বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি শক্তিশালী, দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল ও কৌশলগতভাবে সুসংগঠিত জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল (NSC) গঠন এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ, জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোহিঙ্গা সঙ্কট, জলসঙ্কট এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যসহ নানা হুমকি বিদ্যমান। তাই শুধু সামরিক বাহিনী দিয়ে নয়, বরং প্রশাসন, স্বাস্থ্য, কৃষি, পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়ন সবগুলোকে একত্রে নিরাপত্তা কাঠামোর অংশ করতে হবে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পিপলস আর্মি একান্ত প্রয়োজন, দেশের নাগরিকদের যুদ্ধের ট্রেনিং বাধ্যতামূলক করতে হবে। বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালা (National Security Policy of Bangladesh) সংক্ষেপে NSC হলো একটি রাষ্ট্রীয় কৌশলগত নথি, যার মাধ্যমে দেশের সার্বভৌমত্ব, অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা, অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার লক্ষ্যে দিকনির্দেশনা নির্ধারণ করা হয়। বাংলাদেশ সরকার ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের পর প্রথমবারের মতো একটি আনুষ্ঠানিক ‘জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলপত্র’ অনুমোদনের দিকে এগোয়, যা দেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। যেকারণে জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালার দরকার বাংলাদেশের স্বাধীন ও স্বতন্ত্রভাবে সব জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা নিশ্চিত করতে হবে। বিদেশী হস্তক্ষেপ রোধ, নিজস্ব আইন, বিচার ও প্রশাসনের স্বাধীনতা ও অভ্যন্তরীণ বিষয়ে সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে হবে। দেশের মানচিত্র ও সীমানা অক্ষুণ্ন রাখা, ভূমি, জলসীমা ও আকাশসীমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা। সীমান্ত বিরোধ প্রতিরোধ, চোরাচালান ও অনুপ্রবেশ ঠেকানো, সমুদ্রসীমা ও নৌপথের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জনে শক্তিশালী সশস্ত্রবাহিনী ও সীমান্ত রক্ষাবাহিনী (বিজিবি, কোস্টগার্ড) গড়ে তুলতে হবে। দরকার হবে কূটনৈতিক তৎপরতা ও আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়। গোয়েন্দা নজরদারি ও প্রযুক্তি ব্যবহার, সীমান্ত উন্নয়ন, অবকাঠামো ও জনসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি করতে হবে। এ লক্ষ্য অর্জন করতে হলে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হবে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ পার্বত্য চট্টগ্রাম (খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, বান্দরবান) বাংলাদেশের একটি সংবেদনশীল ও কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ এলাকা, যেখানে দীর্ঘদিন ধরে জাতিগত দ্বন্দ্ব, অস্ত্রধারী গোষ্ঠীর সহিংসতা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদী তৎপরতা চলে আসছে। সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধ জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে এ অঞ্চলে একটি জরুরি অগ্রাধিকার দিতে হবে। ১. বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র গোষ্ঠী ভারতের ইন্ধনে কয়েকটি উপজাতীয় সশস্ত্র সংগঠন এখনো অস্ত্রধারী কার্যক্রম ও চাঁদাবাজিতে লিপ্ত। তারা নিজেদের স্বশাসিত অঞ্চল বা বিশেষ অধিকার দাবি করে থাকে। ২. অস্ত্র ও গোলাবারুদের চোরাচালান ভারত ও মিয়ানমারের সীমান্ত দিয়ে অস্ত্র ও মাদক প্রবেশ করছে, যা সন্ত্রাসে অর্থায়ন করছে। পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় নজরদারি কঠিন। ৩. চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী অর্থায়ন স্থানীয় ব্যবসায়ী, উন্নয়ন প্রকল্প ও সাধারণ মানুষের ওপর চাঁদা আদায় সন্ত্রাসীদের অর্থ জোগান দেয়। ৪. জনসংখ্যাগত বৈষম্য ও আস্থার ঘাটতি বাঙালি ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর মধ্যে অবিশ্বাস, নিরাপত্তাহীনতা এবং ঐতিহাসিক ক্ষোভ টিকে আছে। সন্ত্রাসবাদ প্রতিরোধে প্রধান পদক্ষেপসমূহ সেনাবাহিনী ও প্রশাসনের যৌথভাবে চালানো সন্ত্রাস দমন ও শান্তি প্রতিষ্ঠার বিশেষ অভিযান দরকার। পাহাড়ি অঞ্চলে সন্ত্রাসী আস্তানা উচ্ছেদ, অস্ত্র উদ্ধার, চাঁদাবাজি দমন, স্থানীয় সম্প্রদায়ের সম্পৃক্ততা বৃদ্ধি, শান্তিরক্ষায় জনসম্পৃক্তি ও স্থানীয় নেতৃত্বকে যুক্ত করতে। উন্নয়ন প্রকল্পে আদিবাসী ও বাঙালি উভয়ের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা, কিশোর-তরুণদের উগ্রবাদী প্রভাব থেকে দূরে রাখা আন্তঃসীমান্ত নিরাপত্তা সহযোগিতা গড়ে তুলতে হবে। ভারতের ত্রিপুরা-মিজোরাম রাজ্য এবং মিয়ানমারের সাথে অস্ত্র পাচার প্রতিরোধে কূটনৈতিক যোগাযোগ করতে হবে। এ জন্য সীমান্তে বিজিবি ও সেনাবাহিনীর তৎপরতা বাড়াতে হবে। সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বর্তমান ডিজিটাল যুগে সাইবার জগৎ হয়ে উঠেছে জাতীয় নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ এবং ঝুঁঁকিপূর্ণ ক্ষেত্র। তাই বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালায় সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করাকে অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সরকারি ওয়েবসাইট ও তথ্যভাণ্ডারে হ্যাকিং হওয়ার আশঙ্কা রযেছে। হতে পারে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সাইবার হামলা। ভুয়া তথ্য ও গুজব ছড়িয়ে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করতে পারে। জাতীয় অবকাঠামো (power grid, telecom) লক্ষ্য করে সাইবার আক্রমণ হতে পারে। সামরিক ও কূটনৈতিক তথ্য ফাঁস হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোর সাইবার সুরক্ষা (Critical Infrastructure Protection) দিতে হবে। বিদ্যুৎ, পানি, টেলিযোগাযোগ, ব্যাংকিং ও পরিবহন খাতে সাইবার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করতে হবে। সরকারি ও সামরিক তথ্য সুরক্ষা তথ্যের গোপনীয়তা ও অখণ্ডতা রক্ষা করতে হবে। গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগে এনক্রিপশন ও নেটওয়ার্ক নিরাপত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। সাইবার অপরাধ ও সাইবার সন্ত্রাস প্রতিরোধে হ্যাকার, ফিশিং, ডিজিটাল চাঁদাবাজি ও ডিজইনফরমেশন মোকাবেলায় সাইবার গোয়েন্দা ও মনিটরিং বাড়াতে হবে। সাইবার নীতিমালা ও আইন প্রণয়ন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা কৌশল বাস্তবায়ন করতে হবে। ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য ডেটা প্রটেকশন আইন গ্রহণ। সাইবার প্রতিরক্ষা বাহিনী ও সক্ষমতা বাড়াতে সেনাবাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থা ও ডিজিটাল নিরাপত্তা সংস্থার সাইবার ইউনিট প্রতিষ্ঠা ও প্রশিক্ষণ দিতে হবে। নাগরিকদের ডিজিটাল ঝুঁকি সম্পর্কে সচেতন করতে হবে। সাইবার সিকিউরিটি প্রশিক্ষণ ও ক্যারিয়ার গঠন কর্মসূচি চালু ‘সাইবার নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ’ শুধু প্রযুক্তির বিষয় নয়, এটি এখন রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও অবকাঠামো সুরক্ষা অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও অবকাঠামো সুরক্ষা বাংলাদেশ জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালার অন্যতম কেন্দ্রীয় লক্ষ্য। কারণ একটি দেশের টেকসই নিরাপত্তা শুধু সামরিক শক্তির ওপর নয়; বরং তার অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, উৎপাদন ক্ষমতা এবং মূল অবকাঠামোর নিরাপত্তার ওপরও নির্ভর করে। অর্থনৈতিক নিরাপত্তা বলতে অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও খাতসমূহের স্থিতিশীলতা, বিদেশী বিনিয়োগ, রফতানি-বাণিজ্য ও রিজার্ভ সুরক্ষা, জ্বালানি নিরাপত্তা ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ বোঝায়। এর সাথে বেকারত্ব, দারিদ্র্য ও বৈষম্য হ্রাসের মাধ্যমে সামাজিক স্থিতি বজায় রাখা। বিমানবন্দর, সমুদ্রবন্দর, রেলপথ, বিদ্যুৎকেন্দ্র, বাঁধ, ব্রিজ ইত্যাদির নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জ্বালানি, পানি সরবরাহ, তথ্যপ্রযুক্তি ও টেলিযোগাযোগ অবকাঠামো রক্ষা। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, সন্ত্রাসবাদ, সাইবার আক্রমণ ও শিল্প দুর্ঘটনা থেকে এই অবকাঠামোগুলোর সুরক্ষা ও প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতা বৃদ্ধি বাংলাদেশ একটি জলবায়ু-সংবেদনশীল ও দুর্যোগপ্রবণ দেশ। ঘন ঘন ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, নদীভাঙন, খরা এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুধু মানবিক বিপর্যয় নয়, জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও একটি বড় হুমকি। তাই জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালার একটি মূল উদ্দেশ্য হলো জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় রাষ্ট্রীয় সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে যেসব কৌশল গ্রহণযোগ্য : ১. জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ, ২. প্রতিরোধ ও প্রস্তুতি সক্ষমতা বৃদ্ধি, ৩. জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন ও প্রশমন কৌশল, ৪. জলবায়ু উদ্বাস্তু ব্যবস্থাপনা নীতি, ৫. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও কূটনীতি। পররাষ্ট্রনীতি ও আঞ্চলিক সম্পর্কের ভারসাম্য রক্ষা বাংলাদেশের ভূরাজনৈতিক অবস্থান দক্ষিণ এশিয়ার কেন্দ্রবিন্দুতে হওয়ায়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক শক্তির প্রভাব, প্রতিযোগিতা এবং সহযোগিতার মাঝে ভারসাম্য রক্ষা একটি গুরুত্বপূর্ণ নিরাপত্তা বিষয়। তাই জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালার অন্যতম মূল উদ্দেশ্য হলো পররাষ্ট্রনীতিতে কৌশলগত ভারসাম্য বজায় রেখে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। সম্ভাব্য হুমকি আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা (ভারত-চীন, যুক্তরাষ্ট্র-চীন) চাপের মধ্যে কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা রকতে হবে। সীমান্ত উত্তেজনা বা নিরাপত্তা ইস্যুতে অভ্যন্তরীণ স্থিতিশীলতা বিঘ্নিত হতে পারে। বৈদেশিক বিনিয়োগ ও বাণিজ্য রুট নির্ভরতা কৌশলগত ঝুঁকি। আঞ্চলিক জোট বা সহযোগিতা থেকে বাদ পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। আমাদের কৌশলসমূহ হতে পারে, ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি : ভারত, চীন, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, রাশিয়া তথা সব পক্ষের সাথে সম্পর্ক রক্ষা করে চলা। দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় ফোরামে সক্রিয় কূটনৈতিক ভূমিকা পালন করতে হবে। সার্ক, বিমসটেক, আইওআরএ, D-8, BBIN, BIM ইত্যাদিতে অংশগ্রহণ ও কৌশলগত জোট গঠন করতে হবে। আঞ্চলিক সংহতি ও পারস্পরিক নিরাপত্তা জোরদার করার লক্ষ্যে ক্জা করতে হবে। প্রতিবেশী দেশগুলোর সাথে জল, সীমান্ত ও নিরাপত্তা ইস্যুতে আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। ট্রান্স-বাউন্ডারি নদী ও সীমান্ত এলাকায় সমঝোতা ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথ খুঁজতে হবে। সমুদ্রবন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র, টেলিকম অবকাঠামোতে বিদেশী প্রভাব নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। বিদেশী বিনিয়োগে নিরাপত্তা ঝুঁকি যাচাই করতে হবে। বৈদেশিক বাণিজ্য ও শিপিং রুটে নিরাপত্তা নিশ্চিতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা নিতে হবে। বৈদেশিক ঋণ ও চুক্তির ক্ষেত্রে জাতীয় স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সম্ভাব্য ভারতের হুমকির মোকাবেলায় চীন-রাশিয়া-পাকিস্তান-তুরস্কের সাথে নিরাপত্তা সম্পর্ক তৈরি করতে হবে। বন্ধুরাষ্ট্র চীনের সাথে যেন কোনো রকমের সম্পর্ক অবনতি না ঘটে সেই দিকে সম্পূর্ণ দৃষ্টি রাখতে হবে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে ভারতসহ যেকোনো দেশের হস্তক্ষেপ প্রতিরোধ করতে হবে। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তন জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে পদক্ষেপ নিতে হবে সমুদ্র নিরাপত্তা ও ব্লু ইকোনমির সুরক্ষা বাংলাদেশের সমুদ্র এলাকা (বিশ্ব Court রায় অনুসারে প্রাপ্ত প্রায় ১, ১৮, ৮১৩ বর্গকিমি. এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোন) একটি বিশাল সম্ভাবনার খাত, যেটি ‘ব্লু ইকোনমি’ বা সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতি হিসেবে পরিচিত। এ খাতের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য। জাতীয় নিরাপত্তা নীতিতে যেসব কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণযোগ্য : ১. সমুদ্রসীমার সার্বভৌমত্ব রক্ষা, ২. ব্লু ইকোনমির নিরাপত্তা ও পরিচালনা, ৩. সাগরে চোরাচালান ও জলদস্যুতা রোধ এবং ৪. আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমুদ্র নিরাপত্তা সহযোগিতা। নীতিমালার প্রধান বৈশিষ্ট্য সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গি বলতে বোঝায় রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কেবলমাত্র সেনা বা পুলিশ নয়; বরং রাষ্ট্রের সব ক্ষেত্রের সম্পদ, সংস্থা ও কৌশলকে একত্র করে ব্যবহার করা। এ ধরনের দৃষ্টিভঙ্গিতে সামরিক শক্তি যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি কূটনৈতিক সম্পর্ক, অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, সামাজিক সংহতি এবং প্রযুক্তিগত সক্ষমতাও নিরাপত্তার অংশ হয়ে ওঠে। সার্বিক নিরাপত্তা ধারণা হলো এমন একটি নিরাপত্তার দর্শন, যেখানে শুধু রাষ্ট্র বা সীমান্ত নয়, বরং মানুষের জীবন-জীবিকা এবং মর্যাদা এ তিনটি বিষয়কে কেন্দ্র করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হয়। এটি জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক প্রস্তাবিত একটি আধুনিক ধারণা, যা বর্তমানে বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালায় গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেয়েছে। বেসামরিক ও সামরিক সমন্বয় : জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী (যেমন : সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমানবাহিনী) ও বেসামরিক প্রশাসন (যেমন : মন্ত্রণালয়, পুলিশ, র‌্যাব, স্বাস্থ্য, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগ, গোয়েন্দা সংস্থা, কূটনীতি বিভাগ) সব পক্ষের মধ্যে পরিকল্পিত ও কার্যকর সমন্বয় গড়ে তোলাকে বোঝায়। জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল হলো বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তা নীতিমালা বাস্তবায়ন ও ব্যবস্থাপনায় মূল সমন্বয়কারী ও নীতিনির্ধারক প্রতিষ্ঠান। পূর্ণাঙ্গ রূপ ধারণ করে এখনই এটা কার্যকর করতে হবে। জাতীয় নিরাপত্তা পরিস্থিতি দ্রুত পর্যালোচনা ও হুমকি মূল্যায়ন করতে হবে। প্রতিক্রিয়া পরিকল্পনা (Contingency Plan) তৈরি ও অনুমোদন। সামরিক ও বেসামরিক সংস্থার যৌথ অভিযান পরিচালনার অনুমোদন। গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগি ও সমন্বিত বিশ্লেষণ। কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সহযোগিতা প্রসারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ। গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ও সাইবার স্পেসের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ। যারা রাজনীতি করবে এবং মিডিয়াতে টক শো করবে তাদেরকে এ নীতিমালার আওতায় আনতে হবে। বিশেষ ব্যবস্থা NSC সচিবালয় : প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে একটি স্থায়ী ও জরুরি সেলের মাধ্যমে সমন্বয় করতে হবে। সাপ্তাহিক বা জরুরি বৈঠক করতে হবে। প্রয়োজন হলে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে সভা করতে হবে। নির্দিষ্ট হুমকি যেমন- সাইবার, সন্ত্রাসবাদ, জলবায়ু ইত্যাদির জন্য উপকমিটি বা টাস্ক ফোর্স গঠন করতে হবে। বাংলাদেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একটি শক্তিশালী, দ্রুত প্রতিক্রিয়াশীল ও কৌশলগতভাবে সুসংগঠিত জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিল (NSC) গঠন এখন সময়ের দাবিতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ, জলবায়ু-সংবেদনশীল দেশ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোহিঙ্গা সঙ্কট, জলসঙ্কট এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যসহ নানা হুমকি বিদ্যমান। তাই শুধু সামরিক বাহিনী দিয়ে নয়, বরং প্রশাসন, স্বাস্থ্য, কৃষি, পরিবেশ ও সামাজিক উন্নয়ন সবগুলোকে একত্রে নিরাপত্তা কাঠামোর অংশ করতে হবে। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পিপলস আর্মি একান্ত প্রয়োজন, দেশের নাগরিকদের যুদ্ধের ট্রেনিং বাধ্যতামূলক করতে হবে। লেখক : সিনিয়র ফেলো, এসআইপিজি, নর্থসাউথ ইউনিভার্সিটি

e-mail : [email protected]

সূত্র, নয়া দিগন্ত