঞা ও হকের ভিত্তিতে; ক্ষমতা ও অনুমোদনের ভিত্তিতে নয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি এমন এক বুদ্ধিবৃত্তিক দিগন্ত উন্মোচন করে, যেখানে চিন্তার সত্যতার স্বীকৃতি দেয়া হয় তার অন্তর্নিহিত ন্যায়ের কারণে, বাহ্যিক স্বীকৃতির কারণে নয়।

আমাদের বিচারে জ্ঞানতত্ত্ব কেবল চিন্তার এক শাখা নয়; বরং সে হচ্ছে চিন্তার নিজস্ব মর্যাদা, উৎস ও দিগন্ত নির্ধারণের সংগ্রাম। মৌলিক মীমাংসার জন্য আমরা তাই মৌলিক প্রশ্নের মুখোমুখি হই নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে। আমরা কেন ভাবি, কিভাবে ভাবি, কার অনুমোদনে ভাবি? প্রশ্নগুলোর জবাব মন্থন করে আমরা বলি- কোনো অনুমোদন ছাড়াও সত্য বলা যায়! এই দার্শনিক পুনর্নির্মাণ আমাদের চিন্তার জগতে একটি মুক্তিযুদ্ধের নামান্তর। এই পুনর্গঠনে আমরা কিভাবে আগাব? জ্ঞানচর্চায় আত্মনির্ভরতা, চিন্তার উপনিবেশ মুক্তি এবং নতুন দিগন্তের উন্মোচনে আমাদের কী হবে কর্মসূচি?

১. তথ্যের পুনর্পাঠ (Re-reading of Sources) : ইতঃপূর্বে ঔপনিবেশিক বা পশ্চিমা দৃষ্টিভঙ্গিতে পঠিত ঐতিহাসিক দলিল, আখ্যান ও নথিপত্রকে পুনরায় পাঠ করার প্রয়োজন রয়েছে। এখানে পুনর্পাঠ বলতে বুঝাচ্ছি-

ক. ঔপনিবেশিক ব্যাখ্যার ফ্রেম ভেঙে দিয়ে সেই তথ্যকে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে অনুধাবন করা।

খ. লোকায়ত ইতিহাস, বর্ণচ্যুত স্মৃতি, মৌখিক ইতিহাসের মতো গৌণ ও প্রান্তিক দলিলকে গুরুত্ব দেয়া।

গ. তথ্যের পুনর্বিন্যাস করে নতুন অর্থ উৎপাদনের পথ খোলা।

পুনর্পাঠের নমুনা হতে পারে ইতিহাসে উপস্থাপিত মুসলমান বা বাঙালি পরিচয়। তাকে কর্তৃপক্ষ হিসেবে হাজির বয়ান আকারে না দেখে আত্মপরিচয়ের গহিন থেকে দেখতে হবে। এখানে তথ্য নয়, তথ্যের পাঠই থাকবে মীমাংসার কেন্দ্রে।

২. নির্বিচারে অনুবাদ বর্জন : পশ্চিমা তাত্ত্বিকদের ধারণাগুলো আমাদের পাঠক্রমে, গবেষণায়, এমনকি আন্দোলনে প্রয়োগ হয়। ফুকো, দেরিদা, হ্যাবারমাস, মারকুস প্রমুখের ধারণাকে অনুবাদ করে হাজির করা হয়। তা অনেকসময় নকল ও পরাধীন চিন্তার জন্ম দেয়। এই কারণে জরুরি হলো-

ক. অন্ধ অনুবাদ বর্জন করে, নিজস্ব বাস্তবতা, ইতিহাস ও সঙ্কট থেকে সমান্তরাল ধারণা তৈরি করা।

খ. তাত্ত্বিক কাঠামো তৈরি করা, যা এই অঞ্চলের জীবনযাপন, ভাষা, ধর্মীয় চিন্তা ও অভিজ্ঞতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

৩. ভাষাগত স্বাধীনতা : চিন্তার স্বাধীনতা কেবল ভাবনা বা মতপ্রকাশে সীমাবদ্ধ নয়; বরং তা ভাষার মধ্য দিয়েই আকার হাসিল করে। ভাষা যদি পরাধীন হয়, চিন্তাও পরাধীন হয়। অতএব ভাষার ওপর নিয়ন্ত্রণ জরুরি। এই নিয়ন্ত্রণের মানে হলো-

ক. পরিভাষা নির্মাণে স্বকীয়তা।

খ. দাসত্বসূচক ভাষার বর্জন। যেমন : উন্নয়ন=development, যা প্রায়ই পশ্চিমের পথে এগোনোর অর্থ দেয়।

গ. নিজস্ব শব্দভাণ্ডার থেকে চিন্তার কাঠামো গঠন। কারণ ভাষাগত মুক্তির মাধ্যমে মানুষ কেবল ভাব প্রকাশ করে না, ভাব গঠনও করে।

৪. সাংস্কৃতিক আত্মনির্মাণ : সংস্কৃতি কেবল উৎসব বা ঐতিহ্য নয়। সংস্কৃতি হচ্ছে চিন্তার জৈবভূমি, জ্ঞানচর্চার উপাদান ও বোধের বুনিয়াদ। কিন্তু ঔপনিবেশিক আধিপত্য ও বিশ্বায়নের নামে সংস্কৃতি আজ ‘দর্শনীয় পণ্যে’ পরিণত হয়েছে। এর ফলে চিন্তার প্রাণহীন অনুরণন হয়, নতুন কিছু তৈরি হয় না। অতএব মৌলিক মীমাংসার জন্য সাংস্কৃতিক আত্মনির্মাণ জরুরি। সাংস্কৃতিক আত্মনির্মাণের মানে হলো-

ক. নিজস্ব সংস্কৃতির ব্যাকরণ থেকে জ্ঞানচর্চার ভিত্তি গড়ে তোলা।

খ. ধর্ম, নৈতিকতা, উৎসব, নান্দনিকতা, লোকজতার মতো উপাদানকে চিন্তার জৈবভূমি হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।

গ. সংস্কৃতিকে অনুগ্রহ নয়; বরং চিন্তার অধিকার হিসেবে দেখা।

এই চারটি কার্যপদ্ধতি একত্রে মীমাংসামূলক জ্ঞানচর্চার পথ তৈরি করে, যেখানে আমদানি করা চিন্তার অবসান ঘটে এবং আত্মজ জ্ঞানভিত্তিক সভ্যতার বীজ রোপণ হয়।

এ কেবল পদ্ধতি নয়- একটি প্রতিরোধ, একটি সৃষ্টি, একটি নবযাত্রা।

লেখক : কবি, সাহিত্যিক

সূত্র, নয়া দিগন্ত