বাংলাদেশের রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদ একটি কেন্দ্রীয় ইস্যু, যা শুধু পরিচয়ের প্রশ্নই নয়, রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক ও আদর্শিক ভিত্তি নির্ধারণেও মুখ্য ভূমিকা পালন করে। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির কিছু নেতার বক্তব্যে দেখা যাচ্ছে, তারা বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের পরিবর্তে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতি সহানুভূতি দেখাচ্ছেন, যা বিস্ময়কর ও রাজনৈতিকভাবে সমস্যাজনক। কারণ, বিএনপির রাজনৈতিক আত্মপরিচয় গড়ে উঠেছিল এই বাঙালি জাতীয়তাবাদের সীমাবদ্ধতার বিরুদ্ধে প্রতিক্রিয়াস্বরূপ, একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, বাস্তবসম্মত ও সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ইতিহাসের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ জাতীয় পরিচয় নির্মাণের লক্ষ্যে।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের ইতিহাস ও সংকটকে বোঝার জন্য আমাদের ফিরতে হবে উনিশ শতকের শেষভাগে, যখন বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বাঙালির উৎপত্তি’ নামক প্রবন্ধে বাঙালি জাতির প্রথম তাত্ত্বিক কাঠামো নির্মাণ করেন। পরিপ্রেক্ষিতে। বঙ্কিমচন্দ্র যে ‘বিশুদ্ধ আর্য বাঙালি’ কল্পনা করা করেছিলেন, সেখানে মুসলমানদের স্থান হয়নি। তারা ছিলেন ‘সংকর’ আর্য নয়, সংস্কৃতি থেকে বিচ্যুত। সেই চিন্তা থেকেই গড়ে ওঠে এক ‘হিন্দু বাঙালিত্ব’, যার কেন্দ্র ভাষা, রবীন্দ্রসংগীত, নির্দিষ্ট উৎসব আর একটি উচ্চবর্ণীয় সংস্কৃতির অভিজ্ঞান। ভাষা, ভূখণ্ড ও আর্য জাতিগত উত্তরাধিকারের ওপর ভিত্তি করে তিনি যে বাঙালিত্বের এই যে সংজ্ঞা দেন, তা আজও বাংলাদেশে মূলধারার জাতীয়তাবাদ গঠনের ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করে যাচ্ছে। কিন্তু এই বাঙালিত্বের সংজ্ঞা থেকেই যে মুসলমান, বিশেষত কৃষিজীবী ও গ্রামীণ মুসলমান, তাদের ‘অনার্য’, ‘সংকর’ এবং পরিণামে বাঙালিত্বের পরিধির বাইরে স্থান দেওয়া হয়, তা অস্বীকার করার সুযোগ নেই।

বাঙালি জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি ও বিকাশ মূলত ঊনবিংশ শতকের নবজাগরণের মধ্যে।

একাত্তরে বাংলাদেশ স্বাধীনতা হলে পরে এই বাঙালি জাতীয়তাবাদই রাষ্ট্রীয় আদর্শ হয়ে ওঠে। ১৯৭২ সালের সংবিধান বাঙালি জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রীয় পরিচয়ের ভিত্তি হিসেবে নেওয়া হয়। একদিকে এটি পাকিস্তানি সামরিক জাতীয়তাবাদের প্রতিক্রিয়া ছিল, অন্যদিকে ছিল একক সংস্কৃতি চাপিয়ে দেওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। ‘বাঙালি’ পরিচয় বাধ্যতামূলক করা হয় সব নাগরিকের জন্য, যা ছিল পাহাড়ি আদিবাসীদের জন্য নিপীড়ন এবং মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য সাংস্কৃতিক অসাম্য। আপনি যদি হিজাব পরেন, ইসলামি কনটেন্ট বানান, কিংবা বাংলার বাইরে কোনো পরিচয় তুলে ধরেন, আপনি ‘প্রগতিশীল’ নন, বরং ‘প্রতিক্রিয়াশীল’।

এই ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’-এর ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী করেছে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগণকে। তারা সংখ্যায় বেশি হলেও সাংস্কৃতিক পরিসরে ছিল কার্যত ‘অচ্ছুত’। প্রধানধারার টিভি নাটকে ইসলামকে দেখা যায় ‘গোঁড়ামি’র রূপে, ইসলামি পোশাকের মানুষ মানেই ‘জঙ্গি’র সম্ভাব্য রূপ আর ইসলামি রাজনৈতিক ভাষা রাষ্ট্র বিরোধিতার সমার্থক। যেন মুসলমানদের ধর্ম, সংস্কৃতি, নৈতিক বিশ্বাস সবই রাষ্ট্রের জন্য ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ কিছু।

এই অবস্থাকে আরো তীব্র করেছে আওয়ামী লীগ সরকারের তথাকথিত ‘সেক্যুলার’ রাজনীতি। ২০০৮ সালের পর থেকে, বিশেষত ২০১৩ সালের শাহবাগ আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে, দেশজুড়ে এক উগ্র ধর্মনিরপেক্ষতা ছড়িয়ে পড়ে। যার মূল টার্গেট ছিল ইসলাম এবং ইসলাম-অনুপ্রাণিত রাজনৈতিক শক্তিগুলো। হেফাজতের বিরুদ্ধেই শুধু দমন-পীড়ন নয়, বরং সাধারণ মুসলমানদের বিশ্বাস, আচার ও অভ্যাসকেও সন্দেহের চোখে দেখা শুরু হয়। এ এক ধরনের ‘রাষ্ট্রীয় সাসপেনশন’, আপনি সংখ্যাগরিষ্ঠ হলেও, রাষ্ট্র আপনাকে তার ‘অন্তরে’ জায়গা দেয় না।

এই সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক নিপীড়নের প্রেক্ষাপটে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ ছিল এক ঐতিহাসিক উত্তর। জিয়াউর রহমান শুধু আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতি করার জন্য নয়, বরং এক বিকল্প রাষ্ট্রপরিচয় নির্মাণের জন্য এটি প্রবর্তন করেন। ‘বাংলাদেশি’ পরিচয় একটি ভূখণ্ড ও নাগরিকত্বভিত্তিক পরিচয় যেখানে আপনি হিন্দু, মুসলমান, আদিবাসী, পাহাড়ি, শহুরে, গ্রামীণ যেই হোন না কেন, আপনি রাষ্ট্রের সমান অংশীদার।

এখানে ‘বহুদলীয় গণতন্ত্র’-এর বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। জিয়াউর রহমান একাধিক দল ও মতকে রাজনীতির প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোতে নিয়ে আসেন। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র একটি অংশগ্রহণমূলক পরিসর পায়। আওয়ামী লীগের জাতীয়তাবাদ যেখানে ভাষা ও সংস্কৃতির ভিত্তিতে ‘এক জাতি, এক সংস্কৃতি’ তৈরি করতে চায়, জিয়ার জাতীয়তাবাদ সেখানে রাজনৈতিকভাবে ‘বৈচিত্র্য মেনে নেওয়া’র দর্শন দাঁড় করায়।

এই বৈচিত্র্যের গ্রহণযোগ্যতাই আজ আবার নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। কারণ, ২০২৪ সালের জুলাই বিপ্লবের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রযন্ত্র ছিল কার্যত একটি সাংস্কৃতিক শ্রেণি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, যাদের রাজনৈতিক পরিচয় সেক্যুলার, কিন্তু যা নিজেদের সংস্কৃতির দিক থেকে পশ্চিমা উদারতাবাদ দ্বারা প্রভাবিত এবং ধর্মকে রাজনীতি থেকে পুরোপুরি নির্বাসনে পাঠানো তাদের মতাদর্শিক কর্মসূচির অংশ হিসেবে দাবি করলেও কার্যত ইসলাম ও মুসলিমবিদ্বেষই ছিল তাদের প্রধান পরিচয়।

এই শ্রেণির প্রভাবে মূলধারার গণমাধ্যম হয়ে ওঠে মত ও সংস্কৃতির একমুখী যন্ত্র। এখানে ইসলামি দল মানেই ‘চরমপন্থি’, হিজাব মানেই ‘গোঁড়ামি’ আর ধর্ম নিয়ে কথা বললেই আপনি ‘আধুনিকতার শত্রু’। ধর্মীয় চিন্তা, বিশ্বাস ও অনুশীলনকে রাজনীতির বাইরে ঠেলে রেখে যে ‘সেক্যুলারিজম’ চর্চা হয়েছে, তা আসলে ছিল সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের এক সাংস্কৃতিক গেটোয়াইজেশন।

তবে জুলাই ২০২৪-এর জুলাই বিপ্লবের পর যখন আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনের অবসান ঘটেছে, তখনই তৈরি হয়েছে নতুন সম্ভাবনা। এখন প্রথমবারের মতো মনে হচ্ছে, হয়তো মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ আবার রাষ্ট্রের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিসরে নিজেদের জায়গা ফিরে পাবে। হয়তো ধর্মের নামে জঙ্গিবাদ নয়, বরং ধর্মের ভাষায় নৈতিকতা ও রাজনীতি আবার গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠবে।

এই মুহূর্তে ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ নতুন জীবন লাভ করতে পারে। এটি আর শুধু বিএনপির পরিচয় নয়, বরং সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের আত্মপরিচয়ের ভিত্তি হয়ে উঠতে পারে। তবে এ জন্য বিএনপিকে নিজেদের আদর্শিক ভিত্তিতে স্পষ্টভাবে দাঁড়াতে হবে। ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদ’-এর প্রতি আকৃষ্ট হয়ে ‘মধ্যপন্থা’র আশায় ইতিহাস ও রাজনীতি দুটোই বিসর্জন দিলে, তারা নিজেরাই নিজেদের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে ফেলবে।

আমরা যদি সত্যিই এমন একটি বাংলাদেশ চাই, যেখানে একজন মুসলমানও রাষ্ট্রের অন্তরে জায়গা পায়, একজন হিন্দুও নিরাপদে বসবাস করে, একজন পাহাড়িও তার ভাষা-সংস্কৃতিসহ রাষ্ট্রের অংশীদার হয়, তাহলে আমাদের প্রয়োজন বহুত্ববাদী, অন্তর্ভুক্তিমূলক এক জাতীয়তাবাদ। ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ সেই পথ দেখায়।

এই চিন্তার পরিপ্রেক্ষিতে, প্রয়াত ভাষাতত্ত্ববিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক নোয়াম চমস্কির ‘Manufacturing Consent’ বইটির কথা স্মরণ করা জরুরি। তিনি দেখিয়েছেন কীভাবে গণমাধ্যম ও সাংস্কৃতিক ক্ষমতা ব্যবহার করে কিছু শ্রেণি এক ধরনের ‘রাজনৈতিক বাস্তবতা’ তৈরি করে, যেখানে ভিন্নমত স্বয়ংক্রিয়ভাবে ‘অগ্রহণযোগ্য’ হয়ে যায়। বাংলাদেশে গত এক দশকে ঠিক এই কাজটাই হয়েছে, সংখ্যাগরিষ্ঠের বিশ্বাস ও রাজনৈতিক ভাষা হয়ে গেছে প্রান্তিক, হাস্যকর, এমনকি রাষ্ট্রবিরোধী।

এই ‘সাংস্কৃতিক নির্মাণ’ ভাঙতেই হবে। ‘বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদ’ শুধু এক রাজনৈতিক কৌশল নয়, এটি রাষ্ট্রকে এমনভাবে কল্পনা করার প্রয়াস, যেখানে একাধিক বিশ্বাস, সংস্কৃতি, ভাষা এবং ইতিহাস সহাবস্থান করতে পারে। এটি কোনো ‘রক্ষণশীলতা’র নাম নয়, বরং এটি গণতন্ত্রের গভীরতর সংস্করণ, যেখানে জনগণ শুধু ভোট দেয় না, বরং রাষ্ট্রের ভাবনাতেও অংশ নেয়।

এখন সময় এসেছে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদকে নতুন ভাষায়, নতুন দৃষ্টিতে এবং নতুন রাজনৈতিক কল্পনায় উপস্থাপন করার। এই চিন্তা আবার আমাদের রাষ্ট্রকে এক নতুন আত্মপরিচয় দিতে পারে, যেখানে কেউ অচ্ছুত থাকবে না, কেউ বাদ যাবে না।

লেখক : সহকারী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয় (কাতার)

সূত্র, আমার দেশ