গাজা শহরের আল-শিফা হাসপাতালের কাছে গত রোববার (১০ আগস্ট) সন্ধ্যায় ইসরাইলি বিমান হামলায় শহীদ হন আল-জাজিরার যে পাঁচ সাংবাদিক, তাদেরই একজন ২৮ বছর বয়সি আনাস আল-শরিফ। অন্য চারজন হলেন রিপোর্টার মোহাম্মদ কুরেইকেহ, ক্যামেরাম্যান ইব্রাহিম জাহের, মোহাম্মদ নুফাল ও মুয়ামেন আলিওয়া। আল-শিফা হাসপাতালের কাছে মিডিয়াকর্মীদের জন্য তৈরি একটি তাঁবুতে অবস্থান করার সময় তাদের হত্যা করা হয়। এই হামলাকে ‘টার্গেটেড হত্যাকাণ্ড’ বলে উল্লেখ করেছে আল-জাজিরা। এই হত্যাকাণ্ডের পর আনাস আল-শরিফের মর্মস্পর্শী ভাষায় লেখা একটি চিঠি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। চার মাস আগে লেখা এই চিঠিটি শহীদ হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করেন তার একজন বন্ধু।
চিঠিতে আনাস লিখেছেন, ‘এটি আমার শেষ ‘উইল’ ও আমার শেষ বার্তা। যদি আমার এই কথাগুলো আপনাদের কাছে পৌঁছায়, তবে জানবেন ইসরাইল আমাকে হত্যা এবং আমার কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করতে সফল হয়েছে। আল্লাহ জানেন, যেদিন থেকে আমি জীবন শুরু করেছি, জাবালিয়া শরণার্থীশিবিরের গলিপথ ও মহল্লায়, সেদিন থেকেই আমি আমার জনগণের পাশে দাঁড়াতে এবং তাদের কণ্ঠস্বর হতে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছি।’
আনাস আশা করেছিলেন তিনি দখল করা আশকেলন (আল-মাজদাল) শহরে তার পরিবারে ফিরে যাবেন। কিন্তু তা আর হয়নি। তাই তিনি লিখেছেন‘আল্লাহর ইচ্ছাই চূড়ান্ত, তার হুকুমই শেষ কথা। আমি জীবনের প্রতিটি খুঁটিনাটি ব্যথা অনুভব করেছি। বারবার ক্ষতি ও শোকের স্বাদ পেয়েছি। তবু আমি সত্যকে বিকৃত বা গোপন না করে তা তুলে ধরতে কখনো দ্বিধা করিনি। আল্লাহ সাক্ষী থাকুন, তাদের বিরুদ্ধে যারা নীরব থেকেছে, আমাদের হত্যাকে মেনে নিয়েছে, আমাদের শ্বাসরোধ করেছে, আমাদের শিশু ও নারীদের লাশেও যাদের হৃদয় গলেনি আর যারা আমাদের ওপর দেড় বছরের বেশি সময় ধরে চলা গণহত্যা থামায়নি।’
চিঠিতে আনাস গাজার মানুষকে পরামর্শ দিয়ে বলেন, ‘সীমাবদ্ধতা যেন আপনাদের চুপ করাতে না পারে, সীমানা যেন আপনাদের আটকাতে না পারে। আপনারা দেশের মুক্তি ও জনগণের স্বাধীনতার সেতু হয়ে উঠুন, যাতে মর্যাদা ও স্বাধীনতার সূর্য আমাদের দখল করা মাতৃভূমিতে উদিত হয়।’ তিনি অনুরোধ করেন, তার পরিবারÑবিশেষ করে ছোট মেয়ে, ছেলে, স্ত্রী ও মায়ের যত্ন নিতে, যাদের বড় হতে তিনি দেখার সুযোগ পাননি। তিনি চিঠিতে লিখেছেন, ‘যদি আমি মারা যাই, তবে আমি আমার নীতিতে অটল থেকে মৃত্যুবরণ করব। আল্লাহর সামনে সাক্ষ্য দেব যে, আমি তার ফয়সালায় সন্তুষ্ট। তার সাক্ষাতে আনন্দিত এবং নিশ্চিত যে, আল্লাহর কাছে যা আছে, তা উত্তম ও চিরস্থায়ী। তোমরা গাজাকে ভুলে যেও না, আর আমাকে তোমাদের দোয়া এবং ক্ষমাপ্রার্থনার মধ্যে স্মরণ রেখো।’
আনাস আল-শরিফ ছিলেন গাজার ফিলিস্তিনিদের কাছের একজন মানুষ, তাদের হৃদয়ে স্থান করে নেওয়া সত্যিকারের ‘হিরো’দের একজন। গাজার ফিলিস্তিনিরা সাংবাদিকদের খুব একটা পছন্দ করে না, বরং তারা মিডিয়াকে ঘৃণাই বেশি করে। এর কারণ, সাংবাদিকরা গাজার ঘটনাবলিকে অতিরঞ্জিত করে মিডিয়ায় তুলে ধরেন। ফিলিস্তিনিদের অতিমানব হিসেবে চিত্রিত করেন, যারা ইসরাইলের নির্বিচার হামলা, খাদ্য ও পানির তীব্র সংকট এবং প্রিয়জন হারানোর মুখেও প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।
অন্যদিকে, মিডিয়া অনেক সময়ই আমাদের ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবে চিত্রিত করে পরিবারের সদস্যদের হত্যা ও বাড়িঘর ধ্বংস করাকে ন্যায়সংগত প্রমাণের চেষ্টা করে। সাংবাদিকরাই তাদের লেখনীর মাধ্যমে গাজার ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে এসব করে আসছে। কিন্তু আনাস ছিলেন ভিন্ন ধরনের একজন সাংবাদিক। আনাস আল-শরিফ কখনো সত্যকে বিকৃত করেননি। এ জন্য তিনি ছিলেন গাজার সব মানুষের প্রিয় একটি মুখ, প্রিয় একজন মানুষ। আমাদের শরণার্থীশিবিরেই বেড়ে উঠেছেন তিনি।
ইসরাইলের নির্বিচার বোমা হামলা, খাদ্য ও পানির তীব্র সংকটসহ আমাদের সব দুর্ভোগ ও দুঃখ-কষ্টের সাথি ছিলেন আনাস।
অন্য ফিলিস্তিনিদের মতো তিনিও তার প্রিয়জন হারিয়েছেন ইসরাইলি হামলায়। কিন্তু এসব সত্ত্বেও তিনি কখনোই আমাদের ত্যাগ করে অন্য কোথাও চলে যাননি। বরং যেকোনো মুহূর্তে মৃত্যুর ঝুঁকি মাথায় নিয়ে গাজার মাটি কামড়ে পড়েছিলেন ফিলিস্তিনিদের দুঃখ-দুর্দশা ও দুর্ভোগকে তার লেখনীর মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরতে। তিনি ছিলেন সত্যিকারের এক ফিলিস্তিনি বীর।
আনাস আল-শরিফ গাজা উপত্যকায় আল-জাজিরার পক্ষে সাংবাদিকতা শুরু করেন ইসরাইলের গণহত্যা মুরুর প্রথম দিকেই। কিন্তু অল্পদিনেই তিনি গাজার ফিলিস্তিনিদের কাছে পরিচিত মুখ হয়ে ওঠেন। ইসরাইলি বাহিনীর অব্যাহত হুমকির মুখেও আনাস ও ইসমাইল আল গোওল উত্তর গাজা থেকে খবর সম্প্রচার বন্ধ করেননি।
এই দুজন সাংবাদিকের গভীর বন্ধুত্ব, সুখ-দুঃখের মুহূর্তগুলো ভাগাভাগি করে নেওয়া তাদের আমাদের কাছের মানুষ করে তোলে। কিন্তু ইসমাইল গত বছর ইসরাইলি হামলায় শহীদ হওয়ার পর আমরা আমাদের একজন ভাই হারানোর বেদনায় শোকাভিভূত হয়ে পড়েছিলাম। এরপর থেকে আনাসই ছিলেন আমাদের একমাত্র ভরসা, যিনি নির্ভয়ে সত্যকে তুলে ধরতেন।
গত মাসে গাজা উপত্যকায় ইসরাইল সৃষ্ট দুর্ভিক্ষের ওপর প্রতিবেদন তৈরি করার সময় ক্ষুধাকাতর মানুষের দুর্বিষহ অবস্থা দেখে নিজের ক্যামেরার ওপর কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন আনাস।
তখন সবাই তাকে বলেছিলেন, ‘তুমি থেমে যেয়ো না, কারণ তুমিই আমাদের একমাত্র কণ্ঠস্বর।’ প্রকৃতপক্ষেই আনাস ছিলেন অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় আমাদের প্রকৃত কণ্ঠস্বর। আমরা সবসময়ই কল্পনা করতাম, গাজায় ইসরাইলি গণহত্যার অবসান ঘটার খবরটি আমরা আনাসের প্রতিবেদনের মাধ্যমে তার কণ্ঠ থেকেই প্রথম শুনতে পাব। কারণ এই ঘোষণাটির মুহূর্ত উচ্চারণের জন্য আনাসের চেয়ে যোগ্য আর কোনো সাংবাদিক বিশ্বে নেই।
আমার কাছে আনাস ছিলেন একজন রিপোর্টারের চেয়েও অনেক বেশি কিছু। তিনি ছিলেন আমার অনুপ্রেরণার উৎস। তার জন্যই আমি লেখালেখির জন্য কলম হাতে তুলে নিতে উৎসাহিত হই। আমি আনাসকে দেখেছি ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত অবস্থায়ও বিরামহীনভাবে রিপোর্টিং করতে। শীত, গ্রীষ্মসহ সব ঋতুতে সর্বদা মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে গাজায় ছুটে বেড়িয়েছেন আনাস। তিনিই আমার মনে এই বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছেন, যেখানে পৌঁছা আমাদের পক্ষে কখনো সম্ভব নয়, আমাদের লেখা সাগর, মহাসাগর পেরিয়ে বিশ্বের সেসব প্রান্তের সব মানুষের কাছে পৌঁছে যেতে সক্ষম। আনাসই আমাদের এটি শিখতে বাধ্য করেছেন, আমাদের প্রতিদিনই কাজ করতে হবে, কথা বলতে হবে। আমাদের কথা কেউ না কেউ অবশ্যই শুনবে।
আনাস আজ আমাদের মধ্যে নেই। তিনি গাজায় ইসরাইলের বর্বরতা, গণহত্যা, পরিকল্পিতভাবে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিসহ ইহুদি বর্ণবাদী দেশটির সব অন্যায়ের চিত্র তার ক্যামেরা ও কণ্ঠস্বরের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর বিবেকের কাছে তুলে ধরে কান্নাজড়িত কণ্ঠে এর ন্যায়বিচার চেয়েছিলেন। কিন্তু বিশ্ব তার কথা শোনেনি, তার আবেদনকে গুরুত্ব দেয়নি। গাজায় ইসরাইলের বর্বরতার বিরুদ্ধে বিশ্ববাসীয় নীরবতায় প্রমাণ হয়েছে, বিশ্ব বেছে বেছে বিশেষ কিছু ক্ষেত্রে নজর দেয়। সবদিকে, সবার দিকে তাকায় না, গুরুত্ব দেয় না। মানুষের জীবনের চেয়ে তাদের কাছে অর্থনৈতিক চুক্তি ও রাজনৈতিক স্বার্থ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
আনাস, আমি আশা করেছিলাম তুমি শহীদ হওয়ার আগেই গাজার যুদ্ধ শেষ হবে, যাতে আমি তোমাকে খুঁজে বের করে এ কথা বলতে পারি, আমরা সফল হয়েছি। আমাদের কণ্ঠস্বর সাগর-মহাসাগর পেরিয়ে বিশ্বের সব অঞ্চলের মানুষের কাছে পৌঁছেছে। আমি তোমাকে এ কথাও বলতে চেয়েছিলাম, তুমিই আমার অনুপ্রেরণা, রোল মডেল।
কিন্তু তোমার সাংবাদিকতার যাত্রা থেমে গেছে, তবে গণহত্যাকারী যুদ্ধ শেষ হয়নি। তোমাকে হারিয়ে নিজেদের আজ বড্ড অসহায় লাগছে। গাজা তোমার মতো আরেকজন সাংবাদিকের জন্ম দিতে পারবে না। তুমি ও তোমার সহকর্মীদের এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডে আমরা নীরব থাকব না। আমরা যারা বেঁচে আছি, তোমাদের রেখে যাওয়া অসমাপ্ত কাজ অবশ্যই আমরা সমাপ্ত করব।
আল জাজিরা থেকে ভাষান্তর : মোতাবেল জামালী