ব্রিটিশ হাস্যরসগুলো খুবই চমৎকার! ব্রিটেন ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরপরই দেশটির একজন নাগরিক ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়ার কাজে নেতৃত্ব দেবেন; আর সেই লোকটি হচ্ছেন দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার। ট্রাম্প প্রশাসন গাজায় যুদ্ধ বন্ধের জন্য ২০ দফা প্রস্তাব তুলে ধরার পরপরই অবরুদ্ধ এই ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডের জন্য যুদ্ধপরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে প্রাথমিকভাবে টনি ব্লেয়ারের নামটি আলোচনায় আসে।
শত বছর আগে রক্ষণশীল ব্রিটিশ রাজনীতিক আর্থার বেলফোর ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে ইহুদিদের জন্য ‘একটি জাতীয় আবাসভূমি’ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। পরে তারা সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেন ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের মাধ্যমে। এখন তারই উত্তরসূরি হিসেবে মধ্যপন্থি লেবার রাজনীতিক টনি ব্লেয়ার ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইলের পক্ষে নেতৃত্ব দেবেন। তামাশা আর কাকে বলে!
বিজ্ঞাপন
গাজায় যুদ্ধবিরতির জন্য ট্রাম্পের নিজের দেওয়া প্রস্তাব নিয়ে হামাস কর্মকর্তারা যখন কাতারের রাজধানী দোহায় আলোচনা করছিলেন, তখন তাদের হত্যার জন্য টার্গেট করে হামলা চালায় ইসরাইল। কিন্তু এই হামলা নিয়ে ট্রাম্প ছিলেন অনেকটাই নির্লিপ্ত। এরপর তিনি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের যোগদান ঠেকাতে তার যুক্তরাষ্ট্রে আসার ভিসা বাতিল করেন। অথচ ফিলিস্তিন জাতিসংঘের অ-সদস্য পর্যবেক্ষক রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পেয়েছে। কিন্তু তারপরও অধিবেশনে যোগ দিতে মাহমুদ আব্বাসকে নিউ ইয়র্কে আসার সুযোগ দেননি ট্রাম্প।
ট্রাম্পের এসব পদক্ষেপ ফিলিস্তিনিদের আশা-আকাঙ্ক্ষার অবদমনই নয়, বরং তাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিশ্ব ফোরামে আলোচনা করার সুযোগ থেকেও বঞ্চিত করার নামান্তর। গাজায় যুদ্ধ-পরবর্তী অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্ব দিতে ট্রাম্প এখন এমন এক ব্যক্তিকে সামনে আনছেন, যিনি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্র মজুতের মিথ্যা অভিযোগ তুলে ইরাকে সামরিক আগ্রাসন চালানোর জন্য যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান সহযোগী হয়েছিলেন। এখন তিনি তার প্রতিষ্ঠিত ইনস্টিটিউটের মাধ্যমে বিশ্বনেতাদের ‘পরামর্শ’ দেওয়ার বদলে নিজেই শাসক হয়ে মার্কিন-ইসরাইলি পরিকল্পনা অনুযায়ী গাজার ফিলিস্তিনিদের শাসন করার ক্ষমতা পেতে যাচ্ছেন।
অথচ এর আগে ট্রাম্প প্রশাসনের পক্ষ থেকেই যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার অন্তর্বর্তী সরকারের গভর্নর হিসেবে অধিকৃত পশ্চিম তীরের সামির খালিলা নামে এক ফিলিস্তিনির নাম সামনে আনা হয়। কিন্তু মাহমুদ আব্বাসের নেতৃত্বাধীন ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের পুলিশ গত ১০ সেপ্টেম্বর খালিলাকে গ্রেপ্তার করে। এ ঘটনার সঙ্গে মাহমুদ আব্বাসের মার্কিন ভিসা বাতিলের কোনো সম্পর্ক আছে কি না, তা অবশ্য জানা যায়নি। ট্রাম্প প্রশাসন বা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষও এ ব্যাপারে মুখ খোলেনি। এখন আবার টনি ব্লেয়ারকে সামনে আনা হয়েছে গাজার প্রশাসক হিসেবে।
ট্রাম্প প্রশাসনের এসব প্রস্তাব গাজায় যুদ্ধবিরতি আলোচনাকেও ব্যাহত করছে। জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট থাকার সময় তার প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষই যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার প্রশাসন পরিচালনার দায়িত্ব নেবে। কিন্তু ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তা নাকচ করে দেন। এরপর বাইডেন প্রশাসন এ নিয়ে আর কোনো উচ্চবাচ্য করেনি।
গাজা উপত্যকা নিয়ে গত ২৭ আগস্ট হোয়াইট হাউসে আয়োজিত এক বৈঠকে যোগ দেন টনি ব্লেয়ার। সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন ট্রাম্পের জামাতা জারেড কুশনারও। ট্রাম্পের ২১ দফা গাজা প্রস্তাব সেই বৈঠকেই চূড়ান্ত করা হয়। ব্লেয়ার অবশ্য ২১ দফা প্রণয়নের সঙ্গে তার সংশ্লিষ্টতার কথা প্রথম দিকে অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের প্রতিবেদনে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়, ব্লেয়ারের টিম ট্রাম্পের ‘গাজা রিভিয়েরা’ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত ছিল।
ট্রাম্পের এই প্রকল্পটি একজন ইসরাইলি বিনিয়োগকারীর অর্থায়নে গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে বাস্তবায়িত হবে। গাজাকে কীভাবে একটি ‘আকর্ষণীয় বাণিজ্যিক কেন্দ্র’ হিসেবে গড়ে তোলা হবে, তার একটি মডেল তৈরি করছে বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে গাজা থেকে লাখ লাখ ফিলিস্তিনিকে অন্যত্র স্থানান্তরের নামে কার্যত বিতাড়িত করার পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
ইকোনমিস্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ‘গাজা ইন্টারন্যাশনাল ট্রানজিশনাল অথরিটি’ এই উপত্যকা পরিচালনার জন্য ‘সর্বোচ্চ রাজনৈতিক ও আইনি কর্তৃপক্ষ’ হিসেবে পাঁচ বছরের জন্য জাতিসংঘের অনুমোদন পাবে। এই সরকারের কর্মকর্তারা হবেন ফিলিস্তিনি টেকনোক্র্যাট এবং নতুন করে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ গঠন করে তাদের কাছে দায়িত্ব হস্তান্তর না করা পর্যন্ত তারা আন্তর্জাতিক তত্ত্বাবধানে কাজ করবেন।
টনি ব্লেয়ার গাজায় না থেকে অন্যস্থান থেকে তার সচিবালয়ের মাধ্যমে গাজার শাসন কার্যক্রম পরিচালনা করবেন। এই সচিবালয়ে ২৫ জন কর্মকর্তা থাকবেন। আর থাকবে সাত সদস্যের একটি পরিচালনা বোর্ড। প্রাথমিকভাবে এর দপ্তর থাকবে মিসরের আল-আরিশ এলাকায়। এরপর তা গাজায় সরিয়ে আনা হবে। তবে তখনই আনা হবে, যখন গাজাকে নিরাপদ মনে করা হবে। আরব দেশগুলোর একটি বাহিনী গাজার নিরাপত্তা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবে।
ট্রাম্পের প্রত্যাশার ব্যবস্থাপনাটা সব সময়ই সমস্যাবহুল। ট্রাম্প তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ট্রুথ সোশ্যালে ঘোষণা করেছেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যে মহত্ত্ব দেখানোর এটাই সত্যিকারের সুযোগ।’ তিনি আরো দাবি করেন, ‘বিশেষ কিছুর জন্য আমরা এখন সবাই একত্র হয়েছি।’ নেতানিয়াহুর সঙ্গে বৈঠকের আগে এবং তার পরিকল্পনার প্রতি আরব নেতাদের সমর্থন নিশ্চিত করা ছাড়াই ট্রাম্প এসব বক্তব্য দেন। ফিলিস্তিনিরা এই প্রস্তাব মানবেন কি না, সেটাও বিবেচনায় রাখেননি তিনি।
গাজায় অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে ব্লেয়ারের নিয়োগকে প্রত্যাখ্যান করে হামাস বলেছে, তাকে কখনোই গাজায় স্বাগত জানানো হবে না। গাজার ফিলিস্তিনিদের সিনাইয়ে পাঠানোর ইসরাইলি পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করেছে মিসর। সৌদি আরব গাজায় বিদেশি নেতৃত্বাধীন সরকার এবং এর পাঁচ বছর দায়িত্ব পালন করার বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব দেখায়নি।
ট্রাম্পের ২১ দফা পরিকল্পনার বিস্তারিত প্রকাশ্যে আসেনি। যতটুকু মিডিয়ায় এসেছে, তা খণ্ডিত চিত্র। তবে এই চিত্র থেকেই এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে, তিনি গাজা উপত্যকাকে পুরোপুরি অস্ত্রমুক্ত ও হামাস নির্মূল করতে চান। একইসঙ্গে গাজায় ত্রাণ সহায়তা ও বিনিয়োগ আনতে চাইছেন। এগুলো যুক্তরাষ্ট্রের অতি পরিচিত ফরমুলা যাতে অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রতিশ্রুতির পরিবর্তে রাজনৈতিক অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়।
ইসরাইল গাজার যেসব টাওয়ার ধ্বংস করেছে, সেগুলো পুনর্নির্মাণের কথা রয়েছে ট্রাম্পের পরিকল্পনায়। একই সঙ্গে বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার জন্য কয়েকটি অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার পাশাপাশি শুল্কও কমানো হবে। এগুলো হচ্ছে ঔপনিবেশিক নীলনকশা—গাজায় ইসরাইলের দুই বছরের বেপরোয়া হামলায় ৬৫ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হওয়ার পর এখন এই ভূখণ্ডের জনগণের সঙ্গে কোনো আলোচনা না করেই গাজার ভবিষ্যৎ নতুন করে নির্ধারণ করা হবে।
ট্রাম্পের পরিকল্পনায় গাজা থেকে পর্যায়ক্রমে ইসরাইলি সেনা প্রত্যাহার করা হবে। কিন্তু এর কোনো সময়সীমা ও নিশ্চয়তা নেই এই পরিকল্পনায়। অর্থাৎ অনির্দিষ্টকাল গাজার ওপর নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবে ইসরাইল। তাহলে এখানে আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েন করার কথা বলা হচ্ছে কেন? এটা কী অর্থ বহন করে, আন্তর্জাতিক বাহিনী এখানে কী দায়িত্ব পালন করবে—এসব প্রশ্নের কোনো জবাব নেই ট্রাম্পের পরিকল্পনায়। এছাড়া এ ধরনের একটি বহুজাতিক বাহিনী গঠন করতে দীর্ঘ সময়ের প্রয়োজন। মধ্যবর্তী এই সময়ে কী ঘটবে, তা কে বলতে পারে?
ফিলিস্তিনি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিষয়টি শর্ত পূরণের ওপর নির্ভর করছে। প্রাথমিক শর্তগুলো হচ্ছে—হামাসকে নির্মূল, ধ্বংস হয়ে যাওয়া গাজার পুনর্গঠন বা পুনরুন্নয়ন এবং ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের ‘সংস্কার’। যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরাইল ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের সংস্কার দাবি করে আসছে অনেক দিন ধরেই। ফিলিস্তিনিরা তাদের অর্থনীতি ও নিরাপত্তার দেখভাল বা নিয়ন্ত্রণ নিজেরা করতে পারবে না। অন্তর্বর্তী সরকার গঠনে কোনো ভূমিকাও থাকবে না তাদের।
ট্রাম্প যদি সত্যিকার অর্থেই গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর করতে চান, তাহলে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে তাকে অবশ্যই গাজায় ইসরাইলি সেনা অভিযান বন্ধ করতে হবে। এছাড়া যুদ্ধ-পরবর্তী গাজার অন্তর্বর্তী প্রশাসনের প্রধান হিসেবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য একজন ব্যক্তিকে বাছাই করতে হবে। কেননা, টনি ব্লেয়ার এই দায়িত্ব পালনের উপযুক্ত ব্যক্তি নন। ইরাকে আগ্রাসন ও ইসরাইলের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতাই তাকে এই পদের জন্য অনুপযুক্ত ও অযোগ্য করেছে।
দ্য নিউ আরব থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী