‘ক্ষুদ্রঋণ শুধু ঋণ নয়, এটি মর্যাদা ও স্বপ্নের বিষয়’—বাংলাদেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে এই কথাটিই সবচেয়ে গভীরভাবে প্রতিধ্বনিত হয়। ক্ষুদ্রঋণ শুধু সামান্য ঋণ কার্যক্রম নয়, এটি কোটি মানুষের জন্য আত্মমর্যাদা, আত্মনির্ভরতা ও উন্নয়নের একটি চলমান প্রক্রিয়া।

প্রাচীন ভারতের প্রাজ্ঞ গণিতবিদ ‘সিসা বেন দাহির’ রাজাকে বলেছিলেন, দাবার বোর্ডের প্রথম ঘরে এক দানা গম, পরের ঘরে দ্বিগুণ, এভাবে ৬৪তম ঘর পর্যন্ত শস্য দিলেই তিনি খুশি। রাজা হেসে বললেন, এ আর এমন কি? কিন্তু শেষে হিসাব মেলাতে গিয়ে রাজ্যের গণিতবিদ বোঝালেন, এ প্রক্রিয়ায় শস্য দিতে গেলে শস্যের পরিমাণ এত বেশি হবে যে রাজ্যের সব শস্য দিলেও তা পূরণ করা সম্ভব নয়! আপাতদৃষ্টিতে সামান্য মনে হলেও, ৬৪তম ঘরে পৌঁছাতে শস্যের পরিমাণ এতটাই বিশাল হয়ে দাঁড়ায় যে তা পূরণ করা প্রায় অসম্ভব।

ঠিক এই বহুগুণ বৃদ্ধির ধারণাটিই ক্ষুদ্রঋণের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। একইভাবে, অর্থনীতিতে ছোট ছোট অসংখ্য বিনিয়োগ সময়ের সঙ্গে বহুগুণে বেড়ে সামষ্টিক অর্থনীতির চালিকা শক্তিতে রূপান্তরিত হয়। ক্ষুদ্রঋণের মাধ্যমে দেওয়া ছোট অর্থ সাহায্যগুলো বিশাল পরিবর্তনের তরঙ্গ সৃষ্টি করে, যা সমাজের প্রান্তিক মানুষের জীবনযাত্রায় বড় পরিবর্তন আনে। যখন একজন নারী উদ্যোক্তা একটি ছোট ঋণ নিয়ে একটি ক্ষুদ্র ব্যবসা শুরু করেন, সেটি শুধু তাঁর আয় বৃদ্ধি করে না—তাঁর পরিবার, স্থানীয় বাজার, সরবরাহ শৃঙ্খল, কর্মসংস্থান ও ক্রয়ক্ষমতার মধ্য দিয়ে পুরো সমাজ ও অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক তরঙ্গ সৃষ্টি করে।

১৯৩০-এর মহামন্দার সময় ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ জন মেনার্ড কেইনসের দেওয়া ধারণা—টাকার প্রবাহ সচল রাখতে টাকা মানুষের হাতে পৌঁছাতে হবে। এটাই আজকের মাইক্রোফাইন্যান্স বা ক্ষুদ্রঋণের নীতিগত ভিত্তি। কেইনস মহামন্দার সময় বলেছিলেন, যদি টাকার প্রবাহ থেমে যায়, তবে সমাজও থেমে যায়। অর্থনীতি বাঁচাতে টাকা মানুষের হাতে পৌঁছাতে হবে, উৎপাদন ও ব্যয় বাড়াতে হবে।

১৯৭০-এর দশকের আগে বাংলাদেশের দরিদ্র মানুষ ঋণের জন্য নির্ভর করত স্থানীয় মহাজনের ওপর, যাদের সুদের হার ছিল বছরে ১০০ শতাংশের বেশি। জমি, ঘর, মর্যাদা সব হারাত অনেক পরিবার।

এই বাস্তবতায় মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানগুলো এক নীরব বিপ্লবের সূচনা করে। জামানতবিহীন ক্ষুদ্রঋণ মানুষের হাতে তুলে দেয় স্বাধীনতার চাবিকাঠি। বিশেষ করে নারীর জীবনে এর প্রভাব অপরিসীম। নিজের উপার্জনের পর একজন নারী যখন তার সন্তানের স্কুলে যাওয়া, নতুন কাপড় কেনা বা বাড়িতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার সিদ্ধান্ত নেন, তখন বোঝা যায়—ক্ষুদ্র-অর্থায়ন কেবল আর্থিক নয়, আচরণগত পরিবর্তনেরও মূল চালিকা শক্তি। অনেক গ্রামীণ নারী, যাঁরা একসময় ক্ষুদ্রঋণ গ্রুপের সদস্য ছিলেন, পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সরকারের সদস্য বা চেয়ারম্যান হয়ে সামাজিক নেতৃত্বেও নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছেন।

ছোট শুরু, বড় রূপান্তর

১৯৯২-৯৩ সালে পপি কেয়ারের সহায়তায় ভৈরবে ২০টি গ্রুপকে সেলাই ও জুতা তৈরির প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। পরবর্তী সময়ে এটি পিকেএসএফ ও বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় বৃহৎ পরিসরে সম্প্রসারিত হয়। ২০২৫ সালে ভৈরব দেশের অন্যতম বৃহৎ জুতা উৎপাদনকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এই প্রেক্ষাপটে ৫ থেকে ৬ হাজার ছোট-বড় উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। এটি প্রমাণ করে, ক্ষুদ্রঋণ কেবল ‘মাছ দেওয়া’ নয়, বরং মানুষকে ‘কীভাবে মাছ ধরতে হয়’ তা শেখানোর প্রক্রিয়া।

পরিসংখ্যানের চেয়ে শক্তিশালী মানুষের গল্প

২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত বাংলাদেশে মাইক্রোক্রেডিট রেগুলারিটি অথরিটির (এমআরএ) নিবন্ধনপ্রাপ্ত ক্ষুদ্রঋণ সংস্থাগুলোর (গ্রামীণ ব্যাংক বাদে) মধ্যে প্রায় সাড়ে চার কোটি সদস্য এবং তিন কোটি ২০ লাখের বেশি সক্রিয় ঋণগ্রহীতাকে সেবা দিচ্ছে। তারা ২৬ হাজার ৭১টি শাখা পরিচালনা করছে এবং প্রায় ৩ ট্রিলিয়ন টাকা ঋণ বিতরণ করেছে।

কিন্তু পরিসংখ্যানের চেয়েও বেশি শক্তিশালী হলো মানুষের গল্প। রংপুরের বয়নশিল্পী আয়েশা বেগম একসময় ৬০ শতাংশ সুদে মহাজনের কাছ থেকে সুতা কিনতেন। বর্তমানে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান থেকে ২৫,০০০ টাকা ঋণ নিয়ে ও ডিজিটাল মার্কেটিং শিখে তিনি অনলাইনে শাড়ি বিক্রি করেন এবং তিনজন নারীর কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছেন। সুনামগঞ্জের কৃষক রহিম মিয়া জলবায়ু-সহনশীল বীজ ও সোলার পাম্প কিনে এই বছর প্লাবনের মধ্যেও ফসল রক্ষা করেছেন এবং মেয়ের শিক্ষার খরচ চালাতে পারছেন।

এই গল্পগুলো প্রমাণ করে—মাইক্রোফাইন্যান্স মানে জীবন, কর্মসংস্থান, সহনশীলতা এবং ভবিষ্যতের আশার বীজ বপন করা। এই খাতের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো ফিল্ড অফিসারদের ‘মানবিক সংযোগ’—এই বিশ্বাসে যে সদস্যদের সাফল্যই প্রতিষ্ঠানের সাফল্য।

চ্যালেঞ্জ ও নীতি সহায়তার প্রয়োজনীয়তা

বর্তমানে ক্ষুদ্রঋণ খাতের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো পোর্টফোলিও খরচ। অধিকাংশ ক্ষুদ্রঋণ সংস্থা ব্যাংক থেকে উচ্চ সুদে (সাড়ে ১৩ থেকে সাড়ে ১৪ শতাংশ হারে) ঋণ নেয়, পাশাপাশি মোটা অঙ্কের জামানত রাখতে হয়। এই কারণে সদস্যদের কাছে ঋণসেবা পৌঁছে দেওয়ার খরচ ও ঋণের ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা কঠিন হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে, দূরবর্তী এলাকায় যাতায়াত, কাগজপত্র ও ডিজিটাল রিপোর্টিংয়ের জন্য পরিচালন ব্যয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থার কাজ শুধু নিয়ন্ত্রণে সীমাবদ্ধ না রেখে এই খাতকে গতিশীল করার জন্য আরও জোরালো ভূমিকা রাখা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে কিছু সুপারিশ আছে:

১. রিফাইন্যান্সিং সুবিধা: বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে ৫ থেকে ৭ শতাংশ সুদে রিফাইন্যান্সিং উইন্ডো চালু করা গেলে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো কম সুদে ঋণ দিতে পারবে।

২. ডিজিটাল লেনদেন খরচ: ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ডিজিটাল লেনদেনের চার্জ বহন করতে হয়—এই নীতিগত খরচ সমন্বয় করা দরকার।

৩. প্রযুক্তিগত প্রণোদনা: মোবাইল ব্যাংকিং, এআইভিত্তিক ক্রেডিট স্কোরিং ও গ্রামীণ ইন্টারনেট সংযোগে ভর্তুকি দেওয়া।

৪. দুর্যোগ সুরক্ষা: প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ অঞ্চলে আইনি সুরক্ষা জোরদার করতে দুর্যোগকালে সেবা চালিয়ে যাওয়ার জন্য আলাদা ফান্ড প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন। বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঘটলে ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন ঋণ আদায় শিথিল করে, একইভাবে ব্যাংকগুলোও যাতে ওই সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘুরে দাঁড়ানোয় সহায়তা দেয় এবং নিয়মিত ইনস্টলমেন্টে শৈথিল্য আনে, তার ব্যবস্থা করা উচিত।

সরকার ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে সক্রিয় ও ফলপ্রসূ সংলাপ জোরদার করে এমন একটি নীতিগত পরিবেশ গড়ে তোলা জরুরি, যা এই খাতের বিকাশে সহায়ক ভূমিকা রাখবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোর ভূমিকা কেবল তদারকি বা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে—এই সেক্টরের আর্থিক ও কারিগরি সক্ষমতা বৃদ্ধির দিকেও দৃষ্টি দেওয়া উচিত। অর্থাৎ, উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে ‘আইনের কঠিন শিকল’ নয়, বরং আরও উৎসাহব্যঞ্জক ও সহায়ক নীতিমালা প্রণয়নের মাধ্যমে ক্ষেত্রটিকে এগিয়ে নেওয়া প্রয়োজন।

ভবিষ্যতের ক্ষুদ্রঋণ হবে ডিজিটাল, পরিবেশবান্ধব ও জেন্ডার–সহিষ্ণু। বেশ কয়েকটি ক্ষুদ্রঋণ প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে সামাজিক উদ্যোক্তা , ডিজিটাল সাক্ষরতা ও জলবায়ু–সহনশীলতায় পথিকৃৎ ভূমিকা রাখছে।

বিশ্ব ক্ষুদ্রঋণ দিবসে আমাদের এই উপলব্ধি হওয়া উচিত যে ক্ষুদ্রঋণের সাফল্য শুধু টাকার অঙ্কে নয়, বরং মানুষের জীবনের মানে মাপা উচিত। এটি সেই হাতিয়ার, যা একজন নারীকে প্রথমবার নিজের নামেই স্বাক্ষর করতে শেখায়, একজন কৃষককে দুর্যোগে টিকে থাকতে সহায়তা করে এবং একজন তরুণকে উদ্যোক্তা হওয়ার সাহস দেয়।

মুর্শেদ আলম সরকার নির্বাহী পরিচালক, পপি এবং চেয়ারম্যান, ক্রেডিট ডেভেলপমেন্ট ফোরাম-সিডিএফ (বাংলাদেশে ক্ষুদ্রঋণ খাতের প্রতিনিধিত্বকারী বৃহত্তম এবং একমাত্র ফোরাম)

(মতামত লেখকের নিজস্ব)

সূত্র, প্রথম আলো