দেরিতে হলেও সুখরঞ্জন বালী অভিযোগ করেছেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। তাকে অপহরণ ও গুমের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ তৎকালীন সরকারের মন্ত্রী, ট্রাইব্যুনালের বিচারকসহ সংশ্লিষ্টদের মামলায় আসামি করা হয়েছে। শেখ হাসিনা আমলে হাজারো গুমের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে সুখরঞ্জন বালীর ঘটনাটি ছিল ব্যতিক্রম। অন্য ঘটনাগুলোর প্রত্যক্ষদর্শী তেমন নেই। থাকলেও প্রকাশ করেননি তখন ভয়ে। কিন্তু সুখরঞ্জন বালীর ঘটনাটি ছিল দিবালোকে, প্রকাশ্যে শত প্রত্যক্ষদর্শীর সামনে। তাকে উঠিয়ে নেওয়া হয় খোদ সুপ্রিম কোর্ট এরিয়া বাউন্ডারির ভেতর থেকে। ট্রাইব্যুনালে প্রবেশপথেই রুখে দেওয়া হয়েছিল আইনজীবীর গাড়ি।
সুখরঞ্জনকে অপহরণের পরিকল্পনা মোতাবেক সকাল থেকেই বিপুলসংখ্যক পুলিশ, ডিবি ও গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন পাহারায় বসেন। অন্যান্য দিনের চেয়ে কিছুটা অস্বাভাবিক ছিল কোর্ট এলাকা। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সাদা পোশাকে গোয়েন্দাদের উপস্থিতি নজর কাড়ে সবার। শুরু হয় ট্রাইব্যুনালে প্রবেশমুখী গাড়িতে তল্লাশি। প্রতিটি গাড়ি তল্লাশি করছেন তারা। সুখরঞ্জন বালী ছিলেন আল্লামা সাঈদীর আইনজীবীর গাড়িতে। এই গাড়িটি থামিয়ে দরজা খোলা হয়। যদিও মাঝের সিটে ছিলেন তিনি। পাশে তাকা আইনজীবীকে নামিয়ে সুখরঞ্জনকে টেনে নামায় গোয়েন্দারা। আইনজীবী ও গোয়েন্দাদের মধ্যে এ নিয়ে ধস্তাধস্তিও হয়। আইনজীবী সুখরঞ্জনকে টেনে ধরেন আটকানোর জন্য। গোয়েন্দারা টানেন তাদের অপেক্ষমাণ গাড়ির দিকে। এ অবস্থায় ঘটনাস্থলের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন আইনজীবী, সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষ। ট্রাইব্যুনাল গেটের সিসি ক্যামেরা তো ছিলই।
সুখরঞ্জনকে নিয়ে ট্রাইব্যুনালের নাটক
নিজামুল হক নাসিম তখন ট্রাইব্যুনাল চেয়ারম্যান। সঙ্গে এ টি এম ফজলে কবীর ও জাহাঙ্গির হোসেন। আগের দিনই সুখরঞ্জনকে আল্লামা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য হিসেবে উপস্থিত করার জন্য জানান দেন আইনজীবীরা। এতে ট্রাইব্যুনাল কিছুটা বিচলিত। কারণ, প্রসিকিউশনের দাবি অনুযায়ী সুখরঞ্জন বালী উধাও। তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাই প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে সুখরঞ্জনের দেওয়া বানোয়াট বক্তব্য সাক্ষ্য হিসেবে গ্রহণের আবেদন মঞ্জুর করে রেখেছিল ট্রাইব্যুনাল। এরপর সুখরঞ্জন ট্রাইব্যুনালে এসে সত্য বলে ফেললে মামলা জনসমক্ষে কঠিন প্রশ্নের মুখে পড়বে।
ট্রাইব্যুনালে উপস্থিত হওয়ার আগের দিন সুখরঞ্জন আমার দেশকে একটি ইন্টারভিউ দেন। এতে তিনি স্পষ্ট করেই বলেন, সত্য বলতেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রাইব্যুনালে আল্লামা সাঈদীর পক্ষে সাক্ষ্য দিতে এসেছেন। সেই নিউজ ছাপা হয়েছিল সুখরঞ্জন বালীকে অপহরণের দিন সকালে। কিন্তু পত্রিকায় যেদিন সকালে ছাপা হয়েছে, সেদিনই তাকে অপহরণ করা হয়েছিল। শেখ হাসিনার পরিকল্পিত ট্রাইব্যুনালে তাকে আর সত্য বলার সুযোগ দেওয়া হয়নি।
সুখরঞ্জন বালীকে অপহরণের পরপরই আল্লামা সাঈদীর আইনজীবীরা দৌড়ান ট্রাইব্যুনালের এজলাসের দিকে। তারা নিজামুল হক নাসিমের নেতৃত্বে গঠিত আদালতের সামনে বিষয়টি উপস্থাপন করেন। ট্রাইব্যুনাল যথারীতি পরিকল্পনা অনুযায়ী চিফ প্রসিকিউট গোলাম আরিফ টিপুকে তলব করেন। ঘটনার খোঁজ নিয়ে জানাতে বলা হয়। ঘণ্টাখানেক পর গোলাম আরিফ টিপুসহ প্রসিকিউশন টিম এসে জানিয়ে দেন এ ধরনের কোনো ঘটনা ট্রাইব্যুনালের সামনে ঘটেনি। যদিও ডিফেন্স টিম (আল্লামা সাঈদীর আইনজীবী) বারবার অনুরোধ করছিলেন, ট্রাইব্যুনাল গেটের সিসিটিভির রেকর্ড পরীক্ষা করার জন্য। কিন্তু সেটি করতে রাজি হয়নি ট্রাইব্যুনাল। মূলত সরকার, প্রসিকিউশন ও ট্রাইব্যুনালের সম্মিলিত অপচেষ্টায় এ অপহরণের ঘটনা ঘটেছিল।
নাটকের এখানেই শেষ নয়। আল্লামা সাঈদীর আইনজীবীরা হাইকোর্ট বিভাগে একটি হেভিয়াস কর্পাস আবেদন করলেন। সুখরঞ্জনের সন্ধান চেয়ে আবেদনটি শুনানি করতে দেননি তৎকালীন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। হাইকোর্ট বিভাগে আবেদনটি নিষ্পত্তির অপেক্ষায় ছিল। দেশের একজন নাগরিক সুপ্রিম কোর্ট বাউন্ডারির ভেতর থেকে অপহরণের শিকার হয়েছেন, আইনজীবী, সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষের সামনে। এটিও শেখ হাসিনার অনুগত হাইকোর্ট তখন শুনানি করার হিম্মত রাখেনি। মানুষের অধিকার কতটা কেড়ে নেওয়া হয়েছিল, এ ঘটনা থেকে স্পষ্ট।
গণমাধ্যম ছিল সহায়কের ভূমিকায়
দিনের আলোয় বেশ কয়েকজন সাংবাদিকের সামনেই এ ঘটনা ঘটেছিল। তারা বিষয়টিকে চেপে যাওয়ার চেষ্টা করেন। সেদিনই একজন সাংবাদিক বলেছিলেন, আমি সব ঘটনা সামনে থেকেই দেখেছি। কিন্তু বলব না। পরের দিন পত্রিকাগুলোয় সুখরঞ্জন বালী নিউজের শিরোনাম করা হয় সাক্ষী অপহরণের অভিযোগ হিসেবে। এমনভাবে বর্ণনা করা হয়, যেন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। তারপরও আল্লামা সাঈদীর আইনজীবীরা অভিযোগ করছেন।
সুখরঞ্জনকে অপহরণের পর নেওয়া হয়েছিল ডিবিতে
অপহরণের পর সুখরঞ্জনকে সোজা নিয়ে যাওয়া হয়েছিল ডিবিতে। সেখানেই রাখা হয়েছিল ৩ মাস ১৩ দিন। এরপর পাচার করা হয় ভারতে। ইন্ডিয়া কীভাবে পাচার করা হয়েছিল, সেই বর্ণনা দিয়েছিলেন আমার দেশ-এর এই প্রতিবেদকের কাছে। সুখরঞ্জন বলেছিলেন, ‘৩ মাস ১৩ দিন পর আমাকে তারাই বলেছিল, তোকে কোথায় দিলে বাড়ি যেতে পারবে। তোকে বাড়ি যেতে হবে। তখন বলেছি, বাগেরহাটের যেকোনো জায়গায় দিলে বাড়িতে যেতে পারব। একদিন সকালে চোখ বেঁধে গাড়িতে ওঠানো হয়। সারা দিন চোখ বাঁধা অবস্থায় ছিল। এ অবস্থায় খাওয়া-দাওয়া কিছুই নেই। ফেরি যখন পার হচ্ছিল তখন বুঝতে পারছিলাম। কারণ তখন গাড়ি থামছিল এবং ফেরির আওয়াজ বুঝতে পারতেছিলাম। এরপর অল্প একটু সময় থামাইছিল।
বুঝলাম লোক উঠল দুজন। আবার গাড়ি চলতে থাকল। অনেক দূর গিয়ে গাড়ি থামাইছে। তখন বুঝতে পারি নাই কোথায় থামাইছে। চোখ বাঁধাই ছিল। কিছুক্ষণ পর চোখ খুলে দিল। খোলার পর নামছি। নামার পর দেখি সামনে দুজন বিডিআর। তখন ডিবি পুলিশ আর বিডিআর ছিল। তারা ফোন করে। ফোনে কী কথা হয় সেটা বুঝতে পারিনি। তখন বাগানের ভেতর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে সামনে নিয়ে যায়। সামনে গিয়ে দেখা যায় বিএসএফ বসা আছে। বিএসএফ তাকে নিয়ে প্রথমে নির্যাতন করেন। পরপর অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে মামলার পর পাঠানো হয় কোর্টে। সেখান থেকে কারাগারে।’
উঠিয়ে নেওয়ার সময় প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা
সুখরঞ্জন বালীকে ৫ নভেম্বর (২০১২) ট্রাইব্যুনালে নিয়ে যাচ্ছিলেন ডিফেন্স টিমের সিনিয়র আইনজীবী মিজানুল ইসলাম ও অ্যাডভোকেট মো. হাসানুল বান্না সোহাগের গাড়িতে করে। গাড়ির চালকসহ চারজন ছিলেন ওই গাড়িতে।
অ্যাডভোকেট মিজানুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করে ওইদিনের ঘটনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রতিদিনের মতোই ট্রাইব্যুনালে যাচ্ছিলাম। কোনো দিন গেটে আমাদের গাড়ি থামায়নি। ওইদিন গেটে যাওয়ার পর হঠাৎ করে গাড়ি থামায় পুলিশ। তিনি জানান, পুলিশের কাছে জানতে চাওয়া হলো কেন থামানো হলো? জবাবে বলা হয়েছিল, ওপরের নির্দেশ আছে। এ সময় দরজা খুলে সোহাগ (আইনজীবী) গাড়ি থেকে নেমে পরিস্থিতি জানার চেষ্টা করেন। দরজা খোলার পরই সাদা পোশাকে ডিবির লোক সুখরঞ্জন বালীকে টেনে নামিয়ে নিয়ে যান।’
মো. হাসানুল বান্না সোহাগ। যিনি পরিস্থিতি বুঝতে গাড়ি থেকে নামার চেষ্টা করছিলেন। তার সঙ্গে দেখা করেও প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘গাড়ি থেকে নামার জন্য দরজা খোলা মাত্রই ডিবির লোকজন ঘিরে ফেলেন। তারা গাড়িতে উঁকি দিয়ে দেখেন সুখরঞ্জন বালী বসা। তাকে টেনে নামিয়ে নেন।’
তিনি আরো জানান, তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয় কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন। উত্তরে বলা হয়, তার সঙ্গে কথা আছে। একটু কথা বলতে হবে। তিনি বলেন, তখন মনে করেছিলাম কথা বলে ছেড়ে দেবে। কিন্তু তারা সুখরঞ্জন বালীকে নিয়ে কোর্টে প্রবেশ গেটের দিকে যাচ্ছিলেন। তখন পুলিশ দুদিক থেকে তার হাতের ডানায় ধরে রাখে। আমিও তার একহাত ধরে সঙ্গে হাঁটতে থাকি। একটু আগানোর পর সাদা পোশাকে পুলিশের সংখ্যা আরো বেড়ে যায়। কোর্টের প্রবেশগেট পার হওয়ার সময় এক ধরনের টানাটানি। আমার চেষ্টা ছিল যাতে কোর্ট গেটের বাইরে না নিতে পারে। তবে তাদের সঙ্গে কুলিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি।
কোর্ট গেট পার হওয়ার পর তারা কার্ড দেখিয়ে বলে আমরা প্রশাসনের লোক। আপনি চলে যান। নতুবা আপনাকেও নিয়ে যেতে বাধ্য হব। এরপর আর কিছুই করার ছিল না তখন। একপর্যায়ে সামনে থেকে একটা গাড়ি আসে। দ্রুত এটাতে উঠিয়ে নিয়ে চলে যান।
সুখরঞ্জন বালী অপহরণের সুষ্ঠু তদন্ত হোক, জড়িতদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা গেলেই ন্যায়বিচারের পথ কিছুটা হলেও উন্মুক্ত হবে।
লেখক : আমার দেশের আবাসিক সম্পাদক, লন্ডন