যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যযুদ্ধের পাশাপাশি সামরিক এবং প্রযুক্তি ক্ষেত্রে তীব্র প্রতিযোগিতা চলছে। এই প্রতিযোগিতা বিশ্বের প্রভাবশালী দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা তৈরি করেছে। এই পরিস্থিতিতে আরব বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দেশ মিসরের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠতা যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের মধ্যে গভীর উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। কারণ মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের মিত্র মিসরের চীনের দিকে ঝুঁকে পড়া এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের প্রভাব খর্ব হওয়ারই ইঙ্গিত বহন করে।

ভূরাজনৈতিক ও কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের পর মিসরের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠতাকে নিজেদের জন্য একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ হিসেবেই দেখছে যুক্তরাষ্ট্র। কারণ এই অঞ্চলে চীনের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত স্বার্থ এবং প্রভাবের জন্য গুরুতর চ্যালেঞ্জ তৈরি করবে। এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র তার দীর্ঘদিনের মিত্র মিসরের সঙ্গে চীনের ঘনিষ্ঠতাকে সহজভাবে নিতে পারছে না। চীন মিসরকে শুধু অর্থনৈতিক নয়, সামরিক সহযোগিতাও দিচ্ছে। এই সহযোগিতা মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক উপস্থিতিকেও হুমকির মধ্যে ফেলতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতাতেই প্রথম আরব দেশ হিসেবে মিসর ১৯৭৯ সালে ইসরাইলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করে। দেশটিকে বছরে ১৩০ কোটি ডলার সামরিক সহায়তা এবং ২৫ কোটি ডলার অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়ে আসছে ওয়াশিংটন। কিন্তু মিসরে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতির অবনতির কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মিসরের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাতাহ আল সিসির সরকারের সম্পর্কের অবনতি ঘটে। গাজায় ইসরাইলের চলমান সামরিক আগ্রাসনে বাস্তুচ্যুত লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে মিসরে জোর করে পাঠিয়ে দেওয়ার ইসরাইলি পরিকল্পনায় প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমর্থনের কারণেও দুই দেশের সম্পর্কে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে।

ফলে যুক্তরাষ্ট্র-মিসর সম্পর্ক আর আগের মতো অটুট নেই। দুই দেশের এই সম্পর্কে অনেকটাই ফাটল ধরিয়েছে চীন। বর্তমানে মিসর মধ্যপ্রাচ্যে চীনের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র। এর কারণ হিসেবে কোনো কোনো বিশ্লেষক চীনের আন্তঃমহাদেশীয় অবকাঠামো প্রকল্প বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) এবং মিসরের বর্তমান প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাতাহ আল সিসির ‘ভিশন ২০৩০’ নামের জাতীয় উন্নয়ন পরিকল্পনার মধ্যে একটি সম্পর্ক আছে বলে মনে করেন।

দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামরিকসহ নানামুখী সম্পর্ক অনেক দূর এগিয়েছে। বর্তমানে চীন-মিসরের সম্পর্ককে সংহতি, সহযোগিতা ও পারস্পরিক স্বার্থ সংরক্ষণের একটি মডেল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। দেশ দুটি নতুন নতুন ক্ষেত্রে সহযোগিতা বাড়ানোর জন্য কাজ করে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাতাহ আল সিসি চীনের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও সহযোগিতায় তার দেশের বিভিন্ন সেক্টরকে এগিয়ে নেওয়ার কৌশল গ্রহণ করেছেন।

মিসর ‘এক চীননীতি’ অনুসরণ এবং তাইওয়ানকে চীনের অংশ বলেই মনে করে। মিসরের এই নীতি চীনের সঙ্গে সম্পর্ককে আরো মজবুত করেছে। ধারণা করা হয়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে বর্তমানে ইরানের পর মিসরের সঙ্গেই সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে চীনের। এই প্রেক্ষাপটে চীন-মিসর মৈত্রীর সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার ৭০তম বার্ষিকী উদযাপনের বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে।

মিসর সাম্প্রতিক বছরগুলোয় চীনের সহায়তায় ভিশন-২০৩০-এর পাশাপাশি ডিসেন্ট লাইফ ইনিশিয়েটিভ, ডিজিটাল ইজিপ্ট স্ট্র্যাটেজি ও ন্যাশনাল ক্লাইমেট চেঞ্জ স্ট্র্যাটেজি ২০৫০ বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। এ ছাড়া মিসর সম্প্রতি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের মধ্যে আন্তঃসংযোগ বাড়ানোর জন্য ন্যাশনাল ডায়ালগ স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করেছে সরকারিভাবে।

চীনের সঙ্গে বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক অংশীদারত্বের ভিত্তিতে গৃহীত এসব প্রকল্পের মাধ্যমে মিসরের অর্থনীতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ওপর গুরুত্ব দিচ্ছে প্রেসিডেন্ট সিসির সরকার। এ জন্য ২০১৬ সালে চীনের সঙ্গে মুদ্রাবিনিময় ও চুক্তি স্বাক্ষর এবং অবকাঠামো প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে কাঠামোগত পরিবর্তন আনার উদ্যোগ নেওয়া হয়। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক ক্রমেই গভীর করছে প্রেসিডেন্ট সিসির সরকার।

দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে প্রেসিডেন্ট সিসি ২০১৪ থেকে চলতি বছর পর্যন্ত তিনবার চীন সফর করেছেন। অন্যদিকে, প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং ২০১৬ সালে মিসর সফর করেন। দুই নেতার এই সফরের মাধ্যমে দেশ দুটির মধ্যে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে জোরালো কৌশলগত অংশীদারত্ব গড়ে তোলা হয়েছে।

‘ছুপা জামায়াতি’ বনাম আসল বিএনপি‘ছুপা জামায়াতি’ বনাম আসল বিএনপি

নিজেদের স্বার্থ রক্ষা, অভিন্ন উন্নয়ন কৌশল অনুসরণ, জনগণের কল্যাণ নিশ্চিত করা ও বৈশ্বিক ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে চীন ও মিসর ধারণা এবং কৌশলবিনিময় করে থাকে। এ ছাড়া দেশ দুটি পরস্পরের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতি অনুসরণ করার পাশাপাশি বহুমেরুর বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রতি সমর্থন দিয়ে আসছে। উভয় দেশই এককেন্দ্রিকতা ও মানবাধিকারের রাজনীতিকরণের বিরোধিতা এবং নতুন ধরনের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রতি সমর্থন দিয়ে থাকে।

চীন মিসরের বৃহত্তম বিদেশি বিনিয়োগকারী দেশ। চীনের আর্থিক সহযোগিতায় মিসরে অনেকগুলো প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। বিশেষ করে দেশটির নয়া প্রশাসনিক রাজধানীর সেন্ট্রাল বিজনেস ডিস্ট্রিক্ট আইন আল-সুখনায় কয়েকটি প্রকল্প, সুয়েজ ক্যানেল স্পেশাল ইকোনমিক জোন প্রকল্প, উচ্চ প্রযুক্তির ইলেকট্রিক ট্রেন প্রকল্প, আল-আলামিন সিটি টাওয়ার প্রকল্পসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় চীনের উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে।

এসব প্রকল্পের মাধ্যমে মিসরের অর্থনীতির আধুনিকায়নের পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মিসরের উন্নয়ন প্রকল্পগুলোয় চীন বিশেষ ছাড়ে ঋণ দেওয়ায় তা দুই দেশের সম্পর্কের ভিত্তিকে আরো মজবুত করেছে। বর্তমানে চীনের সঙ্গে মিসরের বার্ষিক বাণিজ্যের পরিমাণ ১৫০ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

মিসর আফ্রিকার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ হওয়ায় চীন বাণিজ্যিক, অর্থনৈতিক ও কৌশলগত কারণে দেশটিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়। মধ্যপ্রাচ্যে চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতির সঙ্গে মিসরের একটি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। চীনের উপস্থিতি বিশ্বের অন্যতম সংঘাতকবলিত এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের প্রভাবকে খর্ব করার হুমকিতে ফেলেছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তবে চীনের বক্তব্য হচ্ছেÑমধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই তারা এ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।

আবদেল ফাতাহ আল সিসির সরকার ছাড়াও মিসরের বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল বিশেষ করে নেশনস ফিউচার পার্টি, রিপাবলিকান পিপলস পার্টি, ইজিপশিয়ান সোশ্যালিস্ট পার্টি ও তাগাম্মু পার্টিসহ কয়েকটি দল এক চীন নীতির সমর্থক। ফলে এসব দলের সঙ্গে চীন সরকার ও ক্ষমতাসীন দলের ভালো সম্পর্ক রয়েছে, যা মিসরের রাজনৈতিক অঙ্গনে চীনের অবস্থানকে জোরালো করেছে।

এর বাইরে মিসর-চীন ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসোসিয়েশন, কয়েকটি থিংক ট্যাংক প্রতিষ্ঠান, গবেষক, বিশেষজ্ঞ এবং কয়েকটি মিডিয়া মিসরে চীনের পক্ষে কথা বলে ও কাজ করে থাকে। এসব দল ও প্রতিষ্ঠান মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদের সাবেক স্পিকার ন্যান্সি পেলোসির তাইওয়ান সফরের নিন্দা জানিয়ে মিসরের ‘এক চীন নীতি’র প্রতি দৃঢ় সমর্থন জানিয়েছিল।

বেশ কিছু অভিন্ন বিষয় রয়েছে, যা এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের চেয়ে মিসরকে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক দৃঢ় করাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিষয়ে চীন ও মিসর পরস্পরকে সমর্থন জানিয়ে থাকে। গ্লোবাল সাউথ বা বিশ্বের দক্ষিণাঞ্চল বিশেষ করে আরব, আফ্রিকান, ইসলামিক ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর সঙ্গে চীন যে ঘনিষ্ঠ এবং ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা করে চলে, তারই একটি মডেল হচ্ছে চীন-মিসর সম্পর্ক।

আফ্রিকার প্রবেশদ্বার হিসেবে মিসরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক এই মহাদেশে চীনের অবস্থান সংহত করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করেছে। বর্তমানে চীন আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে নানা উন্নয়নমূলক প্রকল্প গ্রহণ করে এসব দেশের অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সহায়তা করছে। ব্রিকস এবং জি-২০-এর মতো সংগঠনেও একসঙ্গে কাজ করছে চীন ও মিসর। দেশ দুটির ক্রমবর্ধমান এই সম্পর্ক মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দীর্ঘদিনের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।

মডার্ন ডিপ্লোমেসি থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী

সূত্র, আমার দেশ