এই বিপন্ন বিপ্লবের নিঃশব্দ প্রস্থান মনে করিয়ে দেয় কলম্বিয়ার নোবেলজয়ী সাহিত্যিক গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসের লেখা ‘A Very Old Man with Enormous Wings’ গল্পটির কথা, যেখানে হঠাৎ এক ঝড়ের দিনে এক অদ্ভুত বৃদ্ধ মানুষকে পাওয়া যায়, যার পিঠে ছিল বিশাল ডানা। গ্রামের লোকেরা ভেবে নেয়, হয়তো তিনি ফেরেশতা বা কোনো অলৌকিক কিছু। তারা তার আশপাশে ভিড় করে, কেউ তাকে বন্দি করে রাখে, কেউবা আবার তার ওপর ব্যবসা করে। এবার পুরোহিত এসে বলেন, তিনি আসল ফেরেশতা নন। জনগণ তাকে দেখে অবাক হয়, কিন্তু কেউ তার যন্ত্রণাকে বুঝতে চায় না। একসময় তার ডানা আবার কাজ করে এবং তিনি উড়ে চলে যান চুপচাপ কারো দিকে না তাকিয়ে।

যেভাবে গ্রামের লোকেরা ফেরেশতা পেয়ে প্রথমে তাকে আজিজির সঙ্গে পূজা করতে চায়, পরে তার থেকে সুবিধা আদায় করতে চায়—ঠিক তেমনি বাংলাদেশের জনগণও ৫ আগস্টের ‘বিপ্লব’-এর দিকে তাকিয়েছিল ঢের উমিদ নিয়ে। কিন্তু সে বিপ্লব যখন বাস্তব ফলাফল দিতে পারল না, তখন সেটাকেও তারা অবিশ্বাস করতে শুরু করল। গল্পে যেমন ফেরেশতাকে খাঁচায় আটকে রাখা হয় এবং তার ওপর ব্যবসা চলে, তেমনি বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলো এক সম্ভাব্য পরিবর্তনের ঢেউকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছে। বিপ্লবের নৈতিক মূ্ল্যবোধকে বানানো হয়েছে একটি ‘শো’, আর নেতৃত্ব হয়ে গেছে ‘দর্শকদের জন্য আয়োজন’। যাহোক এবার আসা যাক মূল আলাপে।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি উল্লেখযোগ্য তারিখ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে, যদিও সেটি অর্জনের নয়, বরং প্রত্যাশার বিপরীতে হতাশার। সেদিন দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলন ও গণঅসন্তোষের ঢেউ এক বিপ্লবের দিকে ইঙ্গিত করছিল, যা একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মাধ্যমে একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার সূচনা ঘটাবে বলে আশা করা হচ্ছিল। কিন্তু রাজনৈতিক দলগুলোর বিভাজন এবং নেতৃত্বের দুর্বলতা সেই সম্ভাবনাকে পূর্ণতা দিতে পারেনি। বিপ্লবের যে উন্মেষ ঘটেছিল, তা এক সপ্তাহের মধ্যেই নিভে যায়। থিওরেটিক্যালি বলতে গেলে, একটি সফল বিপ্লবের জন্য যেমন একতা, আদর্শিক দৃঢ়তা ও সুসংগঠিত জনমতের প্রয়োজন—বাংলাদেশে সেই বাস্তবতা ছিল অনুপস্থিত। এই প্রেক্ষাপটে বিএনপির ভূমিকা প্রশ্নের মুখে পড়েছে। ঐতিহাসিকভাবে বিএনপি একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দল হলেও বর্তমান বাস্তবতায় তারা দ্বৈত ভূমিকা পালন করছে—একদিকে তারা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সহায়তার ভান করে রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি করছে, অন্যদিকে তাদের দলের মাঠপর্যায়ের কর্মীদের একাংশ সারা দেশে চাঁদাবাজি, সহিংসতা ও বিশৃঙ্খল কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছে।

আধুনিক বিপ্লবতত্ত্বে থেডা স্ককপোল যে ‘state breakdown’ বা রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভাঙনের কথা বলেন, তা বাংলাদেশে পুরোপুরি ঘটেনি। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ এখনো প্রশাসনের হাতে, সামরিক বাহিনীর অবস্থান রহস্যজনক এবং জনগণের মধ্যে শৃঙ্খলার যে বিস্তার দরকার ছিল, একটি সফল বিপ্লবের জন্য তা পূর্ণতা পায়নি। বিপ্লব শুধু রাস্তায় নামার ঘটনা নয়, বরং তা একটি সুদূরপ্রসারী সাংগঠনিক, আদর্শিক ও কৌশলগত রূপান্তর। এখানেই এই বিপ্লব ব্যর্থ হয়। সংশ্লিষ্টভাবে সমাজবিজ্ঞানের আলোকে চার্লস টিলি যেভাবে ‘contentious politics’ বা বিরোধপূর্ণ রাজনীতির কথা বলেন তার আলোকে দেখা যায়, জনগণের আন্দোলনকে কাঠামোগত রূপ দিতে না পারলে সেটি ক্ষণস্থায়ী হয়। বাংলাদেশে ৫ আগস্টের আন্দোলনটি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত, তবে তা lacked leadership ও Articulation-এর কারণে একটি ‘episodic movement-এর অংশ হিসেবেই থেকে গেল, যার প্রভাব আওয়ামের তামান্নার তুলনায় বেশ কম।

অন্যদিকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ভূমিকা নিয়েও জনমনে কিন্তু প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। বিশিষ্ট রাজনৈতিক তত্ত্ববিদ হান্না আরেন্ডট যেভাবে ‘authority vs. power’-এর পার্থক্য নির্দেশ করেন, তা এখানে প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। বর্তমান সরকার হয়তো প্রশাসনিক কর্তৃত্ব ধরে রেখেছে, কিন্তু জনগণের মধ্যে তাদের নৈতিক প্রভাব বা ‘পাওয়ার’ ক্ষয়প্রাপ্ত হচ্ছে। জনগণ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কার্যকারিতা নিয়ে সংশয়ে ভুগছে। ক্ষমতার এই শূন্যতা আবার পুরোনো দলগুলোকে সুযোগ করে দিচ্ছে মাঠে ফিরে আসার, যদিও তারা সেই সুযোগকে গণমুখী রূপ দিতে ব্যর্থ হচ্ছে।

আদতে বিপ্লব সাধারণত সমাজ, রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আনার জন্য সংঘটিত হয়। এটি কেবল শাসকের পতন নয়, বরং একটি নতুন আদর্শ ও ন্যায়ের ভিত্তিতে একটি নতুন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি বহন করে। বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভের পর থেকেই বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের রাজনৈতিক বিপ্লব ও আন্দোলনের সাক্ষী হয়েছে। কখনো তা ছিল গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য, কখনো সাম্যবাদের পক্ষে, আবার কখনো সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে। কিন্তু ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এসব বিপ্লব ও আন্দোলনের বেশিরভাগই শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়েছে বা তাদের মানজিলে মাকসুদ পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। ফলে দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে এবং জাতীয় উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে।

প্রশ্ন হলো—বাংলাদেশে বিপ্লবগুলো কেন বারবার ব্যর্থ হয়? বোধকরি এ সাওয়ালের জাওয়াবের জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তাহকিক করা প্রয়োজন। যেমন নেতৃত্বের অভাব ও আদর্শগত বিভাজন বাংলাদেশে বিপ্লবের বড় একটি দুর্বলতা হিসেবে কাজ করেছে। অনেক সময় দেখা গেছে, বিপ্লব বা আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকা ব্যক্তিরা নিজেদের আদর্শ ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে একমত নন। এ ধরনের আদর্শগত দ্বন্দ্ব আন্দোলনকে বিভ্রান্ত করে তোলে এবং এর গতি শ্লথ হয়ে যায়। বিপ্লব তখন একটি দিশাহীন ভঙ্গিতে পরিচালিত হয়, যার ফলে সাধারণ জনগণও তা নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ে এবং তাদের সমর্থন হারায়। যেমন, স্বাধীনতার পরপরই দেখা যায়, বিভিন্ন বামপন্থি সংগঠনগুলো ভিন্ন ভিন্ন পথে হাঁটছে—কেউ সমাজতন্ত্র, কেউ সাম্যবাদ, আবার কেউ কেউ বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও জাতীয়তাবাদী আদর্শের পথে।

এতে করে একটি সামগ্রিক জাতীয় বিপ্লব গড়ে ওঠেনি, বরং খণ্ড খণ্ড ক্ষুদ্র বিপ্লবগুলো পারস্পরিকভাবে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। বোধকরি ভারতের এজেন্টদের মাধ্যমে হস্তক্ষেপ বাংলাদেশে বিপ্লবের সাফল্যে বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। অনেক সময় বৈদেশিক শক্তিগুলো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করেছে এবং বিপ্লবী চেতনা দমনে হেল্পিং হ্যান্ড হিসেবে ভূমিকা রেখেছে। যেমন, ঠান্ডা যুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা চীন অনেক সময় বাংলাদেশের বামপন্থিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে; আবার অন্যদিকে ভারত বা সোভিয়েত রাশিয়া বিভিন্ন রাজনৈতিক পক্ষকে মদত দিয়েছে। ফলে দেশীয় বিপ্লবগুলো বহির্বিশ্বের কূটনৈতিক খেলায় বিভ্রান্ত ও দিগ্‌ভ্রান্ত হয়ে পড়ে। আর রাজনৈতিক দলগুলোর দ্বিচারিতা ও ক্ষমতার রাজনীতি বিপ্লবের প্রকৃত উদ্দেশ্যকে বিকৃত করে ফেলে। বেশির ভাগ সময় বিপ্লবের নামে কেবল ক্ষমতা দখলের লড়াই চলে, যেখানে আদর্শ, গণতন্ত্র বা ন্যায়বিচার গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে বহু রাজনৈতিক আন্দোলন শুরু হয়েছে ‘গণমানুষের অধিকার আদায়ের’ স্লোগানে, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা হয়ে পড়ে একটি রাজনৈতিক দলের ক্ষমতা পুনঃপ্রতিষ্ঠার টেপিস্ট্রি। ফলে জনগণ আশাহত হয় এবং আন্দোলনের প্রতি আস্থা হারায়। রাজনৈতিক দলগুলো যখন নিজেদের কায়েমি স্বার্থে বিপ্লবের মটিফ ও মটিভের ব্যাখ্যা বদলে নেয়, তখন সেটি বিশ্বাসযোগ্যতা হারায় এবং পরিণামে ব্যর্থ হয়। তাছাড়া দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব বিপ্লব বেহাত হওয়ার একটি বড় কারণ বলে গুমান করি। বিপ্লবের জন্য যেমন তাত্ত্বিক প্রস্তুতি দরকার, তেমনি প্রয়োজন সময়োপযোগী কৌশল, সংগঠন ও ভবিষ্যৎ রূপরেখা। কিন্তু বাংলাদেশে দেখা যায়, অনেক আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্তভাবে শুরু হলেও তাদের কোনো সুস্পষ্ট পরিকল্পনা বা পরিণতির পরিকল্পনা থাকে না। আন্দোলনকারীরা জানে কী ধ্বংস করতে হবে; কিন্তু কীভাবে নতুন কিছু গড়া হবে, সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকে না। ফলে একবার শাসকশ্রেণি অপসারিত হলেও পরবর্তী সময়ে নতুন শাসক হয়ে পড়ে আগের চেয়েও স্বেচ্ছাচারী। সর্বোপরি, বাংলাদেশের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বাস্তবতাও বিপ্লবকে গ্রহণ করতে অনেকটা প্রতিকূল বলেই অনুমান। বাঙালি জাতি ঐতিহাসিকভাবে অত্যন্ত আবেগপ্রবণ ও ব্যক্তিকেন্দ্রিক নেতৃত্বে অভ্যস্ত। দলগত সচেতনতা এবং সমষ্টিগত দায়িত্ববোধের অভাব বিপ্লবকে টিকিয়ে রাখতে চরম বাধা হয়ে দাঁড়ায়। সামাজিকভাবে শ্রেণিবৈষম্য, ধর্মীয় বিভাজন ও শিক্ষার অভাবও বিপ্লবী চেতনার বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে।

যাহোক, টানেলের ঠিক প্রান্তসীমায় একটু রোশনি আছে; রাজনৈতিকভাবে বিপ্লব ব্যর্থ হলেও এটি দেশের অভ্যন্তরে একটি নতুন প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে—বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক কাঠামো কেমন হবে? দেশে কি একটি অন্তঃসারশূন্য গণতন্ত্র চলবে, নাকি একটি বাস্তব অর্থে অংশগ্রহণমূলক ও নৈতিক রাজনীতির সূচনা হবে? মার্কসীয় তত্ত্বমতে—‘Revolution is the locomotive of history.’ কিন্তু সেই লোকোমোটিভ যদি রেললাইন খুঁজে না পায়, তবে তা শুধু ধ্বংস ডেকে আনে। রাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন না করলে তা কেবল শাসকগোষ্ঠীকে নয়, গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকেই দুর্বল করে দেয়। মাশহুর সমাজবিজ্ঞানী এমিল দুর্খাইম যেভাবে ‘Anomie’ বা নিয়মভঙ্গ অবস্থা বিশ্লেষণ করেন, বর্তমান বাস্তবতা তা প্রতিফলিত করছে—যেখানে সামাজিক ও রাজনৈতিক নিয়মগুলো দুর্বল, মানুষ ভ্রান্ত দিশায় এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো জনগণের আস্থা হারাচ্ছে।

৫ আগস্টের ব্যর্থ বিপ্লব এবং অন্তর্বর্তী সরকারকে সহযোগিতার ঘাটতি মিলিয়ে একটি অন্ধকার ভবিষ্যতের পূর্বাভাস দিচ্ছে। রাজনৈতিক দর্শনে ফরাসি বিখ্যাত দার্শনিক জ্যঁ জাক রুশোর জেনারেল উইল বা সামষ্টিক ইচ্ছার কথা বলা হয়েছে, যেখানে জনগণের অভিপ্রায়ই হয় প্রকৃত রাজনৈতিক শক্তি। কিন্তু যদি জনগণের ইচ্ছাকে দলীয় স্বার্থে বিভক্ত ও দুর্বল করে ফেলা হয়, তবে সে শক্তি আর জাতিকে এগিয়ে নিতে পারে না; বরং তা হয়ে ওঠে ব্যর্থতা, অরাজকতা ও অস্থিরতার প্রতিচ্ছবি।

বাংলাদেশ এখন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। এ সন্ধিক্ষণ হয়তো এক বিপ্লবের সম্ভাবনাকে শেষ করেছে; কিন্তু ইতিহাস বলে, বিপ্লব একবার ব্যর্থ হলেও চেতনায় তা চিরকাল বেঁচে থাকে এবং যখনই নেতৃত্ব, সংগঠন ও জনমত একত্র হবে, তখনই তা আবার ফিরে আসতে পারে আরো শানিত হয়ে, আরো সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে। এখন প্রশ্ন হলো—আমরা কি সে প্রস্তুতি নিচ্ছি, নাকি আবার একটি ব্যর্থ সম্ভাবনাকে দাফন করতে যাচ্ছি ইতিহাসের পাতায়? বাংলাদেশের মানুষের দুর্ভাগ্যই যেন নিয়তি! ব্রিটিশদের শোষণ-নিপীড়ন, ব্রিটিশের তাঁবেদার হিন্দু বেনিয়া জমিদারদের শোষণ-নির্যাতন, পাকিস্তানিদের নির্মম নিগ্রহ, স্বাধীন বাংলাদেশে পালা করে আওয়ামী লীগ-বিএনপির ক্যাডারদের অকথ্য নির্যাতন, আর ভারতীয় আগ্রাসন তো খাঁড়ার মতো ঝুলে রয়েছে। লাইফ অব পাইয়ের মতো জলে কুমির ও ডাঙ্গায় বাঘ। পরাধীনতার জিঞ্জির ছিঁড়তে এত রক্ত, এত ত্যাগ খোদার বসুন্ধরায় খুব কম দেশের ইতিহাসে মাওজুদ আছে বললে হাইপারবুলি হবে না। মানুষ রক্ত দিয়ে এক একটা পরিবর্তন ঘটায় আর নতুন করে একদল সাইক্লোপস এসে মানুষের স্বপ্নগুলোকে গিলে খেয়ে যায়। আর কতদিন এভাবে চলবে হাম নাদারাত খোদাকা মালুম। পরিশেষে বলা যায়, নিঃসন্দেহে ৫ আগস্টের সেই আন্দোলন শুধুই একটি ব্যর্থ কারবালা ছিল না, তা ছিল হাজারো তরুণের চোখে জমে থাকা স্বপ্নের নীরব চূর্ণবিচূর্ণতা। তারা চেয়েছিল একটি ভোর; কিন্তু পেয়েছে একটি অন্ধকার, যেখানে না আছে দিশা, না আছে দৃশ্যমান নেতৃত্ব। যেন তারা হাঁটছে কোনো মরুভূমির দিকে, যেখানে প্রতিটি পদক্ষেপেই ধুলো উড়েছে, রক্ত ঝরেছে, তবু গন্তব্য ছিল মিথ্যা। এই বিপ্লবের ওফাত শুধু একটি রাজনৈতিক অধ্যায়ের যবনিকা নয়, এটি ছিল একটি প্রজন্মের হৃদয়ের অন্তঃশব। যে তারুণ্য জীবন বাজি রেখে দেশ বদলাতে চেয়েছিল, তারা আজ হয়তো বারবার আয়নার দিকে তাকিয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করে—‘আমরা কি সত্যিই কিছু বদলাতে পেরেছিলাম?’ পরিবর্তনের সেই আহ্বান, যা একদিন প্রকম্পিত করেছিল শহরের রাস্তাঘাট, আজ নিঃশব্দে কেবল বুকের ভেতর চাপা কষ্ট হয়ে রয়ে গেছে। যেভাবে ফেরেশতা নামধারী এক অজানা বৃদ্ধকে ঘিরে সমাজ প্রথমে উৎসাহ, পরে ব্যবসা এবং শেষে উপেক্ষা করে, বাংলাদেশের ৫ আগস্টের ব্যর্থ বিপ্লবও যেন তেমনই এক ‘ডানাওয়ালা সম্ভাবনা’, যাকে মানুষ চেনেনি, বরং যার ওপর ভর করে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করতে চেয়েছে। আদর্শ, নৈতিকতা ও নেতৃত্ব সবকিছুই যেন বন্দি হয়েছে দলের স্ট্র্যাটেজির খাঁচায়। আর বিপ্লব? সে নিঃশব্দে উড়ে গেছে ইতিহাসের পাতায় অদৃশ্য হয়ে।

লেখক : সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, লেখক ও গবেষক, ফ্রাই ইউনিভার্সিটি বার্লিন, জার্মানি

গবেষণার ক্ষেত্র : উপনিবেশ, উপনিবেশ-উত্তর ইংরেজি সাহিত্য, সংস্কৃতি, উপমহাদেশ ভাগ, পরিবেশ, রাজনীতি, ধর্মতত্ত্ব ও ইতিহাস

সূত্র, আমার দেশ