গত ১৩ জুন শুরু হওয়া ইরান-ইসরাইল সংঘাতের মধ্যে ব্যাপক নাটকীয়তার পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২২ জুন মধ্যরাতে ইরানের তিনটি পরমাণু কেন্দ্রে বিমান হামলা করে। সঙ্গে সঙ্গেই ইরানের জবাবি হামলা কোথায় হতে পারে, তা নিয়ে ব্যাপক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ শুরু হয়। বেশিরভাগ বিশ্লেষকেরই অনুমান ছিল, ইরানের টার্গেট হতে যাচ্ছে ইরাক বা সিরিয়ার মতো কোনো একটি ভঙ্গুর রাষ্ট্রের মার্কিন সামরিক ঘাঁটি। কিন্তু তাদের অবাক করে দিয়ে ইরানি মিসাইল ছোড়া হয় উপসাগরীয় দেশ কাতারের মার্কিন ঘাঁটি লক্ষ করে।

তেলসমৃদ্ধ উপসাগরীয় দেশগুলোকে সম্ভাব্য ইরানি টার্গেটের তালিকায় না রাখার পেছনে বেশকিছু যুক্তি ছিল।

ব্যাপক সম্পদশালী হওয়ার কারণে আমেরিকার ঘাঁটি থাকার পাশাপাশি দেশগুলো নিজেরাও সামরিক দিক দিয়ে শক্তিশালী। অন্যদিকে ইরান অর্থনৈতিকভাবেও তাদের সঙ্গে বাণিজ্যের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। তাছাড়া উপসাগরীয় দেশগুলোর সঙ্গে কয়েক বছর ধরে চলা কূটনৈতিক টানাপোড়েন শেষে ইরান সবেমাত্র স্বাভাবিক সম্পর্কে পৌঁছেছিল। তিলে তিলে জোড়া লাগানো সম্পর্ক ইরান এত দ্রুত হুমকির মধ্যে ফেলবে, সে উপসংহার টানা যেকোনো বিশ্লেষকের পক্ষে কষ্টসাধ্যই ছিল বৈকি।

পাশাপাশি ইরান-ইসরাইল সংঘাত শুরু হওয়ার পর থেকেই উপসাগরীয় দেশগুলো ইসরাইলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নিয়েছে, যা কয়েক বছর আগেও অকল্পনীয় ছিল। বিশেষ করে ২০২০ সালের ‘Abraham Accords’-এর মাধ্যমে ইসরাইলের সঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাত ও বাহরাইনের সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ-পরবর্তী রসায়নকে অনেক বিশ্লেষক দেখছিলেন ‘ইরানবিরোধী অক্ষ’কে শক্তিশালী করার বিষয় হিসেবে। সৌদি আরব আনুষ্ঠানিকভাবে ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক না করলেও দুদেশের অনানুষ্ঠানিক কিন্তু ক্রমবর্ধমান নানা সমঝোতা-সহযোগিতা দাবিটির সত্যতার পক্ষেই পাল্লা ভারী করছিল।

২০২৩ সালে জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে নেতানিয়াহু দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা দেন, তিনি আরব দেশগুলোকে সঙ্গে নিয়ে ইরান নামক শয়তান রাষ্ট্রকে পরাজিত করবেন। সৌদি আরবসহ কেউই তখন এর প্রতিবাদ করেনি। পাশাপাশি গাজায় গণহত্যার শুরুর পর একদিকে ফিলিস্তিনপন্থি অ্যাক্টিভিস্টদের হয়রানি করা, অন্যদিকে ক্ষেত্রবিশেষে বরং ইসরাইলকেই সহায়তা করার ইঙ্গিত দিচ্ছিল সৌদি আরব, বাহরাইন আর আরব আমিরাতের মতো দেশগুলো যে, তারা ইসরাইলকে কতটা আপন করে নিয়েছে।

এ অবস্থায় ইরানে ইসরাইলি হামলার বিরুদ্ধে উপসাগরীয় দেশগুলোর একাট্টা শক্ত অবস্থান একটু অবাক করা মতোই ছিল। সৌদি আরব তো এক ধাপ এগিয়ে উল্লেখ করে, ইসরাইল তার ‘ভাইয়ের মতো’ প্রতিবেশীর ওপর হামলা চালিয়েছে। অথচ ২০১৯ সালে ট্রাম্প তার আগের শাসনামলে যখন ইরানে হামলার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে, সেসময়কার কংগ্রেসম্যান ও বর্তমান মার্কিন গোয়েন্দা প্রধান তুলসী গ্যাবার্ড বলেছিলেন, ‘সৌদি আরব চায় আমেরিকা ইরানে হামলা করুক।’

সৌদি-ইরান দ্বন্দ্ব বিশ্ব রাজনীতিতে অন্যতম চর্চিত বিষয় ইরানে ইসলামি বিপ্লব হওয়ার পর থেকেই। আদর্শ, স্বার্থ ও আঞ্চলিক বাস্তবতার কারণে নিজস্ব সংজ্ঞায় ইসলামিক দাবি করা দেশ দুটি বারবার তিক্ততায় জড়িয়েছে।

তবে এ দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে গত দশকে আরব বসন্তের সময়, বিশেষ করে ইয়েমেনকে কেন্দ্র করে। সেখানে ক্ষমতার শূন্যতাকে কেন্দ্র করে শিয়া ও সুন্নিদের মধ্যে যে যুদ্ধ শুরু হয়, সেখানে এই দুই দেশ ব্যাপকভাবে জড়িয়ে পড়ে। ইরান শিয়া হুথিদের রসদ জোগায়, অন্যদিকে সৌদিরা সুন্নি গ্রুপগুলোকে পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি ব্যাপকভাবে তাদের বিমান বাহিনী ব্যবহার করে। সঙ্গে যুক্ত হয় সংযুক্ত আরব আমিরাত।

ইরানের সঙ্গে সৌদি আরব ও তার মিত্রদের এই দ্বন্দ্ব কোথায় গিয়ে ঠেকে সেটা নিয়ে যখন বিশ্লেষকরা উদ্বিগ্ন, তখন এক অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে, যার ফলাফল ছিল আরো বেশি অপ্রত্যাশিত।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা সৌদি আরবের প্রধান পেট্রোলিয়াম সংস্থা আরামকোসহ বেশ কয়েকটি স্থাপনায় হামলা করে। তখন কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায় তাদের তেল উৎপাদন। সৌদি আরবের মাটিতে এ রকম হামলা আগে কখনো হয়নি।

স্বাভাবিকভাবেই তারা অভিযোগের তীর তোলে ইরানের দিকে। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান আয়াতুল্লাহ খোমেনিকে ‘নব্য হিটলার’ বলে আখ্যায়িত করেন। যদিও ইরান অভিযোগ অস্বীকার করে, কিন্তু এটি পরিষ্কার যে, সৌদি আরবের মাটিতে হামলার সিদ্ধান্ত হুথি বিদ্রোহীরা কোনোভাবেই ইরানের সবুজ সংকেত ছাড়া নেয়নি।

অনেকে অনুমান করেছিল, এ রকম হামলা সৌদি আরবকে ইরানের বিরুদ্ধে আরো শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাবে, কিন্তু ঘটে সম্পূর্ণ উল্টো।

হুথিদের সে হামলা সৌদি আরবের জন্য আদতে ছিল একটি ‘wake-up call’। সৌদিরা মার্কিনিদের দশকের পর দশক ধরে যে বিভিন্ন সুবিধা দিয়ে আসছে, তার বিনিময়ে তাদের সবচেয়ে বড় চাওয়াটি ছিল নিরাপত্তা গ্যারান্টি। গত দশকের মাঝামাঝি সময়ে যখন সৌদি আরব আর ইরানের দ্বন্দ্ব তুঙ্গে, তখন রিয়াদ চাচ্ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেন ইরানের বিরুদ্ধে আরো কঠোর হয়। কিন্তু ওবামা প্রশাসন একেবারে উল্টো কাজটি করে। সৌদি অক্ষের ব্যাপক বিরোধিতা সত্ত্বেও মার্কিনিরা ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি করে তার ওপর থেকে অবরোধ প্রত্যাহার করে নেয়। এটা রিয়াদের জন্য ছিল অনেক বড় ধাক্কা।

ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের পর একতরফাভাবে চুক্তিটি থেকে আমেরিকার বের হয়ে যাওয়া সাময়িক স্বস্তি দিলেও শিগগিরই তারা দেখতে পায়, সৌদি আরবে বোমা হামলার পরও যুক্তরাষ্ট্র ইরানের বিরুদ্ধে তাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী শক্ত ব্যবস্থা নিতে আগ্রহী নয়। এটি রিয়াদকে তাদের ইরাননীতি নিয়ে দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য করে। সৌদি আরব ভাবে, ইরানের সঙ্গে ঝামেলা চলতে থাকলে তারাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং ইরান যদি ভয়ংকর কিছু করেও ফেলে তাও পশ্চিমা মিত্ররা এগিয়ে আসবে না।

এর পরপরই করোনা মহামারি ও তেলনির্ভরতাকে কমিয়ে বাণিজ্য ও পর্যটননির্ভর অর্থনীতি গড়ার প্রচেষ্টায় সৌদি অক্ষের দেশগুলো বুঝতে পারে, এক্ষেত্রে সফলতার জন্য ইরানের মতো শক্তিশালী প্রতিবেশীর সঙ্গে দ্বন্দ্বের অবসান অত্যন্ত জরুরি। মূলত একই কারণে তারা ইসরাইলের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়নের দিকেও ধাবিত হয় এ সময়।

২০২১ সালে ইরান ও সৌদি আরব সরাসরি কূটনৈতিক আলোচনা শুরু করে এবং ২০২৩ সালে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ব্যাপারে একমত হয়। সম্পর্ক উন্নয়ন করে উপসাগরের অন্য দেশগুলোও। এরই ধারাবাহিকতায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট এ বছর যখন সে দেশগুলো সফরে আসেন, তখন সেখানে অন্যতম এজেন্ডা ছিল ইরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রকে আলোচনায় বসানো।

এমনকি মার্কিন-ইরান আলোচনাকে ফলপ্রসূ করতে সৌদি প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান তার ভাইকে ইরানে পাঠান তাগাদা দেওয়ার জন্য। এটি ছিল একটি নজিরবিহীন ঘটনা। ইরানও তাকে যথেষ্ট সম্মান প্রদর্শন করে। সৌদি আরব চাচ্ছিল, মার্কিন-ইরান চুক্তির মাধ্যমে একদিকে এই অঞ্চলকে পারস্য-মার্কিন যুদ্ধের বলি হওয়ার ঝুঁকি থেকে মুক্ত করা, অন্যদিকে ইরানের পরমাণু বোমার অধিকারী না হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হওয়া।

তাই আলোচনা যখন আলোর মুখ দেখার পথে, তখনই ইসরাইলের অতর্কিত হামলা সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলো ভালোভাবে নিতে পারেনি। ফলে যেই আরব দেশগুলো ছয় বছর আগে মার্কিনিদের ইরানে হামলা করার জন্য উৎসাহ দিয়েছিল, তারাই ২০২৫ সালে এসে ইরানে আগ্রাসনের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেয়।

আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে যে জাতীয় স্বার্থই মুখ্য এবং তা অর্জনের জন্য একই ইস্যুতে মাত্র কয়েক বছরের ব্যবধানে সম্পূর্ণ বিপরীত ধরনের পদক্ষেপ আসতে পারে—সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলোর ইরাননীতি সেটি আবার প্রমাণ করে।

এমন পরিস্থিতিতে ইরান কেন কাতারের মতো উপসাগরীয় একটি দেশে হামলা করল, সেটিও বিতর্কের বিষয়।

সম্ভাব্য উত্তর হচ্ছে, ইরানের মুখ রক্ষার জন্য এর চেয়ে ভালো কোনো উপায় আর ছিল না। কারণ ২০২০ সালে কাসেম সোলায়মানি হত্যাকাণ্ড ইরাকের মাটিতে হলেও ইতিহাসে প্রথমবারের মতো মার্কিন বিমান ইরানে সরাসরি আঘাত হানে। ফলে ইরানেরও প্রয়োজন পড়ে অপ্রত্যাশিত কিছু করে দেখানোর।

আর সেজন্যই ভঙ্গুর ইরাক বা সিরিয়ার পরিবর্তে প্রভাবশালী উপসাগরীয় একটি দেশকে তারা বাছাই করে। নির্দিষ্টভাবে কাতারকে বাছাই করারও বিশেষ উদ্দেশ্য রয়েছে। কারণ উপসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে কাতারের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক সবচেয়ে ভালো। তাই তারা আশা করেছিল, কাতারে লোকদেখানো কয়েকটি মিসাইল ছুড়লে একদিকে মুখ রক্ষা হবে, অন্যদিকে আক্রান্ত দেশ কাতারও চরম পর্যায়ে ক্রুদ্ধ হবে না। তাই হামলার পরপরই ইরানের প্রেসিডেন্ট কাতারকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘ইরানের ছোড়া মিসাইলগুলো তার বন্ধুত্বপূর্ণ ও ভ্রাতৃপ্রতিম প্রতিবেশী কাতারের বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক কর্মকাণ্ড হিসেবে ব্যাখ্যা করা উচিত নয়।’

কাতার যদিও হামলার তীব্র নিন্দা জানায় এবং ঘোষণা দেয় প্রতিশোধ নেবে; কিন্তু মধ্যরাতে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব এলে তারা প্রতিশোধের চেয়ে যুদ্ধবিরতিকে প্রাধান্য দেয়, যেমনটা ইরান আশা করেছিল। তবে হামলাটি কাতার ব্যতীত অন্য কোনো উপসাগরীয় দেশে হলে চিত্রটা ভিন্ন হতে পারত।

প্রায় দুসপ্তাহ ধরে চলা এ যুদ্ধ আপাতত থেমে গেলেও সৌদি আরবসহ উপসাগরীয় দেশগুলোর দিকে কিছু চ্যালেঞ্জ ছড়িয়ে দিয়েছে। সেইসঙ্গে জন্ম দিয়েছে কিছু প্রশ্নের।

উপসাগরীয় দেশগুলো কি এখন এই নিশ্চয়তা পাবে যে ইরান পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করবে না? কারণ আলোচনা করতে গিয়ে প্রতারিত হওয়ার পরে পরমাণু অস্ত্র অর্জনের পক্ষে জনমত এখন অন্য যেকোনো সময়ের চেয়ে ইরানে বেশি। অন্যদিকে যে স্থিতিশীলতার আশায় ইসরাইলের সঙ্গে সৌদি ব্লকের দেশগুলো সম্পর্ক স্বাভাবিক করছিল, গুরুত্বপূর্ণ চুক্তিটি ভন্ডুল করে দেওয়ার পরে কি তারা ইসরাইলকে বিশ্বাস করতে চাইবে?

পরিস্থিতি কোন দিকে গড়ায় তা সময় বলে দেবে। তবে এই যুদ্ধের পরে মধ্যপ্রাচ্য যে আর আগের মতো থাকছে না, এটা অনেকটাই নিশ্চিত।

ইশফাক ফারহান সিয়াম

শিক্ষার্থী, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ

জর্জটাউন ইউনিভার্সিট

সূত্র, আমার দেশ