ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে হাসিনার পতনের পর জামায়াতে ইসলামী প্রধান রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। জামায়াতের সাংগঠনিক শক্তি ও অঞ্চলভিত্তিক ভোটপ্রাপ্তি সবসময় বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। ১৯৯১ সালে বিএনপি সরকার গঠন ও ২০০১ সালে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকারে অংশগ্রহণ এর বড় প্রমাণ। এখন প্রশ্ন উঠেছে, পরিবর্তিত রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জামায়াত আগামীদিনে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। গত দেড় দশকে শেখ হাসিনার শাসনে জামায়াতে ইসলামীর নেতা কর্মীরা বড় ধরনের নিপীড়নের মধ্য দিয়ে গিয়েছে। বহু নেতাকর্মী জেল, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয়েছেন। তবে সবচেয়ে বড় আঘাত ছিল দলটির প্রথমসারির পাঁচজন নেতার মৃত্যুদণ্ড। এ ছাড়া কারাগারে মারা গেছেন আরো ছয়জন। ফলে দলের মধ্যে বড় ধরনের নেতৃত্বের শূন্যতা যেমন তৈরি হয়েছে, তেমনি নতুন নেতৃত্ব তৈরির পথ তৈরি হয়েছে। একটি বিষয় স্পষ্ট, গত দেড় দশকে হাসিনা সরকার জামায়াতে ইসলামীর সাংগঠনিক কাঠামো এবং দলটির জনশক্তি তৈরির যে প্রক্রিয়া, তাতে কোনো বাধা সৃষ্টি করতে পারেনি। বরং নারীদের মধ্যে জামায়াতের কার্যক্রম বেড়েছে- এমন ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। এই প্রথম জামায়াতের নারী নেতারা বিদেশি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীদের সংগঠন ইসলামী ছাত্রী সংস্থা প্রকাশ্যে তাদের কমিটি গঠনের কথা জানান দিয়েছে। শেখ হাসিনা সরকার নিপীড়নমূলক চেষ্টা চালিয়েও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ইসলামী ছাত্রশিবিরের কার্যক্রম বন্ধ করতে পারেনি। বরং আন্ডার গ্রাউন্ডে তারা পুনঃউদ্যমে কাজ করেছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ইসলামী ছাত্রশিবিরের সক্রিয় অংশগ্রহণ তার বড় প্রমাণ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশক্তির নাহিদ-আসিফ ও মাহফুজরা কোটাবিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিলেও এই আন্দোলনকে সংগঠিত ও ছড়িয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে ইসলামী ছাত্রশিবির যে প্রধান ভূমিকা পালন করেছে, তা সে সময় স্পষ্টভাবে বোঝা গেছে। আলী আহসান জোনায়েদ ও রাফে সালমান রিফাতসহ শিবিরের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাবেক সভাপতিরা এই আন্দোলনের পেছনে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করেছে। এ ছাড়া সাদিক কায়েম ও এস এম ফরহাদদের ভূমিকা ছাত্রনেতৃত্বের মধ্যে অজানা ছিল না। মনোনয়ন বাগাতে ব্যস্ত বিএনপি নেতারা, ভোট বাড়াচ্ছে জামায়াতমনোনয়ন বাগাতে ব্যস্ত বিএনপি নেতারা, ভোট বাড়াচ্ছে জামায়াত ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের একটি বড় বৈশিষ্ট্য ছিল আন্দোলনে সব মত ও পথের ছাত্ররা এক মঞ্চে আসতে পারা। এখানে রাজনৈতিক, ধর্মীয় পরিচয় কিংবা পোশাক দিয়ে কাউকে আলাদ করা হয়নি। এই ঐক্যের কারণে স্বৈরশাসন কায়েমের মূল ন্যারেটিভ মুক্তিযুদ্ধের চেতনার গল্প ছাত্ররা প্রত্যাখ্যান করেছে। জামায়াত ও শিবির খুব বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে বৈচিত্র্যকে গ্রহণ করেছে। তারা সম্ভবত বুঝতে পারে জাতীয় ঐক্য ও বহুমতের সম্মিলন ইসলামপন্থিদের জন্য সুবিধা দেবে। কিন্তু ইসলামপন্থিরা আগামীদিনের রাজনীতিতে এই বৈচিত্র্য ধরে রাখতে পারবে কি নাÑতা এখন বড় প্রশ্ন। অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে আমরা জামায়াতের রাজনীতিতে কিছু পরিবর্তন দেখতে পারছি। ক্যাডারভিত্তিক রাজনৈতিক দলটি অনেকটা আধা গণমুখী দলে (সেমি মাস পার্টিতে) রূপ নেওয়ার চেষ্টা করছে। জামায়াতে ইসলামীর আমিরের কার্যক্রমের মধ্যে এক ধরনের গণমুখী চরিত্রের রূপ দেখা যাচ্ছে, যা আগের নেতাদের মধ্যে এতটা চোখে পড়েনি। এর ফলে তিনি অনেক বেশি আকর্ষণীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছেন। তার এক ধরনের জনপ্রিয়তা তৈরি হয়েছে। কিন্তু ক্যাডারভিত্তিক রাজনৈতিক দলের গণমুখী (মাস পার্টি) দলে রূপান্তরের কিছু নেতিবাচক প্রভাব আছে- দলের নেতাকর্মীদের নৈতিক ও আদর্শিক মান ধরে রাখার ক্ষেত্রে দলটি চাপের মুখে পড়তে পারে। বাড়তে পারে দলের মধ্যে টানাপোড়েন। স্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজনে কতটা প্রস্তুত ইসিস্বচ্ছ নির্বাচন আয়োজনে কতটা প্রস্তুত ইসি ভোটের রাজনীতিতে জামায়াতে ইসলামীর কৌশল কী হবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। দলটি ইতোমধ্যে ২৮৯টি আসনে তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে। এর আগে জামায়াত ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দিয়ে নির্বাচন করে মাত্র তিনটি আসনে বিজয়ী হয়েছিল।
এবারও বিপুলসংখ্যক আসনে প্রার্থী দেওয়া জামায়াতের ভোটের রাজনীতিতে কতটা ইতিবাচক ফল আনবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। কারণ বিগত নির্বাচনগুলোয় জামায়াতের ভোটের প্যাটার্ন লক্ষ করলে দেখা যাবে, দলটি নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলে ভালো ফলাফল করে। সারা দেশে দলটির সাংগঠনিক অবস্থা এক রকম নয়। দেড় দশকের নিপীড়ন ও অভ্যুত্থানে সক্রিয় অংশগ্রহণের কারণে এবার হয়তো জামায়াতের ভোট বাড়তে পারে। তবে এবার দলটির জন্য বড় চমক হতে পারে বৃহত্তর রংপুরের আসনগুলোয়। ভোটের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি ও জাতীয় পার্টির প্রতি সাধারণ মানুষের ক্ষোভের কারণে এসব এলাকায় জামায়াত ভালো করতে পারে। এ ছাড়া এ অঞ্চলে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল। তবে বিপুলসংখ্যক আসনে প্রার্থী দেওয়ার কারণে আর্থিক ও সক্রিয় জনবলের অভাবে পড়তে পারে দলটি। দুনিয়ার বহুদেশে ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলগুলো এক ধরনের ফ্যান্টাসিতে ভোগে, বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। এসব দল নিজেদের শক্তিকে অনেক বেশি উচ্চমাত্রায় পরিমাপ করে, যা বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। জামায়াতের অভ্যন্তরীণ সূত্রগুলোর মতে নির্বাচন সামনে রেখে তারা যে প্রাথমিক জরিপ করেছে, তাতে আগামী নির্বাচনে দলটি অন্তত ৮০টি আসনে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে। এসব আসনের বেশির ভাগে বিজয়ী হওয়ার আশা করে দলটি। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এবার জামায়াতকে মোকাবিলা করতে হবে বিএনপির প্রার্থীর সঙ্গে। উভয় দলের রিজার্ভ ভোটের টার্গেট গ্রুপ এক। সংখ্যালঘু ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ভোট গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে। ফলে নির্বাচনের সময় যত এগিয়ে আসবে, ভোটের মেরূকরণ তত বাড়তে থাকবে। ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচনের সময়সীমা নির্ধারণ হওয়ার পর এখন বিএনপি প্রার্থীরা নির্বাচনের মাঠে সক্রিয় হবেন। পরিস্থিতি দ্রুত বদলাতে থাকবে। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে অন্য ইসলামপন্থি দলগুলোর জোট নিয়ে আলোচনা আছে। তবে এ ধরনের জোট জামায়াতের জন্য বাড়তি সংকট তৈরি করতে পারে। কারণ এদেশের শহুরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির বড় অংশ যেকোনো ইসলামপন্থি দলের বক্তব্য বা অবস্থানকে জামায়াতের অবস্থান বলে ধরে নেয়। ফলে যেকোনো ইসলামপন্থি দলের নেতার বক্তব্য জামায়াতের বক্তব্য হিসেবে ধরে নেওয়া হতে পারে। বিশেষ করে নারী ও ইসলামি আইন বিষয়ে ইসলামপন্থি নেতাদের প্রান্তিক অবস্থানের কারণে জামায়াতকে চরম মূল্য দিতে হতে পারে। এ ছাড়া দু-একটি আসন ছাড়া অন্য কোথাও ইসলামপন্থি দলগুলোর ভোটের দিক দিয়ে শক্ত অবস্থানে নেই। এ ক্ষেত্রে সম্ভবত আসন সমঝোতা একটি ভালো উপায় হতে পারে। তবে জামায়াতসহ ইসলামপন্থি দলগুলোর জন্য তাদের জিহ্বা নির্বাচনি প্রচারণার ক্ষেত্রে বড় সমস্যা হিসেবে দেখা দিতে পারে। কারণ এবারের আন্দোলনে নারীদের অনেক বেশি অংশগ্রহণ ছিল। নারীদের ব্যাপারে ইসলামপন্থি দলগুলোর অবস্থান কী হয়, সেদিকে সবার দৃষ্টি থাকবে। একাত্তর প্রশ্ন এবারের নির্বাচনে হয়তো ততটা বড় আকারে নাও আসতে পারে। এর প্রধান কারণ, শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধ বাণিজ্যে তরুণ প্রজন্ম ক্ষুব্ধ। এ ছাড়া একাত্তরের সঙ্গে সক্রিয় থাকা জামায়াতের প্রথমসারির নেতারা প্রায় কেউ আর বেঁচে নেই। এখন যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের প্রায় সবাই একাত্তর-পরবর্তী প্রজন্ম। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এটি জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির অ্যাকলিস হিল। সময়ে সময়ে এই ইস্যু ঘুরেফিরে আসবে। ফলে নতুন প্রজন্মের জামায়াতের নেতৃত্বকে এই প্রশ্নের মীমাংসা না করে ঝুলিয়ে রাখা দীর্ঘ মেয়াদে ভালো ফল বয়ে আনবে না। আজ হোক কাল হোক, তাদের অবস্থান স্পষ্ট করতে হবে। বাংলাদেশের ইসলামপন্থি রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরা অনেক বেশি আবেগপ্রবণ। গত দেড় দশকের শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি ও নিপীড়নের পর মুক্ত পরিবেশ তাদের আবেগ প্রকাশকে অবারিত করেছে। রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী সম্ভবত সবচেয়ে মিডিয়ায় বৈরী প্রচারণার শিকার হয়েছে। অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে প্রথম জামায়াত মূলধারার মিডিয়ায় ভালো কাভারেজ পেয়েছে। কিন্তু নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, জামায়াত নেতাদের মিডিয়ার মুখোমুখি হতে হবে। এ ক্ষেত্রে জামায়াতের দুর্বলতা সীমাহীন। সোশ্যাল মিডিয়ায় হয়তো জামায়াত বা শিবিরের শক্ত অবস্থান আছে। দলের প্রচার ও প্রচারণায় ভালো ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত মূলধারার মিডিয়ায় যেকোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষে-বিপক্ষে ন্যারেটিভ তৈরি করে। সে ক্ষেত্রে জামায়াতকে আগামী দিনে এই পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হবে।
লেখক: সহযোগী সম্পাদক, আমার দেশ