বাংলাদেশের রাজনীতিতে চাঁদাবাজি এখন কেবল একটি অপরাধমূলক কার্যকলাপ নয়, বরং এটি হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাচর্চার একটি কাঠামোগত ভাষা। এই ভাষা আমরা শুধু রাজনৈতিক দলের কর্মী, ক্যাডার, ঠিকাদার কিংবা হকার-পর্যায়ে দেখি না—আমরা এটি দেখি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবস্থার গভীরে, আমলাতন্ত্রে, উন্নয়ন প্রকল্পে, নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠানে, এমনকি নাগরিক চেতনারও গায়ে। চাঁদাবাজি এমন একটি অর্থনীতি গড়ে তুলেছে, যা আইনবহির্ভূত হলেও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় বৈধতা লাভ করেছে। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা, রাজনৈতিক আনুগত্য ও পুঁজির প্রবাহ—এই তিনের একটি অভিন্ন জোট এই অর্থনীতিকে দীর্ঘস্থায়ী করে তুলেছে।
এই অর্থনৈতিক ব্যবস্থাটি কেবল শাসকের লোভের ফল নয়, বরং এটি রাষ্ট্র গঠনের একটি নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক প্যাটার্নের ফসল। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি গড়ে উঠেছে ঔপনিবেশিক শাসন ও পাকিস্তানি বঞ্চনার পটভূমিতে, যেখানে রাষ্ট্র মানেই ছিল নিয়ন্ত্রণ, শোষণ ও দমন। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমরা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলাম, কিন্তু ১৯৭৫ সালে প্রথমে ‘বাকশাল’ এবং পরে রাজনৈতিক বিপর্যয়ের মধ্য দিয়ে সেই প্রজেক্ট স্থগিত হয়ে যায়। সামরিক শাসন এবং পরে নির্বাচনী ছদ্মবেশে গড়ে ওঠা ক্ষমতাকেন্দ্রিক দলীয় শাসনব্যবস্থা আসলে জনগণের প্রতিনিধিত্ব নয়, বরং পৃষ্ঠপোষকতানির্ভর লুটপাটমূলক কাঠামো তৈরি করে।
বিশেষ করে ২০০৯ সালের পর থেকে আওয়ামী লীগ যে ফ্যাসিবাদী শাসন কাঠামো গড়ে তুলেছে, তা কেবল ভোটডাকাতি, বাকস্বাধীনতা দমন বা গুম-খুনে সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং এটি একটি সর্বব্যাপী অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছে, যেখানে দলের ছাত্রসংগঠন থেকে শুরু করে শ্রমিক সংগঠন পর্যন্ত, প্রতিটি ইউনিট হয়ে উঠেছে চাঁদা আদায়ের ‘সরকারি বাহিনী’। এই কাঠামোতে সহিংসতা কেবল রাস্তার নয়, এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে, পরিবহনের স্ট্যান্ডে, বস্তিতে, বন্দরে, এমনকি স্কুলের মাঠেও ছড়িয়ে পড়ে। এটি ম্যাক্স ওয়েবারের ‘রাষ্ট্রের সহিংসতার একচেটিয়া ক্ষমতা’ ধারণার বিপরীত চিত্র—বাংলাদেশে সহিংসতা ‘ডেলিগেটেড’ হয়ে গেছে নানা অনানুষ্ঠানিক শক্তির হাতে।
ফলে রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে দুটি সমান্তরাল কাঠামোর সমন্বয়—একটি ‘ফরমাল’ রাষ্ট্র, যেখানে রয়েছে সংবিধান, আইন ও আমলাতন্ত্র; আরেকটি ‘ইনফরমাল রাষ্ট্র’, যেখানে রয়েছে দলীয় ক্যাডার, সন্ত্রাসী, ঠিকাদার ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা। এই ইনফরমাল রাষ্ট্রই হয়ে উঠেছে চাঁদাবাজি অর্থনীতির মূল ভিত্তি। আপনি একটি মার্কেটে ব্যবসা করবেন, একটি সড়কে গাড়ি চালাবেন, একটি প্রজেক্টে কাজ করবেন—সর্বত্রই ‘ভাড়া’ দিতে হবে। সরকারি ট্যাক্স নয়, বরং ক্ষমতার ছত্রছায়ার জন্য এই অর্থ প্রদান করতে হবে।
এই অর্থনীতিকে আমরা চাইলে ‘ইনফরমাল কর ব্যবস্থা’ বলেও বুঝতে পারি, যেখানে রাষ্ট্র তার দায়িত্ব এড়াতে একটি ‘আউটসোর্সড লুটপাট কাঠামো’ গড়ে তোলে। এই কাঠামো এমনভাবে কাজ করে যে, নাগরিকেরা জানেন তারা কীভাবে নিরাপত্তা ও সুযোগ কিনবেন, ঠিক যেভাবে অন্য কোথাও কর দিয়ে সরকারি সেবা পাওয়া যায়। পার্থক্য হলো—এখানে প্রতিদান নেই, আছে ভয় ও দাসত্ব।
চাঁদাবাজির এই অর্থনীতির শ্রেণিগত নির্মাণও গুরুত্বপূর্ণ। পরিবহন শ্রমিক, হকার, নিম্নমধ্যবিত্ত কর্মী—এরা এই ব্যবস্থার শিকার, কিন্তু একপর্যায়ে এর অংশীদারও। রাজনীতিতে ঢুকে তারা কিছু সুযোগ পায়, প্রভাব তৈরি করে এবং আবার সেই চক্রেই পুঁজি ঢালে। এই পুঁজির প্রবাহ স্থানীয় থেকে কেন্দ্রীয় হয়ে ওঠে এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের হাতে জমা হয়। ফলে এটি কেবল নিচুস্তরের দুর্নীতি নয়—এটি একটি ‘bottom-up loot flow’, যা কেন্দ্রীয় শাসনের শক্তি জোগায়।
২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান এই কাঠামোর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়ার ফলাফল। মানুষ রাষ্ট্রের এই দখলদারত্ব, ফ্যাসিবাদী নিয়ন্ত্রণ ও লুটপাটমূলক অর্থনীতির বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমেছিল। অভ্যুত্থান একটি বিরল সুযোগ তৈরি করেছিল রাষ্ট্র ও রাজনীতির কল্পনায় পরিবর্তনের। কিন্তু অভ্যুত্থানের পরে আমরা যা দেখলাম, তা হলো ক্ষমতার স্থানান্তর, কাঠামোর পরিবর্তন নয়। পুরোনো অলিগার্কিক সিন্ডিকেট ভেঙে নতুন দল ও নতুন নেতা এলেও চাঁদাবাজি ইকোনমি অক্ষতই রয়ে গেছে।
এনসিপি (ন্যাশনাল কনসেন্সাস পার্টি) প্রথমদিকে অভ্যুত্থানের প্রতিনিধি শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হলেও তারা খুব দ্রুতই পুরোনো পথেই হাঁটতে শুরু করে। যদিও তারা নিজেদের অর্থনৈতিক মডেল জনসমক্ষে প্রকাশ করেছে, কিন্তু তৃণমূল পর্যায়ে দলের অনেক কর্মীদের বিরুদ্ধে চাঁদা আদায়, ঠিকাদারি নিয়ন্ত্রণ ও দোকান ভাড়া আদায়ের অভিযোগ উঠে এসেছে। একইভাবে দীর্ঘদিন ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপিও ২০২৪-পরবর্তী জন-আকাঙ্ক্ষার ঢেউয়ে নতুন করে সক্রিয় হলেও তাদের স্থানীয় নেতৃত্বেও একই সিন্ডিকেটিক প্যাটার্ন বেশ জোরেশোরে দেখা গেছে।
এখানে একটি গভীর সমাজতাত্ত্বিক সত্য প্রকাশ পায়—ক্ষমতা যদি উৎপাদন নয়, বরং লুটপাটের ভিত্তিতে গড়ে ওঠে, তাহলে যে দলই ক্ষমতায় আসুক, সে দলই একই কাঠামোয় আটকে পড়ে। একে বলা হয় institutional lock-in, যেখানে পুরোনো শাসন কাঠামোর জটিলতা নতুন রাজনীতিকে হাইজ্যাক করে ফেলে। ফলে অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে নতুন দল প্রতিষ্ঠা করলেই রাজনীতি বদলায় না—যতক্ষণ না সেই দল আদর্শিক, গণতান্ত্রিক, বিকেন্দ্রীকৃত ও স্বচ্ছ সংগঠন হিসেবে গড়ে ওঠে।
এই রাজনৈতিক ব্যর্থতার পেছনে রয়েছে আরেকটি সামাজিক সত্য—মানুষ এখনো রাজনীতিকে আদর্শ নয়, সুবিধার কেন্দ্র হিসেবে দেখে। এই ধারণা এক দিনে তৈরি হয়নি। ঔপনিবেশিক ও পোস্ট-ঔপনিবেশিক বাংলাদেশে রাষ্ট্র কখনোই জনগণের অধিকারপ্রাপ্ত প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠেনি; বরং রাষ্ট্র ছিল ক্ষমতার কেল্লা, যেখানে প্রবেশের একমাত্র পথ ছিল আনুগত্য ও সংযোগ। ফলে জনগণ এখনো টিকা কার্ড, মামলা-মোকদ্দমা, ভাতা, হোল্ডিং নম্বর, কিংবা লাইসেন্স পাওয়ার জন্য রাজনীতির সঙ্গে নিজেকে জড়ায়। চাঁদাবাজি এই সংস্কৃতিরই অর্থনৈতিক রূপ।
চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সংগ্রাম কেবল আইনশৃঙ্খলা রক্ষা নয়, এটি এক বৃহৎ সামাজিক পুনর্গঠনের অংশ। এটি মানে রাষ্ট্র, রাজনীতি ও সমাজের সম্পর্ক নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করা। রাজনীতিকে পেশা নয়, সেবা হিসেবে দেখা; সংগঠনকে ক্লায়েন্টেলিস্টিক নেটওয়ার্ক থেকে গণতান্ত্রিক কাঠামোয় রূপান্তর করা এবং অর্থনীতিকে নিয়ন্ত্রণ নয়, উৎপাদনমুখী প্রবৃদ্ধির ভিত্তিতে নির্মাণ করা।
আমরা যদি অভ্যুত্থানকে সত্যিই ইতিহাসের টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে দেখতে চাই, তাহলে আমাদের এই চাঁদাবাজির ইকোনমি ভেঙে নতুন অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কাঠামো নির্মাণ করতে হবে; নতুবা আমরা শুধু শাসক বদলাব, শাসনের ধরন নয়। আর এতে গণ-আকাঙ্ক্ষার সবচেয়ে বড় পরাজয় হবে।
লেখক : শিক্ষক ও গবেষক