পদত্যাগ করেছেন ব্রিটেনের উপ-প্রধানমন্ত্রী অ্যাঞ্জেলা রেনার। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠেছিল সম্পত্তি কেনার সময় সঠিক তথ্য গোপন করেছেন। ৪০ হাজার পাউন্ডের তথ্য গোপন করা স্টাম্প ডিউটি থেকে বঞ্চিত হয় দেশ। তথ্যে গরমিল থাকার অভিযোগ উঠলে দায় স্বীকার করেন এবং উপ-প্রধানমন্ত্রীর পদ ছেড়ে দেন। ৪ সেপ্টেম্বর (২০২৫) তার পদত্যাগের এ ঘটনা ঘটেছে। পদত্যাগপত্রে অ্যাঞ্জেলা লিখেছেন, ‘বিশেষজ্ঞ কর পরামর্শ না নেওয়াটা আমার বড় ভুল ছিল। এর সম্পূর্ণ দায় আমি নিচ্ছি।’
এ ঘটনা নতুন কিছু নয়। ব্রিটিশ ভ্যালুস বলে কথা। কেউ মিথ্যা তথ্য দেবে আবার রাষ্ট্রীয় পদে থাকবে, তা কল্পনাও করা যায় না। অপরাধ করবেন। তারপর ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে পার পেয়ে যাবেন! এমন চিন্তা করাটাও এখানে অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। ২০২৪ সালে জুলাই মাসে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে লেবার পার্টি। কিন্তু এই সোয়া বছরে ৯ জন মন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হয়েছে এ রকম নানা অভিযোগে। আরো কয়েকজনের পদত্যাগের কারণ নিচে উল্লেখ করলাম। এখান থেকে বোঝে নিতে হবে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কতটা শক্তিশালী। যদিও বাংলাদেশের মতো ব্রিটিশ রাজনীতিকদের মুখে কথায় কথায় গণতন্ত্রের বুলি বা সস্তা চেতনার বয়ান শোনা যায় না। এখানে চেতনা হচ্ছে ব্রিটিশ ভ্যালুস বা মূল্যবোধ।
আবাসনবিষয়ক মন্ত্রী রোশনারা আলী পদত্যাগ করেছেন মাসখানেক আগে। এর মধ্যে বড় ধাক্কা-উপ-প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগ করতে হলো। ভাড়াটিয়ার সঙ্গ মিথ্যা বলেছিলেন রোশনারা আলী। বাড়ি ছাড়ার জন্য নোটিস দিয়েছিলেন ভাড়াটিয়াকে। নোটিসে জানিয়েছিলেন, বাড়িটি বিক্রি করবেন। তাই ছাড়তে হবে। কিন্তু পরে দেখা গেল নোটিসের প্রতিশ্রুত ভঙ্গ করেছেন তিনি। ভাড়াটিয়া বাড়িটি ছাড়ার পর আরো বেশি টাকার বিনিময়ে আবার ভাড়া দিয়েছিলেন। বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়লে তার বিরুদ্ধে ভাড়াটিয়ার সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগ ওঠে। এই অভিযোগ নিয়ে তুমুল সমালোচনার মুখে পদত্যাগ করেন গত ৮ আগস্ট।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীন সিটি মিনিস্টার ছিলেন টিউলিপ সিদ্দিক। পদত্যাগ করতে হয়েছে পারিবারিক দুর্নীতির অভিযোগে। তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। একই সঙ্গে ব্রিটেনেও একটি বাড়ি নিয়ে তার বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত শুরু হয়। এতে গত ১৫ জানুয়ারি তিনি পদত্যাগ করতে বাধ্য হন।
কিয়ার স্টারমারের নেতৃত্বে লেবার পার্টি সরকার গঠনের চার মাসের মাথায় ২৮ নভেম্বর (২০২৪) পদত্যাগ করেছিলেন পরিবহনমন্ত্রী লুইস হেই। তার পদত্যাগের কারণটি বলা চলে একেবারেই ঠুনকো। ২০১৩ সালে মোবাইল চুরি হয়েছিল তার। পরে মোবাইলটি তিনি ফেরত পেয়েছিলেন। কিন্তু এ বিষয়ে আর পুলিশকে জানাননি। বিষয়টি নিয়ে সঠিক তথ্য দিয়ে পুলিশকে সহযোগিতা না করার অভিযোগ উঠে তার বিরুদ্ধে মন্ত্রী হওয়ার পর। এতেই তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে।
শুধু কি বর্তমান লেবার সরকারের আমলেই এ ঘটনা ঘটছে? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজলে দেখা যায় এ রকম ঘটনা আরো বহু রয়েছে। ২০১৩ সালের ঘটনা। ডেভিড ক্যামরনের মন্ত্রিসভার একজন প্রভাবশালী মন্ত্রী পদত্যাগই শুধু নয়, কারাগারে যেতে দেখেছি। মন্ত্রী হওয়ার আগে নির্ধারিত গতিসীমার ওপরে গাড়ি ড্রাইভ করেছিলেন। স্পিড ক্যামেরায় সেটা ধরা পড়েছিল। যথারীতি নোটিস যায় তার বাড়িতে। নোটিসের জবাবে বলেছিলেন, ওই সময় তার স্ত্রী ড্রাইভ করছিলেন। ওভার স্পিড জরিমানা ও লাইসেন্সে নেগেটিভ পয়েন্টের দায় তখন স্ত্রীর ওপরে বর্তায়। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তার। মিথ্যা বলার জন্য তাকে দুই বছরের জন্য কারাদণ্ড দিয়েছিল আদালত।
মন্ত্রী হওয়ার পর অফিসের একজন নারীর সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন ওভার স্পিড ড্রাইভিং করা ওই মন্ত্রী। অধীনস্থ অফিস কলিগের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়টি প্রকাশ পান স্ত্রী। স্ত্রী তখন রেগে গিয়ে অভিযোগ করেন, ওই সময় গাড়ি ড্রাইভ করছিলেন তার স্বামী। দুজনের সমঝোতার ভিত্তিতে পেনাল্টি পয়েন্ট ও জরিমানার দায় তিনি গ্রহণ করেছিলেন। তবে এখন সত্যটা প্রকাশ করতে চান।
স্ত্রীর এই অভিযোগের পর আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল বিষয়টি। মিথ্যা বলার অভিযোগে দুজনেরই কারাদণ্ড হয়েছিল। মন্ত্রিত্বই শুধু যায়নি, কারাভোগ করেছেন দুই বছরের বেশি। সঙ্গে তার সাবেক স্ত্রীকেও কারাভোগ করতে হয়েছিল তখন স্বামীর পক্ষে মিথ্যা বলার কারণে।
অত্যন্ত জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন বরিস জনসন। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে ছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। এর আগে ছিলেন লন্ডন সিটি মেয়র। তিনি প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় কোভিডের সময় রুলস ভঙ্গ করেছিলেন। ডাউনিং স্ট্রিটের রাষ্ট্রীয় বাসভবনে জন্মদিনের উৎসব করেছিলেন কোভিড রুলস ভঙ্গ করে। এটি প্রকাশিত হলে সমালোচনার মুখে পদত্যাগ করতে হয়েছিল বরিস জনসনকে।
এ ধরনের অনেক উদাহরণ দেওয়া যাবে। আইন ও রুলস ভঙ্গ করার কারণে অথবা শুধু মিথ্যা বলার কারণে মন্ত্রিত্ব চলে গেছে অনেকের। গণতন্ত্র, আইনের শাসন এবং ন্যায়বিচারের মূল্যবোধ হচ্ছে অপরাধ করলে বিচার সবার জন্য সমান। মিথ্যা বলে বা প্রতারণা করে রেহাই পাওয়ারও সুযোগ কারো নেই। যত প্রভাবশালী হোন না কেন, অপরাধ করলে আইনের কাছে অসহায়। এটাই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সংস্কৃতি। ব্রিটেনের গণতান্ত্রিক শাসনে আইন ও আদালত চলে নিজস্ব গতিতে। প্রভাবিত করার সুযোগ কারো নেই। আইন ও বিচার সবার জন্য সমান।
অথচ আমরা কী দেখি। বাংলাদেশে রাজনীতিকরা গণতন্ত্র বলতে বলতে মুখে ফেনা তোলেন। একই সঙ্গে অহরহ মিথ্যা বলেন। সম্পদের হিসাবে গরমিলের বিষয়টি তো অনেক পরে। কোনো হিসাবই জনগণের সামনে প্রকাশ করা হয় না। দুর্নীতি, দুঃশাসনের অভিযোগ উঠলে কানেই নেননি মন্ত্রী-এমপিরা। বরং যারা অভিযোগ করেন বা অপরাধ বের করেন, তাদের উল্টো হয়রানি করা হয়। যত সমালোচনাই হোক অভিযুক্তরা বহাল তবিয়তে থাকেন। বরং মিথ্যা বলা, কর ফাঁকি দেওয়া, দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদ অর্জন করা রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশে।
এখন ছোট একটি উদাহরণ দিই। ২০১৮ সালের রাতের ভোটের সংসদে একজন নারী সদস্য রাজউকের প্লট চেয়ে আবেদন করেছিলেন। সংসদ সদস্য হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই প্লটপ্রাপ্তি অগ্রাধিকার হয়ে যায়। যারা সাধারণ নাগরিকের সঙ্গে বিরাট একটি বৈষম্য তৈরি করেন। যার ভোটে সংসদ সদস্য হলেন তার খবর নেই। এমনকি মহিলা কোটায় মনোনীত হলে তো আর কথাই নেই। এখানে যার কথা বলছি তিনি মহিলা কোটায় এমপি হন। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান তিনি। রাজউক থেকেই বরাদ্দ পাওয়া জমিতে লালমাটিয়ায় বাবারবাড়ি রয়েছে। মায়ের বাড়ি রয়েছে এলিফ্যান্ট রোডে। অথচ দরখাস্তে তিনি উল্লেখ করেছিলেন ঢাকায় থাকার মতো তার কোনো সহায়-সম্পদ নেই। হলফনামা দিয়ে এই মিথ্যা বলার বিষয়টি কোনো ধরনের আমলে নেওয়া হয়নি। বরং এ বিষয়ে কেউ এখন বললে জবাবে তিনি বলেন, দরখাস্তটি প্রত্যাহার করেছিলেন। একই কথা বলেন দলটির অন্ধ ফলোয়াররা। কেউ একবারও ভাবেননি একজন সংসদ সদস্য হলফনামা দিয়ে মিথ্যা বলতে পারেন না। তবে আমাদের দেশে মিথ্যা বলাটাই যেন রাজনীতির অলংকার। যদিও দরখাস্তটি প্রত্যাহার এমনিতেই করেননি তিনি, তুমুল সমালোচনা শুরু হলে প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন।
আওয়ামী ফ্যাসিবাদের জামানায় মন্ত্রীদের মিথ্যা বলাটা হয়ে উঠেছিল রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ। খোদ প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকা শেখ হাসিনা সংসদে দাঁড়িয়ে ডাহা মিথ্যা বলতেন। যেমন : ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে রাতের আঁধারে বিদ্যুতের বাতি নিভিয়ে অন্ধকারে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছিল পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি। সঙ্গে ছিলেন আওয়ামী গুন্ডাবাহিনী। ওই রাতে শাপলা চত্বরে কত নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছিলেন, তার সঠিক হিসাব এখনো বের হয়নি। অথচ দুদিন পরই শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, শাপলা চত্বরে ৫ মে রাতে একটা গুলিও ফোটেনি! এটি উল্লেখ করলাম মিথ্যা বলার ক্ষুদ্র উদাহরণ হিসেবে।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, আমার দেশ
সূত্র, আমার দেশ