প্রায় শতাব্দী পূর্বের ব্যয় সংকোচনের উপদেশসংবলিত একটি বিজ্ঞাপন যেন আজও সমান প্রাসঙ্গিক! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে ব্রিটিশ ভারত সরকার 'দেশ' পত্রিকায় একটি বিজ্ঞাপন প্রচার করে; যাহার পিছনে উদ্দেশ্য ছিল, দৈনন্দিন ব্যয় কমানোর বিষয়ে জনগণকে সচেতন ও সজাগ করা। 'আরও ব্যয় সংকোচন করুন' শিরোনামে ঐ বিজ্ঞাপনে 'যুদ্ধের জন্য, শান্তির জন্য' খরচ কমানোর আহ্বান জানিয়ে বলা হয়, 'মিতব্যয়ী হইয়া অভাব দূর করুন'। বলা বাহুল্য, মানবসভ্যতার ইতিহাসে এখন পর্যন্ত সংঘটিত সর্ববৃহৎ এবং সবচাইতে ভয়াবহ যুদ্ধ হইল 'দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ'। ইহার পর স্নায়ুযুদ্ধকালে বিশ্বব্যবস্থায় এমন এক নাজুক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় যে, যাহাতে করিয়া মনে হইতে থাকে, এই বুঝি বাধিয়া গেল 'তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ'! গত শতাব্দীর দুই দুইটি বিশ্বযুদ্ধ এবং তাহার রেশ ধরিয়া পূর্ব এবং পশ্চিম ব্লকের শক্তিগুলির মধ্যকার তীব্র উত্তেজনা বিভিন্ন সময় চরম পর্যায়ে উপনীত হইলেও আরেকটি বিশ্বযুদ্ধ, তথা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিভীষিকা এখনো দেখিতে হয় নাই বিশ্ববাসীকে। তথাপি বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা কাটিয়া গিয়াছে, এমন কথা বলার সুযোগও নাই। অর্থাৎ, বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধ হইতে অদ্যাবধি বিশ্বের বুকে থামিয়া থামিয়া যুদ্ধের আগুন জ্বলিয়াই যাইতেছে! আর এই সকল রক্তক্ষয়ী সংঘাতে প্রাণ ঝরিতেছে অগণিত মানুষের। ইরাক, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইউক্রেন গাজাসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে এখনো নানামুখী যুদ্ধ চলিতেছে। ভূরাজনীতি এবং প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের ফলে পরাশক্তিগুলির মধ্যে সংঘাতের ঝুঁকি ক্রমবর্ধমানভাবে বৃদ্ধির ফলে বিশেষজ্ঞদের অনুমান, অতীতের ন্যায় ভবিষ্যতেও ভিন্ন আঙ্গিকে স্নায়ুযুদ্ধ দেখা দিতে পারে। এমন একটি প্রেক্ষাপটে বিশ্লেষকদের সতর্কবার্তা হইল, সেই সকল যুদ্ধ নিশ্চয়ই একতরফা হইবে না। বরং যুদ্ধ বাধিলে জল, স্থল ও আকাশপথে তীব্র আক্রমণের পাশাপাশি পক্ষগুলি জৈব, রাসায়নিক ও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারেও পিছপা হইবে না। ইহার ফলে সংঘাত ছড়াইয়া পড়িবে গোটা বিশ্বে, যাহাতে নিহত হইবে লাখো মানুষ। পরাশক্তিগুলির মধ্যে এই প্রতিযোগিতার বিষয়টি ইতিমধ্যে প্রকাশ্য, যেইখানে নিশ্চিতভাবেই 'সামরিক গন্ধ' পাওয়া যায়! বিশেষ করিয়া বৃহৎ শক্তিগুলির 'দখলবাজ প্রবণতা' আন্তর্জাতিক ব্যবস্থাকেই ফালাইয়া দিতে পারে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্বের মতো বিশ্বের বিভিন্ন সীমান্তে বিরাজমান 'টানটান উত্তেজনা' যেন তারই জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত।
সাম্প্রতিক বৎসরগুলিতে লড়াই কেবল রাষ্ট্রে-রাষ্ট্রে সীমাবদ্ধ নাই, বরং রাষ্ট্রগুলির ভিতরেও যুদ্ধ চলিতেছে। বর্তমানে লস অ্যাঞ্জেলেসে আমরা কী দৃশ্য প্রত্যক্ষ করিতেছি? খোদ আমেরিকার মাটিতে এই ধরনের বিক্ষোভ এবং ধরপাকড়ের চিত্র কি কল্পনা করা যায়? অন্যদিকে, সিরিয়া, ইয়েমেন, ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, মিয়ানমার, লিবিয়া, মিশর, তুরস্ক, সোমালিয়া, নাইজেরিয়া, নাইজার, চাদসহ বিশ্বের বেশ কিছু দেশ বৎসরের পর বৎসর ধরিয়া সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, বিচ্ছিন্নতাবাদ ও জাতিগত সংঘাতে জর্জরিত। এই সকল দেশে রক্তপাত যেন নিয়মিত ঘটনা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এক সাক্ষাৎকারে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন মন্তব্য করিয়াছিলেন, 'কী অস্ত্র দিয়া তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হইবে, তাহা জানি না। তবে চতুর্থ বিশ্বযুদ্ধ হইবে লাঠি আর পাথর দিয়া।' তবে বিশ্বব্যাপী যেইভাবে মারণাস্ত্রের ব্যবহার বৃদ্ধি পাইতেছে, তাহার পরিণতি কী? বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাহার 'কালান্তর' নামক প্রবন্ধে স্পষ্ট করিয়া বলিয়াছেন, 'অস্ত্র কাড়িয়া লইলে নিজের অস্ত্র নির্ভয়ে উচ্ছৃঙ্খল হইয়া উঠে-এইখানেই মানুষের পতন।' অর্থাৎ, হাতে অস্ত্র তুলিয়া লইলে, সেই অস্ত্র দিয়া নির্বিচারে মানুষ হত্যা করিলে, একদিন না একদিন সেই অস্ত্রই নিজের জন্য হন্তারক হইয়া উঠিবে, তাহার আঘাতেই নিঃশেষ হইতে হইবে-ইহাকে 'রিভেন্স অব নেচার' বলা হয়, যাহার সার-অর্থ হইল, মানুষ মানুষকে ক্ষমা করিয়া দিলেও প্রকৃতি মানুষকে কখনোই ক্ষমা করিবে না। যুদ্ধাস্ত্রের পিছনে কী বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়, তাহা কি আমরা ভাবিয়া দেখিয়াছি? যুদ্ধবাজ শক্তিগুলি প্রতি বৎসর যেই কোটি কোটি ডলারের অস্ত্র উৎপাদন করিয়া থাকে, তাহার ব্যয় সংস্থান হইয়া থাকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার হইতে; অর্থাৎ, জনগণের করের টাকায় তৈরি অস্ত্র দিয়া সেই জনগণকেই হত্যা করা হইতেছে-কী নির্মম ট্র্যাজেডি!