সারা পৃথিবীতে ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কাজ করে একমাত্র কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কিন্তু শুধু বাংলাদেশেই বাংক খাত নিয়ন্ত্রণ করে দুটি সংস্থা, অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ (এফআইডি)। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ ব্যাংক অনেকটাই আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের ইউনিট অফিস হিসেবে কাজ করতে বাধ্য হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংক পূর্ণ স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হয়েও স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেনি। বাংলাদেশ ব্যাংককে ক্ষমতাহীন এবং এফআইডির অধীন করে রাখা হয়েছে।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের একসময় নাম ছিল ব্যাংকিং বিভাগ। ১৯৯৪ সালে বিএনপি সরকারের শেষ দিকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন প্রথমবারের মতো ব্যাংকিং বিভাগ চালু করা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের দুই বছরের মাথায় ১৯৯৮ সালে ব্যাংকিং বিভাগ বাতিল করা হয়। এটি হয় ব্যাংকিং অনুবিভাগ। এরপর ২০০৯ সাল পর্যন্ত এটি অনুবিভাগ হিসেবে কাজ করে। এক যুগ পর আবার আওয়ামী লীগ সরকারই নতুন করে এ বিভাগ ফিরিয়ে আনে। ২০১০ সালের ৬ জানুয়ারি অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠন করা হয় নতুন বিভাগ, যার নাম দেওয়া হয় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ। গঠনের এক মাস পর, অর্থাৎ ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিনিধিদল সচিবালয়ে বৈঠক করে জানিয়ে গিয়েছিল, বিভাগটি গঠিত হওয়ার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ক্ষমতা খর্ব হবে বলে তাদের আশঙ্কা।

কাতার ও আল জাজিরা কেন ইসরাইলি মিডিয়ার টার্গেট?কাতার ও আল জাজিরা কেন ইসরাইলি মিডিয়ার টার্গেট?

বাংলাদেশ ব্যাংকের কার্যক্রম পরিচালনার জন্য ১৯৭২ সালে জারি করা হয় বাংলাদেশ ব্যাংক অর্ডার। বিদ্যমান আইন অনুযায়ী, ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে যেকোনো নির্দেশনা দেওয়া বাংলাদেশ ব্যাংকের কাজ। এটি দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা, যার মাধ্যমে একটি স্বায়ত্তশাসিত ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের নিজেই তার সব কার্যক্রম পরিচালনা করার কথা।

অভিযোগ উঠেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকাণ্ডে নানা ধরনের প্রভাব বিস্তার করে এফআইডি। যত অনৈতিক তদবির বাণিজ্য, এ বিভাগ থেকেই সেগুলোর উদ্ভব হয়। ব্যাংক খাতের অনিয়ম এখান থেকে পরিচালিত। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর চেয়ারম্যান, পরিচালক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দিয়ে থাকে এ বিভাগ। এমনকি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি এবং নির্বাহী পদায়ন করা হয় এ বিভাগ থেকেই। অথচ এ কাজগুলো করার কথা ছিল বাংলাদেশ ব্যাংকের। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর পরিচালনা পর্ষদে রাজনৈতিক নেতা ও বিতর্কিত ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার সুপারিশ এ বিভাগ থেকেই করা হয়। বিগত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও স্বেচ্ছাসেবক লীগের পাশাপাশি জাতীয় পার্টির নেতাদের রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোর পরিচালক বানিয়ে লোপাটের স্বর্গরাজ্য করা হয়েছিল। বিগত দেড় দশকে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক বিবেচনায় সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হতো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ থেকে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এবং দলীয় আজ্ঞাবহদের ব্যাংক খাত থেকে অনৈতিক সুবিধা দিতে এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে প্রভাবিত করা হয়। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক তার স্বকীয়তা ভেঙে ব্যাংক খাতের স্বার্থবিরোধী নানা রকম সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান শেখ আবদুল হাই বাচ্চুসহ ব্যাংক খাত ধ্বংস করার জন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের কারিগর হিসেবে এফআইডিকেই মনে করা হয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের অনেক অনিয়ম-দুর্নীতি বিশেষ করে পরিচালক পর্ষদের অনিয়ম-সংক্রান্ত তথ্য বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরে এলেও সরাসরি হস্তক্ষেপ করার সুযোগ থাকে না এবং অনেকটা অসহায়ের মতো পর্যবেক্ষণ করতে হয়, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

২০২৩ সালে অর্থনীতিবিদ বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ একটি পত্রিকায় সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ব্যাংকিং সেক্টরের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে অভ্যন্তরীণ সুশাসনের অভাব। তিনি বলেছিলেন, ব্যাংকিং সেক্টরে এক ধরনের দ্বৈত শাসন চলছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকের ক্ষেত্রে যতটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারে, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ক্ষেত্রে তা পারে না। রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের ক্ষেত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ডিভিশন নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। এতে ব্যাংকগুলো সঠিকভাবে পরিচালনার ক্ষেত্রে সমস্যা সৃষ্টি হয়। ব্যাংক তা রাষ্ট্রায়ত্তই হোক আর ব্যক্তিমালিকানাধীন হোক, একক প্রতিষ্ঠান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হওয়া উচিত। সে সময় তিনি আরো বলেছিলেন, বর্তমানে ব্যাংকিং সেক্টর যেভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তাকে কার্যত দ্বৈত শাসন বলা যেতে পারে। একটি সেক্টরের ওপর দ্বৈত নিয়ন্ত্রণ কোনোভাবেই ভালো ফল দিতে পারে না। ব্যাংকিং সেক্টরের মতো স্পর্শকাতর একটি সেক্টর একক নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হওয়া উচিত। একক নিয়ন্ত্রণে ব্যাংক পরিচালিত না হলে নানা সমস্যা ও জটিলতা দেখা দিতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক হয়তো কোনো ইস্যুতে আপত্তি করেছে, কিন্তু ব্যাংকিং বিভাগ সেই আপত্তি উপেক্ষা করে অনুমোদন দিয়েছে। সর্বশেষ যখন ৯টি ব্যাংক ব্যক্তিমালিকানায় অনুমোদন দেওয়া হয়, তখন বাংলাদেশ ব্যাংক আপত্তি উত্থাপন করেছিল। কিন্তু অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে অনুমোদন দেওয়া হয়। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে সব সময়ই দেশের আর্থসামাজিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অনুমোদন দান এবং কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ দেওয়া উচিত।

আওয়ামী আমলে একই পরিবার থেকে তিনজন পরিচালক নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়েছে এবং তাদের মেয়াদকাল ১২ বছর করা হয়েছে, যা এখনো বহাল আছে। এটি অদ্ভুত একটি নীতিমালা। এর মাধ্যমে ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকে পরিবারতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পাহাড় সৃষ্টি, ব্যাপক আকারে অর্থ লোপাট, পাচার, অযোগ্য ও দুর্নীতিপরায়ণ গভর্নর নিয়োগ এবং গভর্নরদের সরাসরি হস্তক্ষেপের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংককে নিষ্ক্রিয় করে রাখার যে সংস্কৃতি চালু করা হয়েছিল, সেজন্য এফআইডি যথেষ্ট ভূমিকা পালন করছে।

ব্যাংক খাতে অলিগার্ক শ্রেণি তৈরি হয়েছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের মাধ্যমে। অলিগার্ক শ্রেণি পুঁজি লুণ্ঠন করেছে এবং পুঁজি পাচার করেছে। অর্থনৈতিক অবদানে সহযোগিতার জন্য ব্যাংকিং খাতে বিশদ কাঠামোগত সংস্কার করা দরকার। এর আগে শুধু রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার সাধন করা হয়নি। দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বর্তমান অন্তর্বর্তীকালন সরকার ব্যাংক খাতে সংস্কার কার্যক্রম শুরু করেছে। দেশের মানুষ তাকিয়ে আছে ব্যাংক খাতে আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারের মাধ্যমে একটি স্থায়ী সুশাসন ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য। আমরা আশা করি, কেন্দ্রীয় ব্যাংককে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত শক্তিশালী প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলা হবে। আর্থিক খাতের সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হলে এবং এ খাতের ভিত মজবুত করতে হলে আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগকে (এফআইডি) স্থায়ীভাবে বিলুপ্ত করা উচিত।

লেখক : ব্যাংক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক এবং ‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বৈদেশিক বিনিময় ও অর্থায়ন গ্রন্থের লেখক

সূত্র, আমার দেশ