একটি দেশ ভুল করেও বেঁচে থাকতে পারে কিন্তু দুর্নীতি, লুটপাট ও রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহার নিয়ে কোনো দেশ টিকে থাকতে পারে না। আজ আমাদের সামনে মূল প্রশ্ন আমরা কি একটি ন্যায়ভিত্তিক, দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র গড়ার পথে হাঁটব, নাকি ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাবো?
এই প্রবন্ধটি লেখার অনুপ্রেরণা এসেছে আমার দুই দশক আগের একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে, যখন আমি রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থেকে দুর্নীতি প্রতিরোধ কার্যক্রমের সাথে পরোক্ষভাবে জড়িত ছিলাম। সে সময় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কমিশনার, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য প্রফেসর মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিঞা আমাকে অনুরোধ করেন তার পদত্যাগপত্র প্রধানমন্ত্রী বরাবর পৌঁছে দিতে কারণ, তিনি কমিশনের অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক ব্যর্থতা, বিশেষ করে চেয়ারম্যান বিচারপতি সুলতান হোসেন খানের খুব ধীর সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী ও অদক্ষতার কারণে নিজ দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারছিলেন না। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছায়, কমিশনের অভ্যন্তরে শুরু হয় তিন কমিশনারেরই অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগের পালা। আমি তখন কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করি, যাদের কাঁধে দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ের গুরুদায়িত্ব, তারা দুর্নীতি দমন নয়; বরং নিজেদের দ্বেদ্ব একজন আরেকজনকে দমন করতেই যেন বেশি তৎপর।
আশার সূচনা, অচল বাস্তবতা (২০০৪-০৭) : ২১ নভেম্বর ২০০৪ সালে দুদক গঠিত হয় একটি স্বাধীন ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত সংস্থা হিসেবে। কিন্তু শুরু থেকেই নেতৃত্বে ছিল সমন্বয়হীনতা। ২০০৭ সালে বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতির আমন্ত্রণে তিন কমিশনারই পদত্যাগ করেন। জনগণের প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়ে তারা মানবসম্পদের ঘাটতি, আইনি জটিলতা ও অসম্পূর্ণ আইনের কথা উল্লেখ করেন, যা কমিশনের স্বাধীনতাকে কার্যত খর্ব করেছিল। নিজেদের বিধিমালা বা কাঠামো প্রণয়নেও কমিশনের ছিল না পূর্ণ কর্তৃত্ব। গণমাধ্যমে প্রফেসর মনিরুজ্জামান বলেন, ‘শুধু ঘুষখোর নয়, যারা ঘুষ দেয় তারাও অপরাধী।’ চেয়ারম্যান সুলতান হোসেন খান দুর্নীতির কেন্দ্রস্থল হিসেবে কাস্টমস, বন্দর ও পুলিশ বিভাগের কথা বলেন, যেখানে দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতা বড় বাধা।
এই অধ্যায়টি স্পষ্ট করে দেয় যে আইন থাকা সত্তে¡ও রাজনৈতিক বিবেচনায় গঠিত, কাঠামোগতভাবে দুর্বল এবং নেতৃত্বহীন কোনো প্রতিষ্ঠান কখনোই দুর্নীতির মতো প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাধির বিরুদ্ধে কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না।
জরুরি শাসনামলে ভিন্ন চেহারায় দুদক (২০০৭-০৯) : জরুরি শাসনামলে দুদক অবশ্য কিছুটা ভিন্ন চেহারা নেয়। ‘দুদক’ নামটি তখন অনেক রাজনীতিবিদের কাছে আতঙ্কে পরিণত হয়, যদিও তা ছিল ক্ষণস্থায়ী। লে. জেনারেল হাসান মশহুদ চৌধুরীর নেতৃত্বে দুদক প্রথমবারের মতো দাঁত-নখ মেলে। ‘এইবার যুদ্ধ হবে’, এই ঘোষণার পর দুর্নীতির রাঘববোয়ালরা কাঁপতে শুরু করে।
তার নেতৃত্বে দুর্নীতির বিরুদ্ধে এক সাহসী অভিযান শুরু হয় এবং প্রথমবারের মতো রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান পদক্ষেপ নেন। এমনকি দুই সাবেক প্রধানমন্ত্রীও সেই অভিযানের আওতায় আসেন। কিছু বাড়াবাড়িও তারা করে ফেলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আইনি দুর্বলতা ও রাজনৈতিক চাপের কারণে এসব মামলার অনেকটাই বাতিল হয়ে যায়। ২০০৯ সালে তার পদত্যাগের পেছনে ছিল রাজনৈতিক অস্বস্তি, যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তা স্বেচ্ছামূলক। তার বিদায়কেই অনেকে বলেছেন দুদকের ‘নখদন্ত ভাঙার’ সূচনা। এই অধ্যায়টি আমাদের শিখিয়ে দেয়, নীতিনিষ্ঠ নেতৃত্ব থাকলেও যদি দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ও প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা না থাকে, তবে দুর্নীতিবিরোধী অভিযান টেকসই হতে পারে না।
দুর্নীতি হয়ে ওঠে রাষ্ট্রের চালিকাশক্তি (২০০৯-২৪) : ২০০৯ সালের পর থেকে দুদক কার্যত রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কাছে আত্মসমর্পণ করে। বিশেষ করে ২০১৩ সালের আইন সংশোধনের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনীতিবিদের বিরুদ্ধে তদন্তের জন্য সরকারের অনুমতি বাধ্যতামূলক করা হয়, যা সংস্থাটিকে ‘নখদন্তহীন ব্যাঘ্রে’ পরিণত করে। এরপর থেকেই দুদক হয়ে ওঠে একটি পক্ষপাতদুষ্ট, প্রভাবাধীন ও প্রহসনের প্রতিষ্ঠান। বিরোধীদের বিরুদ্ধে মামলা, তদন্ত ও হয়রানি চললেও শাসকদলের দুর্নীতির মহাব্যাধি চোখ বন্ধ করে এড়িয়ে যাওয়া হয়। বহু দুর্নীতির মামলা গোপনে প্রত্যাহার হয় বা ধামাচাপা পড়ে যায়, অভিযুক্তদের ‘ক্লিন সার্টিফিকেট’ দেয়ার নজিরও বারবার দেখা গেছে।
এই সময়ে দুর্নীতি হয়ে ওঠে ক্ষমতার প্রধান চালিকাশক্তি। সাধারণ মানুষের অনেকেও ক্ষুদ্র লাভের আশায় জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিতে দ্বিধা করেনি। দুদককে ব্যবহার করা হয় এমনভাবে যেন কেউ দুর্নীতির অভিযোগে আওতাভুক্ত থাকলে তাকে বø্যাকমেইল করে ‘নির্বাক’ রাখা যায়। ফলে যারা পেশাগতভাবে অযোগ্য বা মাঝারি মানের ছিলেন, তারা দ্রুত শাসকদলের আনুগত্যের বিনিময়ে উচ্চপদে অধিষ্ঠিত হন, দেশপ্রেমিক, সাহসী ও মেধাবীরা পিছিয়ে পড়েন। শীর্ষ পর্যায়ে এমন কাউকেই রাখা হয়নি যিনি দুর্নীতিবিরোধী অবস্থান নিতে পারেন, কারণ প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে দুর্নীতির দাগে কলুষিত ছিলেন। অবস্থা এমন দাঁড়ায়, একজন পিয়ন পর্যন্ত ৪০০ কোটি টাকার মালিক হন, অথচ বিচার হয় না। এটি দেখায় দুর্নীতি কিভাবে রাষ্ট্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে।
নতুন নেতৃত্ব ও সংস্কারের আশা : ২০২৪ সালের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সময়ে ড. মোহাম্মদ আব্দুল মোমেনের নেতৃত্বে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাঠামোগত দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার কিছু আশাব্যঞ্জক লক্ষণ দেখা গেছে। এ সময় রাজনীতিক, আমলা, ব্যবসায়ী ও উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের একটি অংশ যারা অসাধু উপায়ে বিপুল সম্পদ অর্জন করেছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে দৃশ্যমান ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হলো- ড. মোমেন কি পারবেন তার এই সাহসী দুর্নীতিবিরোধী উদ্যোগকে শেষ পর্যন্ত টিকিয়ে রাখতে? নাকি অতীতের পুনরাবৃত্তির মতো রাজনৈতিক সরকার এলে সব প্রচেষ্টা আবারো থেমে যাবে? যদিও বর্তমানে কিছু কাঠামোগত সংস্কার দৃশ্যমান, তবু এর সফলতা পুরোপুরি নির্ভর করছে আগামী দিনের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও জনগণের চাপের ওপর।
নির্বাচনের আগেই প্রয়োজন কাঠামোগত সংস্কার : বর্তমানে ১৫ লাখ সরকারি কর্মচারীর মধ্যে আনুমানিক ৭০ শতাংশ দুর্নীতিতে জড়িত। দুদকের পক্ষে স্বল্পসংখ্যক স্টাফ দিয়ে দুর্নীতি দমনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ বর্তমান বাস্তবতায় অত্যন্ত কঠিন। সাম্প্রতিক সময়ে এনবিআরের ধর্মঘটের পরে যেমন দ্রুত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল, তেমন পদক্ষেপই আজ জরুরি। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ে দুর্নীতি তদন্ত ইউনিট গঠন করতে হবে, যেখানে অভিজ্ঞ ও অবদান রাখতে সক্ষম এমন শিক্ষক, সুশীলসমাজ ও অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা থাকবেন। ড. ইফতেখারুজ্জামানের নেতৃত্বে গঠিত দুর্নীতি রিফর্ম কমিশন ৪৭টি গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ দিয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়ন নির্ভর করে রাজনৈতিক সদিচ্ছার ওপর। নির্বাচিত সরকারগুলো অতীতে বারবার এ ধরনের কমিশনকে অকার্যকর করে দিয়েছে। এই সংস্কার নতুন সরকার গঠনের আগেই করতে হবে, কারণ পরে এই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন কঠিন হবে।
দুর্নীতির মূল শিকড়-রাজনীতি ও রাজনৈতিক তহবিল : বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রবেশ করতে হলে একজন সংসদ সদস্যকে প্রায় ২০-৩০ কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। এর উৎস ঘুষ, কমিশন ও চাঁদাবাজি। নির্বাচিত হওয়ার পর তাদের প্রধান লক্ষ্য হয় বিনিয়োগ ফেরত আনা। এই প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক পুঁজির নামে দুর্নীতির এক দুষ্টচক্র তৈরি হয়েছে। ভোটাররাও টাকা বা চাপে পড়ে দুর্নীতিবাজদের ভোট দেন, ফলে সৎ প্রার্থীরা পরাজিত হন। সমাজে সততা এখন দুর্বলতার প্রতীক, আর দুর্নীতিবাজকে বলা হয় স্মার্ট। রাজনৈতিক দলগুলোও তহবিল সঙ্কটে চাঁদাবাজি ও দাতানির্ভর হয়, যার ফলেই দুর্নীতিকে থামানো যায় না। এ জন্য রাজনীতিবিদরা প্রচেষ্টা গ্রহণ করেন যাতে দুদক অকার্যকর হয়ে ওঠে।
বিপ্লবী পদক্ষেপই এখন সময়ের দাবি : জাপানে মাত্র সাত ডলার আত্মসাৎ করায় একজন বাসচালকের চাকরি ও এক কোটি টাকা পেনশন বাতিল হয়েছে। সিঙ্গাপুর শিপইয়ার্ডে ট্রাক ড্রাইভার থেকে মাত্র ১০ ডলার ঘুষ নেয়ার অভিযোগে অভিবাসী দুই চীনা শ্রমিকের বিচার তাদের পাঁচ বছর কারাদণ্ড বা এক লাখ সিঙ্গাপুরি ডলার জরিমানা হয়। এক সময় আমি নিজে রাষ্ট্রীয় দায়িত্বে থেকে (ঈযরহবংব ঞরমবৎ ধহফ সড়ংয়ঁরঃড় সবঃযড়ফ) অনুযায়ী, বিভিন্ন স্তরের ১০০ দুর্নীতিবাজের বিরুদ্ধে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার উদ্যোগ নিয়েছিলাম, যা বাস্তবায়িত হলে আজ হয়তো অন্য চিত্র দেখতে পেতাম। কিন্তু রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাবে তখন তা কার্যকর করা যায়নি। বাংলাদেশের বাস্তবতায় প্রচলিত তদন্তপ্রক্রিয়া, চার্জশিট ও দীর্ঘ বিচারিক ধাপ দিয়ে দুর্নীতির লাগাম টানা কার্যত অসম্ভব। তাই এখন দরকার ‘শক থেরাপি’ তাৎক্ষণিক ও দৃশ্যমান শাস্তি যেমনটি সামরিক ক্ষেত্রে করা হয় যা সমাজে ঝাঁকুনি এনে দেবে এবং ভবিষ্যতে অন্যদের দুর্নীতিতে জড়াতে নিরুৎসাহিত করবে। যদি কয়েকজন দুর্নীতিবাজকে দ্রুত বিচার করে জেল ও পেনশন বাতিলসহ সামাজিকভাবে অপমান করা হয়, তাহলে সমাজে শক্ত বার্তা যাবে।
বাংলাদেশেও যদি এমন একটি ‘পাইলট প্রকল্প’ ড. মোমেন ও তার কমিশনের নেতৃত্বে শুরু হয়, তা হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দৃশ্যমান যুদ্ধের সূচনা। লি কুয়ান ইউ মাত্র কয়েক বছরেই সিঙ্গাপুরকে একইভাবে দুর্নীতিমুক্ত করেছিলেন। ক্ষুদ্রতম দুর্নীতির প্রতিও তিনি কঠোর ছিলেন এবং শাস্তির ক্ষেত্রে ছিলেন নির্দয়, যার মাধ্যমে তিনি একটি পুরো জাতির সংস্কৃতি ও মানসিকতা পাল্টে দেন। আমাদেরও চাই এমন এক বছরের জন্য কঠোর শাসন ও সংস্কার, যা জনগণকে আশার আলো দেখাবে।
এখনই সময় শক থেরাপির : বাংলাদেশে আজ প্রয়োজন এমন একটি ‘শক থেরাপি’ যা দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের মধ্যে ভয় ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করবে। নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় আসার আগেই, ড. মোমেনের নেতৃত্বে দুদক যদি দৃঢ়চেতা ও নিষ্ঠুর বাস্তবতার পথে হেঁটে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে তবে তা হবে বাংলাদেশের জন্য গেম চেঞ্জার। এই উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে, এটি হতে পারে একটি সত্যিকারের সফল গল্প, যেমনটি সিঙ্গাপুরে ঘটেছিল লি কুয়ান ইউয়ের সময়কালে।
একটি দেশ ভুল করেও বেঁচে থাকতে পারে কিন্তু দুর্নীতি, লুটপাট ও রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহার নিয়ে কোনো দেশ টিকে থাকতে পারে না। আজ আমাদের সামনে মূল প্রশ্ন আমরা কি একটি ন্যায়ভিত্তিক, দুর্নীতিমুক্ত রাষ্ট্র গড়ার পথে হাঁটব, নাকি ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাবো?
লেখক : সাবেক সহকারী নৌবাহিনী প্রধান ও উপ-উপাচার্য, বিইউপি