বাংলাদেশের প্রথিতযশা পরমাণুবিজ্ঞানী, বরেণ্য শিক্ষাবিদ, বহুমুখী জ্ঞানসাধক ও ইসলামি চিন্তাবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মাদ শমশের আলী ২ আগস্ট, ২০২৫ রাতের শেষ প্রহরে ইন্তেকাল করেছেন। তার এই চিরবিদায়ে এদেশের বিজ্ঞান ও শিক্ষা জগতে বিরাট এক শূন্যতার সৃষ্টি হলো। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে বিজ্ঞানের প্রসার এবং শিক্ষাক্ষেত্রে তার অসামান্য অবদান তাকে আসীন করেছে গভীর শ্রদ্ধা ও সম্মানের আসনে। তার কর্মময় জীবন ও কীর্তিকে স্মরণ করে আমরা তার প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।
১৯৩৭ সালের নভেম্বর মাসে কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা শহরে জন্মগ্রহণ করেন এম শমশের আলী। তার পৈতৃক বাড়ি ছিল যশোরের বসুন্দিয়া গ্রামে। বাবা আমীর আলী ছিলেন রেলওয়ের কর্মকর্তা। তার শৈশব কেটেছে চুয়াডাঙ্গা, ভারতের রানাঘাট এবং নিজ জেলা যশোরে। শমশের আলীর শিক্ষাজীবনের শুরু চুয়াডাঙ্গার এক বিদ্যালয়ে।
দেশভাগের পর যশোর জিলা স্কুলে ভর্তি হয়ে ১৯৫৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হন। মেধাবী শমশের আলী স্কুল ও কলেজ জীবনে সব পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে পাস করেছেন। রাজশাহী কলেজ থেকে ১৯৫৬ সালে ইন্টারমিডিয়েটে (বিজ্ঞান) উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন এবং ১৯৫৯ সালে স্নাতক সম্মান ও ১৯৬০ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। অবশ্য স্নাতকোত্তর পরীক্ষার ফল প্রকাশের আগেই তিনি পাকিস্তান পরমাণু শক্তি কমিশনে বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা পদে যোগ দিয়েছিলেন।
এ সময় শমশের আলী কমনওয়েলথ স্কলারশিপসহ কয়েকটি আন্তর্জাতিক বৃত্তি লাভ করেন। পরমাণু পদার্থবিজ্ঞানে উচ্চতর গবেষণার আকাঙ্ক্ষা থেকে ১৯৬১ সালে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর আবদুস সালামের পরামর্শে তিনি যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ে যান। সেখানে কিংবদন্তি পদার্থবিজ্ঞানী লর্ড ব্রায়ান ফ্লাওয়ার্স ও স্যার স্যাম অ্যাডওয়ার্ডসের তত্ত্বাবধানে গবেষণা সম্পন্ন করে ১৯৬৫ সালে তাত্ত্বিক পারমাণবিক পদার্থবিদ্যায় পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর দেশে ফিরে তিনি পাকিস্তান (পরে বাংলাদেশ) পরমাণু শক্তি কমিশনে গবেষণা কর্মে নিয়োজিত হন। ১৯৬৫ সালে তিনি ঢাকা পরমাণু শক্তি কেন্দ্রে সিনিয়র সায়েন্টিফিক অফিসার হিসেবে নিয়োগ পান। কর্মদক্ষতা ও নেতৃত্বের যোগ্যতার কারণে ১৯৭০ সালে তাকে পরমাণু শক্তি কেন্দ্রের পরিচালক পদে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত তিনি সফলতার সঙ্গে এ পদে দায়িত্ব পালন করেন।
ড. শমশের আলী গবেষক হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেন তার গভীর তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও সৃষ্টিশীল চিন্তাশক্তির মাধ্যমে। তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানে বিশেষত পারমাণবিক ভৌতবিজ্ঞানে তার মৌলিক গবেষণা আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও সমাদৃত হয়েছে। বিশ্বের স্বনামধন্য বৈজ্ঞানিক জার্নালগুলোয় তার অসংখ্য গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশনের গবেষণা কর্মকাণ্ডকে এগিয়ে নিতে তিনি প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা হিসেবে ১৯৭৫-৮২ পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এভাবে টানা ২১ বছর (১৯৬১-৮২) তিনি পরমাণু শক্তি কমিশনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দেশে পরমাণু গবেষণার ভিত সুদৃঢ় করতে অমূল্য ভূমিকা রেখেছেন।
পারমাণবিক পদার্থবিদ্যায় তার মৌলিক গবেষণা ও অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৭৩ সালে তাকে সম্মানসূচক ‘অনারারি প্রফেসর’ পদবি প্রদান করে। পারমাণবিক পদার্থবিজ্ঞানে মৌলিক অবদানের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ১৯৭৪ সালে ড. শমশের আলীকে হরি প্রসন্ন রায় স্বর্ণপদক প্রদান করে। ১৯৮২ সালে ড. শমশের আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ২০০৬ সালে অবসর গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত অসংখ্য মেধাবী শিক্ষার্থীকে তিনি বিজ্ঞানচর্চায় অনুপ্রাণিত করেছেন। শিক্ষক হিসেবে তার সুনাম ছিল জটিল বৈtজ্ঞানিক ধারণাগুলো সহজভাবে উপস্থাপনার দক্ষতার জন্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনারত অবস্থায় ১৯৯২ সালে সরকারি উদ্যোগে বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তিনিই এর প্রতিষ্ঠাতা ভিসি হিসেবে নিয়োগ পান। শমশের আলী বিশ্ববিদ্যালয়ে সফলভাবে দূরশিক্ষণ পদ্ধতির শিক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তন করেন। ১৯৯৬ পর্যন্ত বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালনকালে দূরশিক্ষার নীতিমালা ও কাঠামো দৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করতে তার ভূমিকা ছিল অনন্য। তিনি চলতি বছরের ১৮ ফেব্রুয়ারি ‘প্রফেসর ইমেরিটাস’ পদে যোগ দেন।
২০০২ সালে সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটিতে প্রতিষ্ঠাতা ভিসি হিসেবে যোগ দেন। মাত্র ছয় বছরের মধ্যে তিনি এটাকে ১২ হাজারের বেশি শিক্ষার্থীর বিদ্যাপীঠে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হন। ২০১০ সাল পর্যন্ত সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির ভিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করে তিনি প্রতিষ্ঠানটিকে মানসম্মত উচ্চশিক্ষার ধারায় এগিয়ে দেন।
দেশের বিজ্ঞান উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির সঙ্গেও ড. শমশের আলীর নাম অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে। ২০০৪ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমির নির্বাচিত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় তিনি এশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিজ্ঞান একাডেমি ও সংস্থার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন।
অধ্যাপক শমশের আলী সাধারণ মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করে তোলা এবং বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার মধ্যে সেতুবন্ধ রচনা করেছিলেন। ষাটের দশক থেকেই তিনি গণমাধ্যমে বিজ্ঞানবিষয়ক আলোচনা ও অনুষ্ঠান উপস্থাপনার পথে যুক্ত হন। বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং রেডিও বাংলাদেশে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক নানা সিরিজ অনুষ্ঠানে তিনি সহজ ভাষায় বৈজ্ঞানিক ধারণা ব্যাখ্যা করে জনসাধারণকে বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট করেন। এমনকি বিবিসি রেডিওতেও বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সম্পর্কিত কর্মসূচিতেও তিনি বক্তব্য দিয়েছেন।
বিজ্ঞান শিক্ষার প্রসারে তার বিশেষ আগ্রহ ছিল। তিনি দেশের বিভিন্ন বিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গিয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। গণিতকে ভীতি নয়, বরং আনন্দের বিষয় করে তোলার জন্য তিনি ‘Making Math Fun’ (গণিতকে মজাদার করার কৌশল) শীর্ষক ইংরেজি গ্রন্থসহ একাধিক বই রচনা করেছেন। তার লেখনীতে জটিল গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানের বিষয়গুলোও সহজবোধ্য ভাষায় উপস্থাপিত হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের কাছে জ্ঞানার্জনকে আনন্দময় করে তুলেছে।
বিজ্ঞান ও ধর্মের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনে শমশের আলীর চিন্তা ও কর্ম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বিশ্বাস করতেন যে বিজ্ঞান ও মানবসভ্যতার আধ্যাত্মিক মূল্যবোধ পরস্পরের পরিপূরক এবং সত্যিকার ধর্মচর্চা শুধু উপাসনায় নয়, জ্ঞান অনুসন্ধান ও মানবকল্যাণে উৎসর্গ হওয়া উচিত। সত্তরের দশক থেকেই তিনি কোরআনসহ বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে উল্লিখিত জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পর্কিত উপাদান নিয়ে আগ্রহী হয়ে ওঠেন।
তার নেতৃত্বে কয়েকজন বিজ্ঞানী মিলে দীর্ঘ পাঁচ বছর গবেষণা করে ‘পবিত্র কোরআনে বৈজ্ঞানিক ইঙ্গিত’ নামে একটি প্রবন্ধ সংকলন প্রস্তুত করেন, যা ১৯৯০ সালে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। তা ছাড়া মুসলিম সভ্যতার স্বর্ণযুগে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে যে অসামান্য অগ্রগতি অর্জিত হয়েছিল, তা এদেশের নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে সহকর্মীদের নিয়ে তিনি ‘মুসলিম কন্ট্রিবিউশন টু সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’ নামে আরেকটি গবেষণা গ্রন্থ প্রণয়ন করেন, যা ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয়।
এছাড়া তিনি আধুনিককালের বহু প্রাসঙ্গিক বিষয়ে বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় বই ও প্রবন্ধ লিখেছেন, যার মধ্যে ‘ব্রেইন টুইস্টার : ডিলাইটফুল ম্যাথমেটিকস’ এবং ‘আলাদিন্স রিয়াল ল্যাম্প (সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি)’ উল্লেখযোগ্য। বিজ্ঞানকে জনপ্রিয় করা এবং বিজ্ঞান-সংস্কৃতির মেলবন্ধন ঘটানোর জন্য ১৯৯০ সালে তিনি ইতালিভিত্তিক তৃতীয় বিশ্ব বিজ্ঞান সংস্থা টিডব্লিউএনএসওর পাবলিক আন্ডারস্ট্যান্ডিং অব সায়েন্স পুরস্কার লাভ করেন। তিনি বাংলা একাডেমির সম্মানিত ফেলো এবং ইসলামিক ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্সেসসহ (আম্মান) অসংখ্য বিজ্ঞান সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
বিজ্ঞান ও শিক্ষা ক্ষেত্রে বহুমুখী ভূমিকার জন্য তাকে ২০০৫ সালে খান বাহাদুর আহছানউল্লাহ স্বর্ণপদক এবং মাদার তেরেসা স্বর্ণপদকসহ বহু জাতীয় সম্মাননায় ভূষিত করা হয়। ২০০৯ সালে কুয়ালালামপুরে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি লিডারশিপ কলোকিয়ামে তাকে উচ্চশিক্ষা নেতৃত্বে আজীবন সম্মাননা দেওয়া হয়। তিনি দি ওয়ার্ল্ড একাডেমি অব সায়েন্সের ফেলো নির্বাচিত হন। তিনি বাংলাদেশ একাডেমি অব সায়েন্স, বাংলাদেশ ফিজিক্যাল সোসাইটি, বাংলা একাডেমির ফেলোসহ বিভিন্ন সংস্থা ও সংগঠনে আজীবন সদস্য পদ লাভ করেছিলেন।
অধ্যাপক শমশের আলীর জীবন ছিল দেশের বিজ্ঞান শিক্ষা ও গবেষণার উন্নয়নের প্রতি নিবেদিত। জাতীয় শিক্ষাক্রম প্রণয়ন থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ পরামর্শ দিয়েছেন। বিজ্ঞান ও গণিত শিক্ষায় কীভাবে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। বিজ্ঞানকে জনমুখী করতে স্কুলপর্যায়ে বিজ্ঞান ক্লাব আন্দোলন, বিজ্ঞান মেলা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও তিনি উৎসাহ দিয়েছেন।
অধ্যাপক শমশের আলীর পরিকল্পনা ও উদ্যোগে দেশে প্রথম শুরু হওয়া ওপেন এবং দূরশিক্ষা পদ্ধতি উচ্চশিক্ষা গ্রহণের দ্বার সাধারণ মানুষের জন্য প্রসারিত করেছে। তার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দেশের সব স্তরের মানুষের কাছে শিক্ষা পৌঁছে দেওয়া। যারা প্রথাগত বা প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থায় অংশ নিতে পারেন না, তাদের জন্য একটি বিকল্প সুযোগ তৈরি করে দেওয়া। এটি যেকোনো বয়সের মানুষকে, তাদের পেশা বা অবস্থান নির্বিশেষে পড়াশোনার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল।
অধ্যাপক ড. শমশের আলীর ইন্তেকালে বাংলাদেশ এক বিশাল মনীষীকে হারাল। বিজ্ঞান গবেষণা, শিক্ষা প্রশাসন, বিজ্ঞান-সংস্কৃতি সংযোগ ও ধর্মীয় ভাবনার পরিশীলনে তার মতো বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ব্যক্তিত্ব দেশে বিরল।
লেখক : ভিসি, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়