বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান একে শুধু দক্ষিণ এশিয়ার নয়, বরং ভারত, মিয়ানমার, চীন ও বঙ্গোপসাগরের মধ্যবর্তী স্থানেও একটি কৌশলগত ভূখণ্ডে পরিণত করেছে। এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও ভারত মহাসাগরের মধ্যবর্তী গুরুত্বপূর্ণ করিডোর। বঙ্গোপসাগরের একমাত্র মাঝারি শক্তিধর উপকূলীয় রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ভূখণ্ড চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ, ভারতের ‘অ্যাক্ট ইস্ট’ নীতি, মিয়ানমার ও আরাকানের নিরাপত্তা সংকট, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের জিওস্ট্র্যাটেজিক প্রতিযোগিতার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে।

এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকা সত্ত্বেও বিগত দেড় দশকে বাংলাদেশ রাষ্ট্র তার প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা নীতিকে সেই গুরুত্ব ও পরিসরে গড়ে তুলতে পারেনি, যেটি জাতীয় স্বার্থ রক্ষার জন্য প্রয়োজন ছিল। এর প্রধান কারণ হিসেবে উঠে আসে ভারতের প্রভাব ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ।

শেখ হাসিনার দীর্ঘ ১৬ বছরের শাসনামলে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক ‘বিশ্বাস ও মৈত্রীর’ নামে পরিণত হয়েছিল একতরফা নির্ভরতায়। ভারতের সঙ্গে একের পর এক চুক্তি, যেমন পানিবণ্টন, ট্রানজিট, সমুদ্রবন্দর ব্যবহার, প্রতিরক্ষা সহযোগিতা, গোয়েন্দা সমন্বয় প্রভৃতি কার্যত বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা কৌশলের স্বাধীনতাকে সীমিত করেছে। ভারতের স্বার্থে বাংলাদেশ ন্যায্য প্রতিরক্ষা চাহিদা পূরণে দ্বিধাগ্রস্ত থেকেছে। চীনের মতো প্রতিরক্ষা সরঞ্জামের গুরুত্বপূর্ণ উৎসের সঙ্গে চুক্তি বাধাগ্রস্ত হয়েছে ভারতের আপত্তির কারণে।

যখনই বাংলাদেশ আধুনিক যুদ্ধজাহাজ, বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, সাবমেরিন বা দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র কিনতে চেয়েছে, তখনই সরবরাহকারী রাষ্ট্রের ওপর কূটনৈতিক ও অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে ভারত তা আটকে দিয়েছে বা সীমিত করেছে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১৩ সালে চীন থেকে এয়ার ডিফেন্স রাডার ও ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা সংগ্রহের পরিকল্পনা বন্ধ হয়ে যায় ভারতীয় অসন্তোষের কারণে। এমনকি ইসরায়েলের মতো রাষ্ট্র থেকেও সামরিক প্রযুক্তি আমদানিতে বাংলাদেশ সরকার রক্ষণশীল থেকেছে শুধু ভারতের মনঃপূত থাকার জন্য।

পরিণতিতে বাংলাদেশে একটি পরিকল্পিত প্রতিরক্ষা দারিদ্র্য সৃষ্টি হয়েছে। বিমানবাহিনী এখনো ১৯৭০-৮০ দশকের পুরোনো F-7 সিরিজের বিমান দিয়ে কাজ চালাচ্ছে। নৌবাহিনীর সাবমেরিন প্রযুক্তি সীমিত এবং সেনাবাহিনীর হাতে খুব কমসংখ্যক আধুনিক আর্মড গিয়ার ও মোবাইল আর্টিলারি রয়েছে। বিমান প্রতিরক্ষা ও সাইবার ওয়ারফেয়ার প্রযুক্তির অভাব স্পষ্ট।

এই নিরস্ত্রীকরণ ছিল একটি প্রভাবশালী প্রতিবেশীর কৌশলগত অভিপ্রায়—বাংলাদেশকে এমন একটি রাষ্ট্রে পরিণত করা, যেটি শক্তিতে নয়, কূটনৈতিক বিনয় ও পরনির্ভরতায় পরিচালিত হবে। এই দুর্বলতা শুধু বাহ্যিক হুমকি নয়, বরং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার ক্ষেত্রেও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

বর্তমানে যখন বাংলাদেশ একটি রাজনৈতিক রূপান্তরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে এবং একটি স্বাধীন ও আত্মমর্যাদাশীল রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ তৈরি হয়েছে, তখন প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা খাতকে উপেক্ষা করার আর কোনো অবকাশ নেই।

এখনই সময় রাষ্ট্রকে তার ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অনুযায়ী একটি উপযুক্ত প্রতিরক্ষা শক্তিতে রূপান্তরিত করার। যুদ্ধ চাই না, কিন্তু যুদ্ধের প্রস্তুতি না থাকলে শান্তি একটি মরীচিকা হয়ে থাকে। তাই বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা সক্ষমতা বৃদ্ধি করা এখন আর কেবল একটি বিকল্প নয়, বরং জাতীয় প্রয়োজন।

এ সময়ে সশস্ত্র বাহিনীকে আধুনিকায়নের বদলে পরিচালিত হয়েছে ‘শোভনতা’ আর ‘প্রদর্শন’-নির্ভর কৌশল। কিছু অপ্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ সফর, সজ্জা পরিবর্তন এবং সীমিত প্রযুক্তি সংযোজনের মধ্য দিয়ে বাহিনীগুলোকে ব্যস্ত রাখা হয়েছে। যুদ্ধের জন্য উপযোগী গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র, যেমন—দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা, এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, সাবমেরিন প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি, অটোনোমাস ড্রোন স্কোয়াড্রন, ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার ও সাইবার রেসপন্স ইউনিট প্রভৃতি বাস্তবায়নের দিক থেকে ছিল সম্পূর্ণ অবহেলিত। বিমানবাহিনী এখনো ১৯৭০-৮০ দশকের পুরোনো চীনা ফাইটার জেট দিয়ে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে, যা প্রায়ই যান্ত্রিক ত্রুটির ফলে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে অনেক মূল্যবান প্রাণের ক্ষয় হয়। নৌবাহিনীর সাবমেরিন ও বিমানবাহী যুদ্ধজাহাজের মতো যুগান্তকারী সক্ষমতা এখনো কল্পনার বিষয়। সেনাবাহিনীর আধুনিক ট্যাংক ও স্বয়ংক্রিয় যুদ্ধব্যবস্থাও উল্লেখযোগ্য হারে গড়ে ওঠেনি।

প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত প্রতিনিয়ত বাংলাদেশে এই প্রতিরক্ষা অগ্রগতির বিরোধিতা করে আসছে। যখনই বাংলাদেশ উন্নত সামরিক সরঞ্জাম কেনার চেষ্টা করেছে, ভারতের কূটনৈতিক ও গোয়েন্দা চাপ সরাসরি প্রতিফলিত হয়েছে সরবরাহকারী রাষ্ট্রে। এমনকি বাংলাদেশ যদি পাকিস্তান, চীন, তুরস্ক কিংবা রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তিতে যেতে চায়, সেক্ষেত্রেও ভারতের অসন্তোষ কাজ করে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ফোরামে।

ভারতের এই হস্তক্ষেপ মূলত বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা স্বনির্ভরতা ও কৌশলগত স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করে। চীন বা তুরস্ক থেকে ক্ষেপণাস্ত্র প্রযুক্তি, সাবমেরিন বা রাডার সিস্টেম কেনার ক্ষেত্রে দিল্লি চাপ প্রয়োগ করে সরবরাহ বন্ধ করতে, বা শর্ত আরোপ করতে বাধ্য করেছে। ফলে বাংলাদেশের সামরিক আধুনিকায়ন বারবার পিছিয়ে পড়েছে।

এ অবস্থার ফলে বাংলাদেশ এমন একটি রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে প্রতিরক্ষা খাত নিয়ে কথা বলাও ছিল ‘সংবেদনশীল’ এবং ‘নিষিদ্ধ’ বিষয়। অথচ আত্মরক্ষা ও যুদ্ধপ্রস্তুতি একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্বের জন্য অপরিহার্য। যে জাতি প্রতিরক্ষায় দুর্বল, তার সার্বভৌমত্ব চিরকাল হুমকির মুখে থাকে।

বর্তমান বাস্তবতায় আর বিলম্ব করার সুযোগ নেই। সামনের দিনগুলোয় বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হতে যাচ্ছে—চীনা-মার্কিন দ্বন্দ্বে ভারসাম্য বজায় রাখা, ভারতীয় আধিপত্য প্রতিরোধ, রোহিঙ্গা সংকটের সামরিক ঝুঁকি, বঙ্গোপসাগর নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং আঞ্চলিক জঙ্গিবাদের নতুন রূপ। এ পরিস্থিতিতে প্রতিরক্ষা বাহিনীকে শুধু বাহ্যিক হুমকি মোকাবিলার জন্য নয়, বরং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক ভূরাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালনের জন্য প্রস্তুত করা দরকার।

প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ এখন সময়ের দাবি। সশস্ত্র বাহিনীর জন্য আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র, উন্নত ট্রেনিং সুবিধা, টেকসই লজিস্টিক ব্যবস্থা এবং একীভূত সাইবার প্রতিরক্ষা কমান্ড গঠন অপরিহার্য। একইসঙ্গে স্থানীয় প্রতিরক্ষা শিল্প প্রতিষ্ঠা ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের লক্ষ্যে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপাক্ষীয় চুক্তি করার সময় এখন। প্রতিরক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাকেন্দ্রের মাধ্যমে কৌশলগত বিশ্লেষণ সক্ষমতা গড়ে তোলাও জরুরি।

প্রতিরক্ষা খাতে বিনিয়োগ শুধু অস্ত্র কেনার বিষয় নয়, এটি একটি সামগ্রিক কৌশলগত নিরাপত্তা কাঠামো গঠনের অংশ। আজকের যুদ্ধ শুধু বন্দুক বা ট্যাংকের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; সাইবার হামলা, ড্রোন যুদ্ধ, ইলেকট্রনিক ও তথ্যযুদ্ধ নতুন যুদ্ধক্ষেত্র তৈরি করেছে। তাই বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীর জন্য আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন যুদ্ধাস্ত্রের পাশাপাশি প্রয়োজন ইলেকট্রনিক ও সাইবার ওয়ারফেয়ার সক্ষমতা। সিমুলেশন ও এআই-ভিত্তিক ট্রেনিং সেন্টার, উন্নত কমান্ড ও কন্ট্রোল সিস্টেম এবং আন্তঃবাহিনী সমন্বিত অপারেশনাল কাঠামো গড়ে তোলা অপরিহার্য। স্থানীয় প্রতিরক্ষা শিল্প গড়ে তুলতে হবে পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপে এবং প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়টি চুক্তির আবশ্যিক শর্ত করতে হবে। একটি আধুনিক প্রতিরক্ষা বিশ্ববিদ্যালয় হতে পারে জাতীয় নিরাপত্তা চেতনার গবেষণাগার।

বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আধুনিক ও কৌশলগতভাবে সক্ষম করে তোলার জন্য প্রতিরক্ষা কূটনীতিকে একটি মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। একটি বিশেষায়িত প্রতিরক্ষা কূটনৈতিক ক্যাডার গঠনের মাধ্যমে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমানবাহিনীর অভিজ্ঞ অফিসারদের বৈদেশিক মিশনে প্রেরণ করে কৌশলগত অংশীদারত্ব, প্রতিরক্ষা চুক্তি, যৌথ মহড়া এবং প্রযুক্তি স্থানান্তরের কাজকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব। উন্নত দেশগুলোর মতো বাংলাদেশকেও তার প্রতিরক্ষা শক্তিকে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরতে হবে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে। এই কাঠামো গঠনের জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা, পেশাদার পরিকল্পনা এবং সর্বোচ্চ স্তরে আন্তঃপ্রাতিষ্ঠানিক সমন্বয় প্রয়োজন। মনে রাখতে হবে, একটি পেশাদার ও মর্যাদাসম্পন্ন সশস্ত্র বাহিনীই একটি রাষ্ট্রের নিরাপত্তার মূল ভিত্তি।

আজ বাংলাদেশকে একটি স্পষ্ট বার্তা দিতে হবে—আমরা আর দুর্বল থাকতে চাই না, আমাদের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারি এবং পারব। কারণ স্বাধীনতা একবার অর্জিত হলে তা রক্ষা করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আর প্রতিরক্ষা শক্তিই সেই রক্ষাকবচ, যেটি জাতির অস্তিত্বকে চিরকাল ধরে রাখে।

আজ বাংলাদেশের সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণ, যেখানে রাষ্ট্রের অস্তিত্ব, সার্বভৌমত্ব ও ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে একটি প্রশ্নের ওপর—আমরা কি আর দুর্বল থাকব, নাকি সাহসের সঙ্গে শক্তির পথে হাঁটব? স্বাধীনতা অর্জন ছিল একটি বীরত্বগাথা; কিন্তু সেই অর্জনকে টিকিয়ে রাখার লড়াই আজ আরো কঠিন। বিশ্বব্যবস্থায় প্রতিনিয়ত পাল্টে যাচ্ছে শক্তির সমীকরণ, প্রতিনিয়ত বাড়ছে হুমকি ও চ্যালেঞ্জ। এই বাস্তবতায় একমাত্র শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাই আমাদের আত্মমর্যাদা ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দিতে পারে। আজকের প্রজন্মের জন্য আমরা কী রেখে যাব—ভয়ের ইতিহাস, নাকি সাহসী ভবিষ্যৎ? সময় এসেছে, বাংলাদেশকে বলিষ্ঠ প্রতিরক্ষা শক্তির মাধ্যমে নিজের নিরাপত্তা নিজেই নিশ্চিত করার দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

লেখক : ব্যাংক ও অর্থনীতি বিশ্লেষক এবং ‘আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, বৈদেশিক বিনিময় ও অর্থায়ন’ গ্রন্থের লেখক

সূত্র, আমার দেশ