বাংলাদেশের রপ্তানি অর্থনীতির প্রাণ নিঃসন্দেহে তৈরি পোশাক (আরএমজি) খাত। দেশের পণ্যরপ্তানির ৮০ শতাংশেরও বেশি আসে আরএমজি থেকে; এই খাতে প্রত্যক্ষভাবে লাখ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যাদের অধিকাংশই নারী। ফলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো বড় বাজারে শুল্কনীতির সামান্য পরিবর্তনও বাংলাদেশের উৎপাদন, কর্মসংস্থান, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন ও সামাজিক স্থিতিশীলতায় ঢেউ তোলে।
২০২৫ সালে মার্কিন প্রশাসনের ‘রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ’ নীতির আওতায় বিভিন্ন দেশের ওপর অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ—এবং তার ধাপে ধাপে সমন্বয় বাংলাদেশের জন্য নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে। এই প্রবন্ধে ট্যারিফ কমা-বাড়ার ফলে চাহিদার সম্ভাব্য পরিবর্তন, বাংলাদেশের জোগান দেওয়ার সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা, যেমন জ্বালানি সংকট, বন্দরজট, শ্রম ও কাঁচামালের চ্যালেঞ্জ এবং সেগুলো থেকে উত্তরণের কর্মপন্থা নির্ধারণ করা হবে।
প্রি-ট্রাম্প যুগে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকে যুক্তরাষ্ট্রে গড় মোস্ট ফেওয়ার্ড নেশন (এমএফএন) শুল্কহার ঐতিহাসিকভাবে উচ্চ ছিল; অনেক ক্যাটাগরিতে ১৫-১৭ শতাংশের কাছাকাছি, কিছু আইটেমে ৩০ শতাংশেরও বেশি। বাংলাদেশ ২০১৩ সাল থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের জিএসপি সুবিধা স্থগিত রয়েছে; ফলে রেডিমেড গার্মেন্টসের মতো প্রধান পণ্যগুলোয় শুল্কছাড় পাওয়া যায়নি। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট রপ্তানি প্রায় ৪৮ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হলেও, আরএমজি খাতের বিশ্ববাজারে দোলাচল ছিল। যুক্তরাষ্ট্র বাজারে ২০২৪ সালে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি মূল্য ৭ দশমিক ৩৪ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৩ সালের তুলনায় মাত্র শূন্য দশমিক ৭৫ শতাংশ বৃদ্ধি। এই প্রেক্ষাপটেই ২০২৫ সালের রিসিপ্রোকাল ট্যারিফ এসে নতুন হিসাব কষতে বাধ্য করেছে শিল্পকে।
২০২৫ সালের এপ্রিলে ঘোষিত নতুন নীতিতে ‘বেস’ বা সর্বজনীন ট্যারিফ এবং দেশভেদে ‘রেসিপ্রোকাল’ অতিরিক্ত শুল্কের সমন্বয় দেখা যায়। এর মধ্যে চীনের ৩০ শতাংশ, ভারতের ৫০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয় আর বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম শ্রেণিতে ২০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক ধার্য হয়। ফলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাকে কার্যকর মোট শুল্কহার দাঁড়ায় প্রায় ৩৭ শতাংশ (আগের এমএফএন ১৭ শতাংশ + নতুন ২০ শতাংশ)। এই গাণিতিক বাস্তবতা মূল্য-চাহিদা-সরবরাহের সমীকরণকে পাল্টে দিচ্ছে। বাংলাদেশের কস্ট টু আমেরিকান বায়ারর্স তীব্রভাবে বেড়ে গেছে, যা মূল্যসাড়া-সংবেদনশীল সেগমেন্টে ডিমান্ডকে চাপে ফেলতে পারে; আবার একই সঙ্গে প্রতিযোগীদের কারো কারো ওপর আরো উচ্চ শুল্ক বাংলাদেশের তুলনামূলক অবস্থানকে কিছু ক্যাটাগরিতে সুদৃঢ়ও করতে পারে। যেমন : ভারতের (৫০ শতাংশ) ও বাংলাদেশের ‘হেড টু হেড’ প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ তুলনামূলকভাবে কম ট্যারিফের সুবিধা পাচ্ছে।
অবশ্য, ট্যারিফ পার্থক্যই সবকিছু নয়। ভিয়েতনাম বহু বছর ধরে যুক্তরাষ্ট্রে বড় সোর্সিং-হাব, যেমন উৎপাদন দক্ষতা, কমপ্লায়েন্স, দ্রুত লিডটাইম, গভীর শিল্প-সরবরাহ শৃঙ্খলা ও বন্দর দক্ষতায় তাদের অগ্রগামিতা আছে। ২০১৮-২১ সময়ে চীনের ওপর সেকশন-৩০১ ট্যারিফ বাড়ার পর ভিয়েতনাম সবচেয়ে বেশি শেয়ার কুড়িয়েছে। ২০২৫ সালের রিসিপ্রোকাল ২০ শতাংশ ভিয়েতনাম-বাংলাদেশ উভয়ের জন্য ‘লেভেলিং’ আনলেও, অপারেশনাল দক্ষতার ব্যবধান থাকায় ভিয়েতনাম এখনো অনেক ব্র্যান্ডের প্রথম পছন্দ। অতএব, বাংলাদেশের ট্যারিফ সুবিধা যদি ভিয়েতনামের তুলনায় সমতা পর্যায়ে থাকে, তবে নন-ট্যারিফ প্রতিযোগিতাগুলোই (লিডটাইম, কোয়ালিটি, কমপ্লায়েন্স, বন্দর ও এনার্জি) নির্ণায়ক হয়ে উঠবে। এদিকে, তুরস্কের ১৫ শতাংশ অতিরিক্ত হার থাকলেও তাদের ইউরোপমুখী ভৌগোলিক সুবিধা ট্রেন্ড যুক্তরাষ্ট্রে ততটা প্রযোজ্য নয়; ফলে মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ তুলনামূলক কম। চীনের ৩০ শতাংশ অতিরিক্ত শুল্ক, বিদ্যমান শুল্কসহ তাদের খরচ আরো বাড়িয়েছে। এই জটিল পটভূমিতে বাংলাদেশের জন্য সুযোগ হলো ভারত থেকে ফ্রি হওয়া কিছু অর্ডার ‘ক্যাপচার’ করা; চীন ও ভিয়েতনামের উচ্চমার্জিন কাজের বাইরে ‘ভ্যালু-মিড’ সেগমেন্টে প্রাইস-কোয়ালিটির ভারসাম্য দিয়ে প্রবেশ জোরদার করা। তবে সতর্কতা হলো, বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে এমএফএন বেস-হার ভিন্ন, তার ওপর দেশভিত্তিক অতিরিক্ত হার বসে। তাই প্রোডাক্ট-মিক্স বদল করে ‘ইফেকটিভ ট্যারিফ’ কমানোর কৌশল প্রাসঙ্গিক।
শুল্ক বাড়লে আমদানিকারকের খরচ বাড়ে। তবে, কখনো রিটেইলার নিজে খরচ শোষণ করে, কখনো দাম বাড়িয়ে কনজিউমারের ওপর চাপায়, কখনো সোর্সিং দেশ বদলায়। ইতোমধ্যে অনেক বড় রিটেইলাররা ২০২৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধে ট্যারিফের কারণে দাম কিছুটা বাড়ানোর কথা বলেছে; ফলে লো-মিড ভ্যালু সেগমেন্টে ডিমান্ড কিছুটা সংকুচিত হতে পারে। ২০২৫ সালের শুরুতে বাংলাদেশ-মার্কিন পোশাক রপ্তানি আগের বছরের তুলনায় ২৬ শতাংশ বেড়েছিল। এতে প্রমাণিত হয়, নীতিঝাঁকুনির মধ্যেও আমেরিকান বায়াররা বাংলাদেশের ব্র্যান্ডগুলোর সক্ষমতা যাচাই করে নতুন অর্ডার দিয়েছে। তবে জুলাই-অগাস্টে উচ্চ ট্যারিফ রেজিম স্থায়ী হওয়ার পর অর্ডার বুকিংয়ের গতি পরবর্তী কোয়ার্টারগুলোয় পুনর্মূল্যায়ন হতে পারে।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে আনুমানিক ৩ হাজার ৫০০ কারখানা সক্রিয়, যেখানে প্রায় ৪০ লাখ শ্রমিক নিয়োজিত। তবে ২০২৪-২৫ সময়ে কিছু কারখানা বন্ধ-খোলা মিলিয়ে কিছু পরিবর্তন ঘটেছে; ফলে ৯৬ হাজারের বেশি শ্রমিক ছাঁটাইয়ের তথ্য এসেছে। এরই পরিপ্রেক্ষিতে পণ্যের চাহিদা থাকলে দ্রুত লাইন-শিফট বাড়িয়ে জোগান বাড়ানোর রেকর্ড যেমন বাংলাদেশের রয়েছে, তেমনি শক এলে সংকোচনও করতে পারে। পাশাপাশি ডিজিটাল ম্যাপিং অনুসারে দেশের কারখানার মধ্যে মাত্র ২ হাজার ৭২০টি বিজিএমইএ বা বিকেএমইএ সদস্যভুক্ত; অন্যরা সদস্যভুক্তির না হওয়ায় সরবরাহ শৃঙ্খলায় স্বচ্ছতার প্রশ্ন তোলে। যদিও বাংলাদেশ সরাসরি কোনো লক্ষ্যবস্তু নয়, তবু আমেরিকার রিটেইলাররা কমপ্লায়েন্স ডকুমেন্টেশনে যথেষ্ট কঠোরভাবে নজর দিচ্ছে।
২০২৪-২৫ জুড়ে গ্যাস-প্রেশার কমে যাওয়ায় ৬-৮ ঘণ্টা পর্যন্ত লোডশেডিংয়ের রিপোর্টে শিল্প উৎপাদন ২০-৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাওয়ার অভিযোগ এসেছে, ফলে ব্যাকআপ জেনারেশনে ডিজেল এবং এলপিজি ব্যবহারে খরচ খরচ বেড়েছে। এনার্জি রিলায়েবিলিটি কমলে লিডটাইম রিস্ক বাড়ে, যা শুল্ক-পরবর্তী উচ্চ-খরচ এনভায়রনমেন্টে বায়ারদের জন্য ‘ডাবল হিট’। ফলে, নিশ্চিত ক্রয়ের আদেশ থাকা সত্ত্বেও সময়মতো শিপ না করতে পারলে জরিমানা বা ক্রয় আদেশ বাতিলের ঝুঁকি থেকে যায়। চট্টগ্রাম বন্দরে দীর্ঘদিনের পণ্য রপ্তানি পণ্যের খালাস ও লোডে বিলম্ব হতো। ২০২৫ সালে সরকার এ সময় তাৎপর্যপূর্ণভাবে কমিয়ে এনেছে, ফলে পণ্যের খালাস ও লোডে অনেক উন্নতি দেখা যাচ্ছে, তবে স্থিতিশীলতা জরুরি।
বাংলাদেশের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো এবং বিজিএমইএর তথ্যমতে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশের রপ্তানি ছিল সাড়ে ৪৪ বিলিয়ন ডলার, যা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের ৮ দশমিক ৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে প্রায় সাড়ে ৪৮ বিলিয়ন হয়েছে। কিন্তু একই সঙ্গে ২০২৪ সালে আরএমজি ভ্যালু ৩৮ বিলিয়ন থেকে ৩৬ বিলিয়নে নেমেছে, যা মূলত চাহিদা, মূল্য এবং মুদ্রাস্ফীতির সমন্বিত প্রতিফলন। ২০২৫-এ ফিরে ‘মডেস্ট রিকভারি’ দেখা গেলেও, নতুন শুল্ক-রেজিম দীর্ঘস্থায়ী হলে সেই রিকভারি টেস্টের মুখে পড়বে। দ্রুত স্কেল-আপ করতে পারা বাংলাদেশের ঐতিহ্য, তবে এখনকার এনার্জি-লজিস্টিক্স চ্যালেঞ্জ ও ওয়ার্কিং-ক্যাপিটাল খরচ স্কেল-আপে অন্যতম বাধা। তবু বাস্তব চিত্র হলো ভারতের ৫০ শতাংশ শুল্কের ফলে যদি সে দেশের ক্রয় আদেশ পরিবর্তন করে ভিন্ন কোনো দেশে দেয় এবং যদি বাংলাদেশ সেই ‘ডাইভার্টেড ভলিউমের’ একটি অংশগ্রহণে সক্ষম হয়, সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক বাড়তি ক্রয়াদেশ পাবে। উল্লেখ্য, চলতি বছরে ২৬ শতাংশ ইউএসের পণ্যক্রয়ের চাহিদা বৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়। ফলে ক্রেতারা টেস্ট-অর্ডার দিয়ে ক্যাপাসিটি যাচাই করছেন; কনসিসটেন্ট ডেলিভারি দিতে পারলেই বাংলাদেশের স্কেল-আপ সম্ভব।
মার্কিন শুল্ক বাড়লে বায়ার সাধারণত দামের একটা অংশ ক্রেতার ওপর চাপায় অর্থাৎ রিটেইল প্রাইস বৃদ্ধি করে; সাপ্লায়ারের মার্জিন কমাতে চাপ দেয়; সোর্সিং দেশ বদলায়। ২০২৫ সালের মাঝামাঝি থেকে মার্কিন রিটেইলাররা শেয়ারহোল্ডার গাইড্যান্সে স্পষ্ট করেছে, ট্যারিফের কারণে গ্রস মার্জিন ৫০-১০০ বেসিস-পয়েন্ট ক্ষয়ে পড়তে পারে এবং এর একটি অংশ খুচরা মূল্যের ওপর পড়বে। ভারতের ৫০ শতাংশ অতিরিক্ত ট্যারিফে বাংলাদেশের তুলনামূলক শুল্ক-অ্যাডভান্টেজ তৈরি হয়েছে।
ভিয়েতনামের সঙ্গে একই ২০ শতাংশ শুল্ক হারে ধরে নিলে, পণ্যের কোয়ালিটি, কমপ্লায়েন্স এবং লজিস্টিকসে যে গ্যাপ আছে, সেটিই ফল নির্ধারণ করবে। চীনের ৩০ শতাংশ অতিরিক্ত থাকা সত্ত্বেও কিছু ক্যাটাগরিতে তাদের ভের্টিক্যাল ইন্টিগ্রেশন বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হবে। অতএব, বাংলাদেশ যদি উচ্চ শুল্ক আইটেমের এক্সপোজার কমিয়ে উচ্চ চাহিদাসম্পন্ন পণ্যে নজর দেয়, তাহলে বাংলাদেশ সুবিধা পেতে পারে।
কারখানার মেশিনারি ধারাবাহিক শক্তি চায়। ২০২৪-২৫-এ বহু অঞ্চলে দৈনিক ৬-৮ ঘণ্টা লোডশেডিং এবং গ্যাস-প্রেশার কমে যাওয়ার কারণে অনেকে ডিজেলচালিত কারখানায় গিয়েছে, ফলে খরচ ৫ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। এ অবস্থায় বড় বায়াররা ‘লিডটাইম অথবা রিস্ক-প্রিমিয়াম’ যোগ করে অর্ডার অন্যত্র দিতে পারে। সে ক্ষেত্রে শিল্প-এলাকাভিত্তিক ডেডিকেটেড সাবস্টেশন বা মাইক্রোগ্রিড স্থাপন; গ্যাস-প্রেশার মনিটরিং; রুফটপ সোলার এবং স্টোরেজের স্কেল-আপে করছাড় এবং সফট লোনের ব্যবস্থা এবং বিদ্যুতের কম লোডের সময় টাইমে ডাইং-ফিনিশিং করা ইত্যাদির মাধ্যমে সমাধান করে যেতে পারে। চট্টগ্রামে সাম্প্রতিককালে বার্থিং ডিলে কিছু উন্নতি হলেও, কনসিসটেন্ট হতে হবে। একদিকে ট্যারিফে খরচ বৃদ্ধি, অন্যদিকে বন্দরে বিলম্বের ফলে মার্জিনে চাপ সৃষ্টি হবে। এর জন্য আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে পোর্টের কার্যক্রম আধুনিকায়ন করে সার্ভিস ক্ষমতা অপ্টিমাইজ করা; রাতের শিফটে কাস্টমস-পোর্ট সার্ভিস বাড়ানো এবং ঢাকা-চট্টগ্রাম লাইনে শাটল-ট্রেন-স্কিম দ্রুত চালুকরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
বিশ্ববাজারে কটনের পাশাপাশি মনুষ্য তৈরি ফাইবার (এমএমএফ) যেমন পলিয়েস্টার, ভিসকোজ এবং স্প্যানডেক্সের ডিমান্ড বাড়ছে। বাংলাদেশে এই ক্যাপাসিটি তুলনামূলক সীমিত। কারণ, ফাইবার, ইয়ার্ন, ফেব্রিক, ডাইং এবং প্রিন্টিংয়ে ইনভেস্টমেন্ট গ্যাপ আছে। শুল্কের ক্ষেত্রে ‘ম্যান-মেড’ ক্যাটাগরির মোস্ট ফেওয়ার্ড নেশন (এমএফএন) প্রায়ই বেশি। সুতরাং প্রোডাক্ট-ইঞ্জিনিয়ারিং করে ‘লোয়ার শুল্ক ব্যাসকেট’-এ শিফট গুরুত্বপূর্ণ। এর জন্য এমএমএফ স্পেশাল ইকোনমিক জোনে ট্যাক্স হলিডেসহ বিভিন্ন স্ট্যান্ডার্ডে দ্রুত অনুমোদন এবং ইউএস ও কানাডার অরিজিন কটন-ব্লেন্ড ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ সৃষ্টি করতে হবে। সুদের হার, ডলার-টাকা ভ্যারিয়েশন, ইনপুট খরচ; সব মিলিয়ে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল চক্র লম্বা হচ্ছে। সুতরাং এক্সপোর্ট ক্রেডিট গ্যারান্টি-এনহান্সড কভার; রিলেন্স অর্ডারে প্রি-শিপমেন্ট ফাইন্যান্সিং এবং ঋণের খরচ কমানোর বিষয় বিবেচনা করা যেতে পারে।
শ্রম কমপ্লায়েন্স ডেটাবেস তৈরি করতে হবে, কারণ কারখানা-ডেটাবেস অসম্পূর্ণ হলে বায়াররা আস্থা রাখে না। বাজার ও পণ্যবৈচিত্র্য আনতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে শুল্ক বাড়লে ইংল্যান্ড, জাপান, কানাডা, মধ্যপ্রাচ্য এবং অস্ট্রেলিয়ার মার্কেট ধরার চেষ্টা করতে হবে। শিল্প এলাকায় ২৪/৭ রিলায়েবল পাওয়ার, গ্যাসের জন্য ডেডিকেটেড ফিডার, রিয়েল-টাইম মনিটরিং, শিডিউলড ইন্টারাপশন এবং রুফটপ সোলার-স্টোরেজে ভ্যাট বা ডিউটি ছাড় দিয়ে সফট লোনের ব্যবস্থা করতে হবে। চট্টগ্রাম কাস্টমসে ‘প্রি-অ্যারাইভাল প্রসেসিং’, ই-ডকুমেন্টেশনের ব্যবস্থা, রাতের শিফটে ম্যানপাওয়ার; গিয়ারলেস ভেসেলে তিন-ছয় দিন বিলম্ব এক-তিন দিনে নামানোর টার্গেট করতে হবে।
তবে মার্কিন রিটেইলারদের মূল্যবৃদ্ধি ও মার্জিন চাপ ‘ভলিউম-মিক্স’ বদলাবে; সোর্সিং ঝুঁকি কমাতে তারা বহুমুখীকরণে যাবে, যেখানে বাংলাদেশ সুবিধা নিতে চাইলে ‘অনটাইম-ফুলকোয়ালিটি-ডেলিভারি’কে শূন্য-সহনশীলতায় নামাতে হবে। বিদ্যুৎ-গ্যাসের স্থিতিশীলতা, চট্টগ্রাম বন্দরের ধারাবাহিক দক্ষতা, এমএমএফ-ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ, ফাইন্যান্সিং খরচ এবং ট্রেসেবিলিটি ও কমপ্লায়েন্সে একসঙ্গে ও দ্রুত অগ্রগতি ছাড়া শুল্কের চাপের প্রভাব পুরোপুরি শোষণ করা কঠিন। এর জন্য এই মুহূর্তে টেক্সটাইল শিল্পকে শক্তিশালী করে কাঁচামালের ওপর আমদানিনির্ভরতা কমানো; শ্রমশক্তিকে আধুনিক প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ করে তোলা এবং রপ্তানি অবকাঠামো যেমন বন্দর ও পরিবহনব্যবস্থাকে প্রযুক্তিনির্ভর করে তুলতে হবে।
সবশেষে বলা যায়, ট্রাম্পের করছাড় নীতি বাংলাদেশের জন্য এক ‘অপরচুনিটি উইন্ডো’ তৈরি করেছে। এই সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে ২০২৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মোট গার্মেন্টস রপ্তানি ৬০ বিলিয়ন ডলারের গণ্ডি পেরিয়ে যেতে পারে, যার এক-তৃতীয়াংশ যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসবে। অন্যথায় অব্যবস্থাপনা ও সংস্কারের ঘাটতিতে এই সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাবে আর বাংলাদেশ প্রতিযোগিতার মঞ্চে ভিয়েতনাম ও মেক্সিকোর কাছে পিছিয়ে পড়বে। বাংলাদেশের পোশাক খাতের ভবিষ্যৎ তাই মূলত নির্ভর করছে আজকের নীতিনির্ধারণকারীদের দিকনির্দেশনা, দূরদর্শিতা ও দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপর। সুযোগ এখনো আমাদের হাতের মুঠোয়। প্রশ্ন হলো, আমরা কি সেই সুযোগ ধরতে প্রস্তুত।
লেখক : অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও কলামিস্ট