ইসরাইল আর ফিলিস্তিনিদের তিক্ত সংঘাত নিরসনে আমেরিকার বহু প্রেসিডেন্ট চেষ্টা করে গেছেন। এখন ৭ অক্টোবরের ঘটনার দুই বছর পর এবং গাজায় অগণিত হত্যাকাণ্ডের পর ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্টদের সেই ছোট্ট তালিকায় নাম লেখালেন, যারা তাদের প্রচেষ্টায় সফল হয়েছিলেন। যুদ্ধ বন্ধ এবং জিম্মিদের মুক্তি দেওয়ার জন্য ইসরাইল আর হামাসের মধ্যে যে চুক্তি হলো, এই চুক্তি মধ্যপ্রাচ্যের জন্য নতুন ভিশন উন্মুক্ত করতে পারে। এই পথটা সংকীর্ণ, কিন্তু ১৯৯৩ ও ১৯৯৫ সালের ওসলো চুক্তির পর স্থায়ী শান্তি স্থাপনের এটাই সবচেয়ে ভালো সুযোগ।
ওসলো চুক্তিতে যে অকার্যকর কৌশল নেওয়া হয়েছিল, সেই তুলনায় নতুন ভিশন মৌলিকভাবে আলাদা। মানচিত্র নিয়ে যে অন্তহীন বিমূর্ত সংলাপ এবং দুই রাষ্ট্র সমাধানের জন্য যেসব কাল্পনিক সাংবিধানিক আয়োজন, সেখান থেকে বের হয়ে এসেছে এই চুক্তি। এর বদলে এখানে বাস্তবমুখী কৌশল নেওয়া হয়েছে। এই কৌশলে গাজার যখন পুনর্গঠন ও শাসন চলবে, তখন (পশ্চিমা বিবেচনায়) সেসব সন্ত্রাসীর কবল থেকেও এই অঞ্চল মুক্ত করা হবে, যারা একসময় এখানে কর্তৃত্ব করেছে। ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিদের এই বিশ্বাসে নিয়ে আসার চেষ্টা করা হয়েছে যে, পরস্পরকে ধ্বংস করে নয়, বরং সহাবস্থান করলেই তারা বেশি অর্জন করতে পারবে। সাফল্যকে আগের মতো হোয়াইট হাউসের আয়োজন মনে হচ্ছে না; বরং গাজায় এক দশক ধরে ঘুরতে থাকা সিমেন্ট মিক্সার মেশিনের মতো মনে হচ্ছে। পশ্চিম তীরে সহিংস দখলদারদের নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। মিসাইলের হুমকি কমছে। সাধারণ মানুষ ধীরে ধীরে বিশ্বাস করতে চেষ্টা করছে যে, একটা নিরাপদ ও আরো সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ হয়তো সম্ভব।
ট্রাম্পের যে বিনিময় স্টাইলের জোর প্রয়োগের কূটনীতি, এই শান্তি চুক্তি সেই কূটনীতির একটা অন্যতম অর্জন। মিসরের শার্ম আল শেখে দুই পক্ষের জটিল দর কষাকষির মধ্য দিয়ে এটা অর্জিত হলো। দুই পক্ষকে রাজি করতে সেখানে আমেরিকা, মিসর, কাতার, আর তুরস্কের প্রতিনিধিরাও হাজির ছিলেন। আলোচনার বিস্তারিত এখনো প্রকাশ্যে আসেনি। তবে ইসরাইলি জিম্মিদের মধ্যে যে ২০ জন এখনো জীবিত আছেন, তাদের হামাস ছেড়ে দিতে যাচ্ছে। একইভাবে ইসরাইলের কারাগার থেকেও ফিলিস্তিনি বন্দিদের ছেড়ে দেওয়া হবে। সেই সঙ্গে গাজায় ত্রাণের বন্যা ঢুকবে, আর গাজার প্রধান শহরগুলো থেকে আংশিক সেনা সরিয়ে নেবে ইসরাইলি সেনাবাহিনী। ট্রাম্প বলেছেন, এসব শর্তে উভয় পক্ষ একমত হয়েছে। ইসরাইল ও গাজার যেটুকু অবশিষ্ট আছে, সেখানে এই খবরে আনন্দের জোয়ার বইছে। ট্রাম্প চুক্তি উদযাপনের জন্য চাইলে ওই অঞ্চলে উড়ে যেতে পারেন।
ট্রাম্পের ২০ দফা পরিকল্পনা অনুযায়ী, পরবর্তী পদক্ষেপ হবে গাজা পুনর্গঠনের জন্য টেকনোক্র্যাট সরকার গঠন। এই সরকার গাজার ক্ষমতা থেকে হামাসকে সরাবে। হামাসকে অস্ত্রমুক্ত করা হবে এবং এই অঞ্চলের নিরাপত্তা দেবে একটি আন্তর্জাতিক বাহিনী। পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণের জন্য ট্রাম্পের সভাপতিত্বে একটি বোর্ড কাজ করবে যতদিন না ফিলিস্তিনিরা তাদের দায়িত্ব বুঝে নেয়। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে পুনর্গঠিত করে এই দায়িত্ব হস্তান্তর করা হতে পারে। চুক্তির বৃহত্তর ও চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো ইসরাইল আর ফিলিস্তিনি সব ভূখণ্ডের মধ্যে ‘চিরস্থায়ী শান্তি’। ট্রাম্প তেমনটাই বলেছেন।
সন্দেহ নেই, অগ্রগতির সামনে বাধা অনেক। থাকবে নাইবা কেন? উভয় পক্ষের আলোচকদের এখন তাদের মতপার্থক্যগুলো দূর করতে হবে। এই ধরনের একটি বিষয় হলো হামাসকে অস্ত্রমুক্ত করা। তারা শর্তে রাজি হতে পারে। আবার ভেতরে ভেতরে পরে পাল্টা আঘাত হানার প্রস্তুতিও নিতে পারে। গাজার ভবনগুলোর মধ্যে ৭৮ শতাংশই ধ্বংস হয়ে গেছে। শিল্প অবশিষ্ট আছে খুবই সামান্য। এই অবস্থায় পুনর্গঠনের কাজটা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। সবচেয়ে বড় বিষয় হলো, সাধারণ ইসরাইলি আর ফিলিস্তিনিরা শান্তির সম্ভাবনা নিয়ে বিশ্বাস হারিয়েছে।
ওসলো চুক্তির পর ৩০ বছর পেরিয়ে গেছে। সেইসঙ্গে যুক্ত হয়েছে ৭ অক্টোবরের ট্রমা। সব মিলিয়ে অধিকাংশ ইসরাইলি ইহুদি ফিলিস্তিনি অঞ্চলগুলোকে ব্যর্থ আধা-রাষ্ট্র হিসেবে দেখে, যেখানে দুর্নীতি, সন্ত্রাসবাদ আর ইহুদিবিদ্বেষ বাসা বেঁধেছে। ২০১২ সালে ৬১ শতাংশ ইসরাইলি দুই রাষ্ট্র সমাধানকে সমর্থন দিয়েছিল। এখন চার ভাগের এক ভাগের মতো ইসরাইলি এটাকে সমর্থন করে। শুধু তা-ই নয়, অধিকাংশ ইসরাইলি ফিলিস্তিনিদের জীবনহানির বিষয়টি নিয়ে চরম উদাসীন। ফিলিস্তিনিরা তাদের জায়গা থেকে ইসরাইলকে সন্ত্রাসী রাষ্ট্র মনে করে, যারা তাদের ভূখণ্ডের দখল নিতে এবং নিয়মিত সহিংসতা চালিয়ে যেতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। মে মাসে পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, ৫০ শতাংশ ফিলিস্তিনি ৭ অক্টোবরের হামলাকে সমর্থন করে। ৮৭ শতাংশ মনে করে না যে, হামাস কোনো অন্যায় করেছে এবং ৪১ শতাংশ ফিলিস্তিনি সশস্ত্র প্রতিরোধকে সমর্থন করে।
এরপরও আশার কারণ রয়েছে। যুদ্ধ শেষ হলে উভয় পক্ষেই নেতৃত্বে পরিবর্তনের সুযোগ তৈরি হবে। হামাসের যারা অবশিষ্ট থাকবে, তাদের গাজার শাসনকাঠামো থেকে জোর করে সরিয়ে দেওয়া হবে। ইসরাইলকেও ১২ মাসের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। জরিপে দেখা গেছে, নির্বাচন হলে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে অফিস ছাড়তে হবে এবং এর মাধ্যমে কট্টরপন্থি ডানপন্থিদের সঙ্গে তার জোটের অবসান ঘটবে।
দেশের বাইরেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। সারা বিশ্বে মানুষের মনোযোগ এখন শান্তির দিকে। বহু বছর তারা মুখ ফিরিয়ে রেখেছিল। আমেরিকা ট্রাম্পের মতো একজন প্রেসিডেন্ট পেয়েছে, যিনি ইসরাইলকে চাপ দিতে ভীত নন। ইরান সরকার ও তাদের সহিংস প্রক্সি গোষ্ঠীগুলোকে শান্ত করার মাধ্যমে এই অঞ্চলে হুমকি অনেকটাই কমে গেছে। উপসাগরীয় আরব রাষ্ট্রগুলো গাজার পুনর্গঠনের জন্য শুধু অর্থই দেবে না, বরং তারা শান্তি প্রক্রিয়ার সঙ্গেও যুক্ত হবে। নিরাপত্তা দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা ভূমিকা রাখতে যাচ্ছে, যেটা একটা বড় পদক্ষেপ।
এর সঙ্গে সঙ্গে বাইরের শক্তিগুলোকেও উভয় পক্ষকে উসকানি দেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। ইরানের ওপর যুদ্ধ বন্ধ করতে ইসরাইলকে চাপ দিয়ে, কাতারে হামলার জন্য তাদের বকা দিয়ে এবং বন্দিবিনিময়ে তাকে রাজি করানোর ধারাবাহিকতায় ট্রাম্পকে নেতানিয়াহু ও তার উত্তরসূরিকে চাপ দেওয়া অব্যাহত রাখতে হবে, যাতে তারা ইহুদি বসতি সম্প্রসারণ বন্ধ করে। তাকে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে আরো শক্তিশালী করতে হবে। ইসরাইল যেভাবে ফিলিস্তিনিদের কাস্টমস রাজস্ব থেকে বঞ্চিত করছে এবং বসতি স্থাপনকারী ও সেনারা যেভাবে ফিলিস্তিনিদের ওপর নজরদারি করছে, সেটা বন্ধ করতে হবে। আরব রাষ্ট্রগুলোকে তাদের সব প্রভাব কাজে লাগিয়ে সহিংসতা বন্ধে ফিলিস্তিনিদের রাজি করাতে হবে। ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে পুনর্গঠনের মাধ্যমে নতুন নেতা খুঁজে নিতে সাহায্য করতে হবে।
তাদের একইসঙ্গে বৃহত্তর ভিশন সামনে আনতে হবে। ইসরাইলিদের জন্য এটা নতুন আঞ্চলিক নিরাপত্তা ব্যবস্থার সম্ভাবনা, যেটা আরব রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সহযোগিতা জোরদারের মাধ্যমে তাদের আরো নিরাপদ করবে। আব্রাহাম অ্যাকোর্ডের ওপরে ভিত্তি করে এই সহযোগিতা আরো এগিয়ে যাবে, যেটা ২০২০ সালে থমকে গিয়েছিল। এটা সিরিয়ার সঙ্গে নতুন যোগসূত্র তৈরিতে সাহায্য করতে পারে। লেবাননও এগিয়ে আসতে পারে। এই দুই দেশই ইরানের বলয় থেকে বেরিয়ে এসেছে। ফিলিস্তিনিদের জন্য এটা দেশের পুনর্গঠনের সুযোগ নিয়ে এসেছে। সেইসঙ্গে উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে বাণিজ্য আর কর্মসংস্থানের মাধ্যমে নতুন অর্থনৈতিক যোগাযোগ সৃষ্টিরও সুযোগ এসেছে তাদের সামনে।
গাজা এখানে মূল চাবিকাঠি। ফিলিস্তিনিরা সবখানে দেখতে চাইবে, ইসরাইল গাজার টেকনোক্র্যাট সরকারের প্রতি আস্থা রাখতে পারে কি না, যেটা আন্তর্জাতিক সমর্থন নিয়ে গঠিত হতে যাচ্ছে। ইসরাইল নিজেদের দিক থেকে দেখতে চাইবে—গাজার ফিলিস্তিনিরা নিজেদের আরো ভালোভাবে শাসন করতে পারে কি না, তারা সামরিক অবকাঠামো ও হামাসের নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রতিষ্ঠানগুলো পুনর্গঠন করতে পারে কি না।
কারোই মনে করা উচিত হবে না, এই প্রক্রিয়াটা সহজ হবে। যুদ্ধবিরতি অর্জনে ট্রাম্পকে যে বিষয়গুলো সাহায্য করেছে, সেগুলো হলো তার বল প্রয়োগের ইচ্ছা, সামরিক তৎপরতা বাড়ানো এবং পরিস্থিতির গুরুত্বকে অতি জরুরি করে তোলা। কিন্তু পুনর্গঠন কর্তৃপক্ষের প্রধান হিসেবে আগামী বহু বছর ধরে যে টেকসই প্রতিশ্রুতি দরকার হবে, সেটা তার এসব বৈশিষ্ট্য থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। তারপরও যে অঞ্চল বহু দশকের সংঘাত ছাড়া তেমন কিছুই দেখেনি, সেখানে এই মুহূর্তটা অসামান্য। সামান্য হলেও সত্যিকারের নতুন সূচনার একটা সুযোগ এখানে এসেছে।
দ্য ইকোনমিস্ট থেকে ভাষান্তর : জুলফিকার হায়দার