বাংলাদেশ তথা সমসাময়িক পৃথিবীতে জুলাই বিপ্লবটি ছিল অনন্য বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত। ব্যাকরণে যেমন নিপাতনে সিদ্ধ প্রত্যয় আছে, তেমনি এ বিপ্লবেরও ভিন্নতা ও স্বাতন্ত্র্য আছে। আমাদের এই মাতৃভূমিতে আন্দোলন, সংগ্রাম, অভ্যুত্থান ও গণঅভ্যুত্থানের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাস। তা সত্ত্বেও এই গণঅভ্যুত্থানের গতি-প্রকৃতিতে, বৈশিষ্ট্যে, কৌশলে এবং গণ-অংশগ্রহণে রয়েছে নতুন জেনারেশনের অভিনবত্ব। অনেকবার ব্যবহৃত হয়েছে জেন-জি বা জেনারেশন জি-এর নতুন পরিভাষা। জেন-জির আরো নাম আছে—পোস্ট-মিলেনিয়াম, আই জেনারেশন এবং জেনারেশন টেকের মতো শব্দাবলি। এদের ডিজিটাল নেটিভ বলেও অভিহিত করা হয়।

এতে বোঝা যায়, এই বিপ্লবের সঙ্গে সর্বশেষ প্রযুক্তির সংযোগ আছে। এ প্রজন্মের সদস্যরা পূর্ব প্রজন্মের সদস্যদের থেকে চিন্তা-চেতনা ও ব্যবহারিকভাবে ভিন্নতর। এরা নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে পরিবর্তিত। বিপ্লব চলাকালে যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম—ফেসবুক, টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপের সর্বাধিক ব্যবহার নিশ্চিত করেছে তারা। সরকার যখন ইন্টারনেট বন্ধ করে দিয়েছে, তখন তারা বিকল্প প্রযুক্তি দ্বারা যোগাযোগ রক্ষা করেছে। আর আন্দোলনের মূল মাধ্যম হিসেবে প্রযুক্তিকে ব্যবহার করেছে। এই নতুন প্রযুক্তি জেনারেশনের বৈশিষ্ট্য আধুনিকতা, গতিশীলতা ও প্রযুক্তি কুশলতা। এরা গতানুগতিক নিয়ম-কানুনকে অতিক্রম করতে সক্ষম। জন-আকাঙ্ক্ষা পূরণে সফল। শুধু বাংলাদেশ নয় মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও পৃথিবীর অন্যত্র এই নতুন প্রজন্মের নতুন প্রতিজ্ঞা প্রতিফলিত হচ্ছে। ‘ইউরোপ-আমেরিকায় উগ্র দক্ষিণপন্থার উত্থান এবং গণতন্ত্রের দুর্দিনে এশিয়া আফ্রিকায় জেন-জির চলতি গণতান্ত্রিক আর্তি বৈশ্বিক পরিসরেও বেশ চমক সৃষ্টি করেছে।’ (আলতাফ পারভেজ, প্রথম আলো, ০৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪)

রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ব্যাখ্যায় আরো বলা হয়, সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের পর পশ্চিমা গণতন্ত্রও যেন ক্রমেই তার আবেদন হারিয়ে ফেলছে। পুরো পৃথিবীতে যেন একটি নতুন কালপর্ব ও নতুন অধ্যায় নির্মিত হতে যাচ্ছে। বাংলাদেশেও জুলাই বিপ্লবে এর নেপথ্যে উপস্থিতি অনুভূত হয়েছে। সামগ্রিক অর্থেই এই গণঅভ্যুত্থানটি অতীতের মতো গতানুগতিক পথে অগ্রসর হয়নি। হয়তো ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক এদের দেখেই বাংলাদেশে একটি মধ্যপন্থি রাজনৈতিক উত্থানের আশা করেছিলেন। (প্রথম আলো, ২৬ জানুয়ারি ২০২৫)

২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে রীতিমতো ভূকম্পনের সৃষ্টি করেছে। বিপ্লবের মতো সামগ্রিক পরিবর্তন না হলেও এই বিপ্লব প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক কাঠামোকে জোরে ধাক্কা দিয়েছে। এর আকস্মিকতায় রাজনৈতিক ব্যবস্থা অকার্যকর হয়ে পড়েছিল সাময়িকভাবে। এখনো সেই অস্থিরতার রেশ রাষ্ট্রকাঠামোয় বারবারই অনুভূত হচ্ছে। অন্তর্বর্তী সরকার প্রাথমিক চ্যালেঞ্জগুলো ভুলে-শুদ্ধে অতিক্রম করলেও এখন একটি প্রান্তিক সময় অতিক্রম করছে। এই বিতর্কের উৎসমূল খুঁজতে গেলে দুটো বিষয় উল্লেখ করা যায়। বিপ্লবের ফলে অবাধ স্বাধীনতার আলোকে জনগণের মনে হিমালয়সম আশাবাদ জাগে।

বিপ্লব-পরবর্তীকালে পুলিশের অসহযোগিতা, আনসার আন্দোলন, শ্রমিক ধর্মঘট, শিক্ষক সমাবেশ এবং বিচার বিভাগীয় তথাকথিত বিচারিক অভ্যুত্থান অন্তর্বর্তী সরকারের অস্তিত্বে আঘাত হানে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ‘উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। এসবের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া অন্তর্বর্তী সরকারকে দুর্বল করে। ছাত্রনেতৃত্বের ওপর এই নির্ভরতা কাঙ্ক্ষিত ছিল। কিন্তু ক্রমেই ছাত্রনেতৃত্ব এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়। বিশেষত ছাত্রনেতৃত্ব রাজনৈতিক দল গঠনের পর কিংস পার্টির বদনাম শুনতে হয় অন্তর্বর্তী সরকারকে। এখন সংগতভাবেই এক বছর পর জুলাই গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যয়ের আলোকে প্রত্যাশার পরিমাপ করতে হচ্ছে।

বাংলা ভাষায় প্রত্যয়ের অর্থ দৃঢ় বিশ্বাস, আস্থা ও নিশ্চয়তা। প্রত্যয় হলো একটি রাজনৈতিক, সামাজিক বা আদর্শগত চিন্তাধারা বা বিশ্বাসের কাঠামো, যা ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কর্মকাণ্ডকে প্রভাবিত করে ও পরিচালনা করে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ‘প্রত্যয়’ শব্দটি ব্যবহার হয় কিছুটা ভিন্ন অর্থে। এখানে এটি সাধারণত বিশ্বাস, দর্শন, নীতিগত অবস্থান বা আইডিওলজি (Ideology) বোঝাতে ব্যবহৃত হয়। সংগতভাবেই চব্বিশ গণঅভ্যুত্থানের মর্মার্থ, তাৎপর্য ও বার্তা বুঝতে এর প্রত্যয়গুলোর ওপর দৃষ্টিপাত করতে হবে। অভ্যুত্থানটির প্রাথমিক পর্যায়ে এটি কোনো রাজনৈতিক, সামাজিক বা অর্থনৈতিক প্রত্যয় নিয়ে উদ্ভূত হয়নি।

রাষ্ট্র আরোপিত মেধা বৈষম্যের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রত্যয়টি অবশেষে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে প্রবাহিত ও সম্প্রসারিত হয় স্বৈরাচারী সরকারের নীতিনির্ধারণ তথা কৌশলগত চরম ভুলের কারণে। এ কথা বলা অবশ্য অসত্য হবে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব রাজনৈতিক বিষয়াদিতে একেবারেই অজ্ঞ বা অসচেতন ছিল। কোটা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে কমপক্ষে সরকারবিরোধী মনোভাবটি প্রকাশিত হয়েছে। সুতরাং নিতান্তই নিরপেক্ষ ও অরাজনৈতিক মনস্তত্ত্ব দিয়ে এর ব্যাখ্যা করা যায় না। কোটা বৈষম্য নিয়ে আন্দোলনটি যখন নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছে, সফলতা অর্জন করে এবং স্বৈরাচার পলায়ন করে, তখন সামগ্রিক সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনই ছাত্রনেতৃত্বের মুখ্য প্রত্যয় হয়ে দাঁড়ায়। আন্দোলন-পরবর্তী কার্যক্রম বিবেচনা করলেই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য পরিষ্কার হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমত, ছাত্রদের দাবি-দাওয়াকেন্দ্রিক আট দফা ঘোষিত হয়। রক্তপাতের পর ছাত্রনেতারা নবমতম দফা সংযোজন করে। আন্দোলনের বিভিন্ন পর্যায়ে দফার সব পরিবর্তন এক দফায় এসে স্থিত হয়।

৩ আগস্ট শহীদ মিনার থেকে সরকার পতনের একদফা ঘোষিত হয়। অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাদের উচ্চারণে বারবার উচ্চারিত হয় বৈষম্যের নিরসন। এই বৈষম্যের নিরসন আর বিদ্যায়তনিক আন্দোলনে সীমিত থাকেনি। বৈষম্যের অবসান হয়ে দাঁড়ায় ছাত্রনেতৃত্বের মূল এজেন্ডা। আগেই বলা হয়েছে, এই আন্দোলনটি বা ছাত্রনেতৃত্ব কোনো ধরনের নেপথ্য, উদ্দেশ্য বা গোপন আদর্শ বা সংগঠন দ্বারা পরিচালিত হয়নি। এই সামগ্রিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে ডান-বামের অপূর্ব অদৃশ্য সমন্বয় হয়। পরবর্তীকালে ভিন্নমত তথা বিতর্ক সৃষ্টি হলেও চরম বা উগ্রপন্থার প্রকাশ ঘটেনি। কেউ কেউ একে দক্ষিণপন্থির উত্থান বললেও দৃশ্যমান রাজনৈতিক সমীকরণ তা প্রমাণ করে না। মধ্যপন্থার ধারণায় নিবদ্ধ থাকাই এই গণঅভ্যুত্থানের দাবি বা প্রত্যয়।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের প্রথম প্রত্যয় বৈষম্যের অবসান। প্রকারান্তরে এটি অর্থনৈতিক বৈষম্য নিরসনের লক্ষ্যে পরিচালিত গণআন্দোলন। বিগত আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের দুঃসহ বৈষম্যের মধ্যে সবচেয়ে ভয়াবহ ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য। এ সময় একটি দুঃশাসনের দুষ্টচক্র (A Vicious Circle of Oligarchy) পুরো জাতির স্কন্ধে ভর করে। শ্রেণিবৈষম্য আকাশসম হয়ে দাঁড়ায়। একটি ধনিক গোষ্ঠী শুধুই ধনী হতে থাকে। আরেকটি শোষিত গরিব শ্রেণি শুধু গরিবই হতে থাকে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান যে গণচরিত্র অর্জন করেছে, অর্থনৈতিক বৈষম্য তার মূল কারণ।

AmarDesh_July-Biplab

রাজনৈতিক নিপীড়ন, সামাজিক অনাচার এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদকে ছাপিয়ে মানুষের যাপিত জীবন যখন অসম্ভব হয়ে ওঠে, তখন আন্দোলন, বিপ্লব ও বিদ্রোহ অনিবার্য হয়ে দাঁড়ায়। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের যে পরিবর্তন, তথা সংস্কার দাবি করে, সে আবেদন ছিল সর্বজনীন। রাষ্ট্রব্যবস্থায় তারা এমন সব সংস্কারের কথা বলেন, যা মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের কাজ করবে। অর্থনৈতিক বৈষম্যের সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা প্রকাশ পেয়েছে—আয় ও সম্পদবৈষম্য। বৈষম্যের এই বাস্তবতা শুধু শহর ও গ্রাম কিংবা ঢাকার সঙ্গে ঢাকার বাইরের এলাকাই সীমাবদ্ধ নয়। এটি আজও নারীশ্রমিক, কৃষিশ্রমিক, অনানুষ্ঠানিক খাতে কর্মরত শ্রমজীবী মানুষ, বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধী জনগোষ্ঠীর মধ্যে আরো প্রবলভাবে দৃশ্যমান।

এছাড়া আদিবাসী জনগোষ্ঠী এবং পাহাড়ি অঞ্চলের বাসিন্দারা সবচেয়ে বেশি বৈষম্যের শিকার। বাংলাদেশে আয়বৈষম্য নিয়ে বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, জিনি সহগ (Gini coefficient) নামে পরিচিত বৈষম্যসূচক ক্রমান্বয়ে বেড়েছে। ২০০৯ সালে এই সূচক ছিল ৩২ দশমিক ৪, যা ২০২৩ সালে বেড়ে হয়েছে ৪৩ দশমিক শূন্য। অর্থাৎ, সমাজের সবচেয়ে ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে আয়ের ব্যবধান বেড়েছে।

উপর্যুক্ত আলোচনায় প্রমাণিত হয়েছে, ২৪ গণঅভ্যুত্থানের প্রত্যাশিত প্রত্যয় ছিল বৈষম্যের অবসান। বাংলাদেশের সমাজ কাঠামো ও রাজনৈতিক বৈশিষ্ট্যের দিকে তাকালে পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রকে বৈষম্যপ্রবণই মনে হবে। অন্তর্বর্তী সরকার এই চিরায়ত বৈষম্যের প্রতিকার না করে বরং বর্তমান ধনিক-বণিক শ্রেণির অর্থনীতিকে সর্বপ্রকার স্থায়িত্ব দেওয়ার চেষ্টা করছে। সরকারকে পুঁজিবাদী গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় যতটা সচেষ্ট মনে হয়, গরিব মানুষের ভাগ্য উন্নয়নে ততটা আগ্রহী মনে হয় না। অন্তর্বর্তী সরকারে প্রগতিশীল ব্যক্তিবর্গের অবস্থানের কারণে অনেকেরই ধারণা ছিল যে হতদরিদ্র মানুষের জন্য সাময়িক কিছু হলেও সরকার করবে। প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূসের ‘থ্রি জিরো’ তত্ত্বের বাস্তব প্রয়োগের সূচনা বাংলাদেশে ঘটবে, প্রগতিশীল মানুষ সে রকম কিছু আশা করছিলেন। তাদের আশা হতাশায় পরিণত হয়েছে।

অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের দ্বিতীয় প্রত্যয় ছিল রাজনৈতিক সংস্কার। তাদের দাবি ছিল—‘এ সমাজ ভাঙতে হবে, নতুন সমাজ গড়তে হবে’। অন্যান্য সময় নতুন সমাজ গঠনের স্লোগান হিসেবে কল্যাণ রাষ্ট্র, সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও ইসলামি সমাজ গঠনের কথা উচ্চারিত হলেও এবার সুস্পষ্টভাবে কোনো মতাদর্শের কথা বলা হয়নি। ইসলামি রাজনৈতিক দলগুলোর বড় বড় সমাবেশ থেকেও ইসলামি রাষ্ট্র নির্মাণের আশু কোনো কর্মসূচি ঘোষিত হয়নি। মধ্যপন্থার অনুকূলে সেটাও একটি উদাহরণ। বাম তথা প্রগতিশীল রাজনৈতিক ব্যক্তি ও দলগুলোর পক্ষ থেকে উগ্র ও চরমপন্থার রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষিত হয়নি। থিসিস, এন্টি থিসিস এবং সেনথিসিসের মাধ্যমে অনাগত ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে একটি উদারনৈতিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র নির্মিত হবে বলে আশা করা যায়।

রাষ্ট্র নির্মাণের যে সংস্কার কর্মসূচি এখন একটি প্রান্তিক পর্যায় অতিক্রম করছে, তা বাংলাদেশের সমসাময়িক রাজনৈতিক উন্নয়নের পথে একটি মাইলফলক বলে বিবেচিত হবে। রাষ্ট্রের মৌলিক ১৯ সংস্কার বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন একমত হয়েছে। এ বিষয়গুলো হচ্ছে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ নমনীয়করণ, কমিটির ভাগাভাগি, নির্বাচনি এলাকার সীমানা নির্ধারণ, রাষ্ট্রপতির ক্ষমাসংক্রান্ত বিধান আইনানুগকরণ, বিচার বিভাগীয় বিকেন্দ্রীকরণ, জরুরি অবস্থা ঘোষণা সীমিতকরণ, প্রধান বিচারপতি নিয়োগ, প্রধানমন্ত্রীর একাধিক পদে থাকার বিধান, নির্বাচন কমিটি গঠন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদকাল, সংসদে নারী প্রতিনিধিত্ব, সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পদ্ধতি, তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠা, নাগরিকের মৌলিক অধিকার সম্প্রসারণ, রাষ্ট্রীয় মূলনীতি নির্ধারণ এবং সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বিধান ইত্যাদি। এদিকে জুলাই সনদের বিষয় চূড়ান্তকরণের পথে।

কয়েকটি বিষয় একমত হতে পারেনি জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার আনার লক্ষ্যে ছয়টি কমিশনের যেসব প্রস্তাব রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলো নিয়ে জুলাই জাতীয় সনদ তৈরি করা হবে। তবে জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছার বিষয়াবলি এবং সনদ বাস্তবায়নের পদ্ধতি নিয়ে বিভেদ-বিতর্ক রয়ে গেছে। এই সনদকে আইনি ভিত্তি দেওয়ার দাবি জানিয়ে এসেছে কিছু রাজনৈতিক দল। তবে বিএনপি আইনি মর্যাদার চেয়ে রাজনৈতিক ঐকমত্যকে অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে। সবশেষে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার বিষয়ে যদি একমত নাও হতে পারে রাজনৈতিক দলগুলো, তাহলে পরে সব অর্জনই ব্যর্থ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকির মুখে পড়বে।

জুলাই অভ্যুত্থানের তৃতীয় প্রত্যয় হচ্ছে স্বৈরাচার এবং তার সহযোগীদের বিচার অনুষ্ঠান। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠিত হয়েছে। প্রধান আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র করা হয়েছে। আশা করা যায় আইনানুগভাবে এবং নিয়মতান্ত্রিকভাবে যত শিগগির সম্ভব বিচারকাজ সম্পন্ন হবে। প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপি দুবছরের মধ্যে সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্ন করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। সব রাজনৈতিক দল উপরোক্ত তিনটি প্রত্যয়—বৈষম্য দূরীকরণ, সংস্কার কার্যক্রম সম্পন্নকরণ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে ঐকমত্য পোষণ করছে। সুতরাং প্রত্যয় ও প্রত্যাশার আবর্তন-বিবর্তনে প্রত্যাশার আলোয় উদ্ভাসিত হবে বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র—এই প্রত্যাশা সবার।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক, সাবেক অধ্যাপক

সরকার ও রাজনীতি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র, আমার দেশ