‘গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা’ আজকের বিশ্বরাজনীতির এক গভীর প্রতীকী ও নৈতিক আন্দোলন, যার উদ্দেশ্য হলো ইসরাইলের আরোপিত গাজা অবরোধ ভেঙে মানবিক সহায়তা পৌঁছে দেওয়া। এটি শুধু খাদ্য ও ওষুধ বহনকারী কিছু নৌযান নয়; বরং এটি বৈশ্বিক মানবতা, ন্যায়বোধ এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনার এক প্রতিবাদী বহিঃপ্রকাশ। ফ্লোটিলার মধ্যে বাংলাদেশের শহীদুল আলম, সুইডেনের পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গসহ ৪০টিরও বেশি দেশের নাগরিকরা যুক্ত হয়েছেন, যাদের মধ্যে রয়েছেন মানবাধিকার রক্ষাকারী, চিকিৎসক, সাংবাদিক ও সাধারণ মানুষ। কিন্তু এই মানবিক উদ্যোগকে ইসরাইলি প্রশাসন যেভাবে আক্রমণ করেছে—তা আন্তর্জাতিক মানবাধিকারের এক জঘন্য লঙ্ঘন এবং রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসবাদের উদাহরণ হিসেবে ইতিহাসে নথিভুক্ত হবে। ইসরাইলি নৌবাহিনী আন্তর্জাতিক জলসীমায় নৌযানগুলো ঘিরে ধরে, জোরপূর্বক আটকে, সক্রিয়তাবাদীদের ওপর হামলা চালায় এবং অনেককে বন্দি করে নিয়ে যায়। এমনকি আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ব্যক্তিত্ব যেমন গ্রেটা থুনবার্গকেও চুল ধরে টেনে, শারীরিকভাবে নির্যাতন করে, ইসরাইলি পতাকায় চুম্বন করতে বাধ্য করা হয়, যা একবিংশ শতাব্দীর সভ্যতার মুখে এক ঘৃণ্য চপেটাঘাত। এ ঘটনা শুধু মানবিক দিক থেকে নয়, দার্শনিক ও রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও একটি গভীর সংকেত বহন করে। মিশেল ফুকো বা হান্না আরেন্ট যেভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বায়োপলিটিকস বা ‘টোট্যালিটারিয়ান ব্যানালিটি অব ইভিল’ (totalitarian banality of evil) নিয়ে আলোচনা করেছেন, তার বাস্তব প্রয়োগ আমরা দেখতে পাই এই ফ্লোটিলার ঘটনায়। এখানে রাষ্ট্রক্ষমতা নিজেকে বৈধতা দিতে গিয়ে এক ধরনের ‘নির্যাতনের আমলাতন্ত্র’ তৈরি করে ফেলেছে, যেখানে একজন রাষ্ট্রের নাগরিক বা মানবিক কর্মীর ওপর সহিংসতা হয়ে ওঠে ‘রাষ্ট্রের নিরাপত্তার অংশ’। এটি হচ্ছে নিপীড়নের আধুনিক রূপ—যেখানে আইনের নামেই আইনের মৃত্যু ঘটে। এই রাষ্ট্রীয় নিপীড়নকে যুক্তিসংগত করার জন্য ইসরাইল আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সামনে ‘সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান’ নামের এক নৈতিক ছলনা ব্যবহার করছে। ফলে মানবিক প্রতিরোধকেও ‘হুমকি’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এর ফলে যে প্রশ্নটি সামনে আসে, তা হলোÑ‘রাষ্ট্র’ এবং ‘মানবতা’—এই দুই ধারণার মধ্যে কোনটি নৈতিকভাবে উচ্চতর?

এ ঘটনাকে সাম্রাজ্যবাদী রাজনীতির পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ইসরাইল আসলে এক নতুন ধরনের সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ (social imperialism) প্রয়োগ করছে। মার্ক্সবাদী দৃষ্টিতে সাম্রাজ্যবাদ শুধু ভূখণ্ড দখল নয়, বরং একটি সমাজের চেতনা, সংস্কৃতি ও নৈতিক কাঠামো দখলের প্রক্রিয়া। ইসরাইল নিজেকে ‘আত্মরক্ষার রাষ্ট্র’ হিসেবে উপস্থাপন করলেও বাস্তবে সে এক ধরনের ‘রেশিয়ালাইজড স্টেট টেরর’ (racialized state terror) চালাচ্ছে—যা ফ্রাঞ্জ ফ্যাননের উপনিবেশবাদী মানসিকতার বিশ্লেষণের সঙ্গে মিলে যায়। ফ্যানন বলেছিলেন, উপনিবেশকারী সর্বদা নিপীড়নকে সভ্যতার নামে বৈধতা দিতে চায় আর নিপীড়িতকে বানিয়ে ফেলে ‘অন্য’—যাকে হত্যা করা নৈতিকভাবে অপরাধ নয়। ইসরাইল সেই ফ্যাননীয় ‘কলোনিয়াল সাইকি’র (colonial psyche) পুনরাবৃত্তি করছে, যেখানে ফিলিস্তিনিদের মানুষ হিসেবে নয়, ‘হুমকি’ হিসেবে দেখা হয়।

যাই হোক, সমুদ্রজুড়ে তৈরি হওয়া একটি মানবিক কনভয় গাজা ফ্লোটিলাকে শুধু নিখাদ কার্যকর কর্মসূচি হিসেবে দেখা যায় না; এটি বিশ্ববর্ণালির নৈতিক কেলেঙ্কারি, রাষ্ট্রীয় শাসন এবং আন্তর্জাতিক আইনের সীমালঙ্ঘনের এক মুক্ত সহিংসতা-পরীক্ষা। গাজা উপত্যকা দীর্ঘকাল ধরে সামরিক, কূটনৈতিক ও মানবিক সংকটের কেন্দ্রবিন্দু। ২০০৫ সালে ইসরাইলি বিস্তৃতি-নীতির ধারাবাহিকতায় গাজার বস্তিগত ব্যবস্থা, এরপর ২০০৭ সালের পর হামাসের প্রশাসন গ্রহণ ও ইসরাইলের-মিসরের সমন্বয়ে আংশিক বা পূর্ণ অবরোধ আরোপ, এসব প্রেক্ষাপটে গাজার জনগোষ্ঠীর খাদ্য-চিকিৎসা ও মৌলিক জীবন-জীবিকা সংকট প্রত্যক্ষভাবে বেড়েছে। এই সংকটের দিকে বিশ্বমানবতার দৃষ্টি আকর্ষণ ও অবরোধ ভাঙার প্রয়াসকে কেন্দ্র করে নানা সময়ের নৌ-অভিযান সংঘটিত হয়েছে; যাদের মধ্যে ২০১০ সালের ‘ম্যাভি মরতা’ (Mavi Marmara) ইস্যু সবচেয়ে আলোচিত। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ‘গ্লোবাল সুমুদ/সমুদ ফ্লোটিলা’ জাতীয় উদ্যোগগুলো পূর্বসূরি ঘটনাবলির ঐতিহ্য ও নৈতিক দাবির ধারাবাহিকতা বহন করে।

রাষ্ট্র-নিরাপত্তা বনাম মানবাধিকার—এই দ্বন্দ্ব ফ্লোটিলা ইস্যুর কেন্দ্রে পড়ে। ইসরাইলের প্রশংসনীয় যুক্তি হলোÑগাজা উপত্যকা থেকে রকেটপ্রহার, সন্ত্রাসী মার্গ-প্রচেষ্টা ও হামাসের সামরিক সক্ষমতা রুখতে অবরোধ একটি ‘নিরাপত্তাব্যবস্থা’; অবরোধের ফলে অস্ত্র বা সামরিক সরঞ্জাম গাজার অভ্যন্তরে প্রবেশ রোধ হয় এবং ইসরাইলের নাগরিকদের নিরাপত্তা বজায় রাখে। এই যুক্তিটি রিয়েলপলিটিক (realpolitik) বা রাজনৈতিক বাস্তবতাবাদে সংগত মনে হতে পারে—রাষ্ট্রের মৌলিক কর্তব্য হলো নিজের নাগরিকদের জীবন ও নিরাপত্তা রক্ষা করা। উল্লেখ করা প্রয়োজন যে জাতীয় নিরাপত্তার প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক আইনের আওতায়ও স্বীকৃত—তবে সেই স্বীকৃতি সীমিত এবং proportionate (অনুপাতভিত্তিক) হওয়া দরকার।

আইনি ও নৈতিকভাবে যে প্রশ্নগুলো মুখ্য হয়ে ওঠে, সেগুলো হলোÑঅবরোধ কি বিরাট পরিসরে ‘কালেকটিভ পানিশমেন্ট’ (collective punishment) (সমষ্টিগত শাস্তি) হিসেবে গণ্য হয় না? আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও মানবিক আইনের দৃষ্টিতে যদি অবরোধ জনসাধারণের মৌলিক অধিকার—যেমন : খাদ্য, চিকিৎসা, পানি, বিদ্যুৎ—শুধু সীমাবদ্ধ না রেখে জরুরি ন্যায্যতাও কেড়ে নেয়, তাহলে সেটি নিষিদ্ধ। তাছাড়া, সমুদ্রবন্দর ও বাণিজ্যিক নৌ-চলাচল সীমিত রাখলে, আন্তর্জাতিক সমুদ্র আইনের (ইউএনসিএলওএস) ফরমান ও কনভেনশনের আলোচনায় ‘ব্লকেড’ কায়েম করা হলে তার নিয়মকানুন আছে—কিন্তু সেসবও প্রোপোরশোনেট (proportionate) ও নন-ডিস্ক্রিমিনটোরি (non-discriminatory) হতে হবে। বাস্তবে গাজার অবরোধ ব্যাপক মানবিক ঘাটতি সৃষ্টি করেছে বলে নানা আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বহু দেশের পর্যবেক্ষক রিপোর্টে ইঙ্গিত আছে; তাই অবরোধকে ‘ন্যায়সংগত নিরাপত্তা পদক্ষেপ’ হিসেবে মান্য করার চেষ্টা এবং তাতে অনুমতি দেওয়ার অপার ক্ষমতা ইসরাইল পেলেও ওই নীতিগত ও নৈতিক দায়-দায়িত্ব প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে ওঠে।

ফ্লোটিলা একই সঙ্গে রাজনৈতিক ভাষার একটি জোয়ার। এখানে ‘সুমুদ’ বা ‘অটলতা’ একটি রাজনৈতিক-প্রতীকী অর্থ ধারণ করে—ফিলিস্তিনি অধিকার ও মানবিক বোধের প্রতি বিশ্বজননী প্রতিশ্রুতি। এই প্রতীকী আক্রমণ বাহিনী ইসরাইলের সামরিক নীতি ও আন্তর্জাতিক সমর্থকশক্তির নীতি-ব্যাখ্যা উভয়েরই পরীক্ষা নেয়। ইসরাইলের নির্দেশে নৌবাহিনীর দ্বারাও ফ্লোটিলা আটক করা হলে আন্তর্জাতিকভাবে ফ্লোটিলার সদস্যরাই—যারা মেডিকেলকর্মী, সাংবাদিক বা পরিবেশকর্মী হতে পারেন—তাদের ওপর শক্তির মাত্রা ও রীতিনীতির ব্যাপারে আন্তর্জাতিক মনোযোগ আকর্ষণ করে। শক্তি প্রয়োগ কী মাত্রায় হবে ? বন্দি-নির্যাতন বা অপমান কি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিবিধিভঙ্গ? উপরোক্ত প্রশ্নগুলোর উত্তর তদন্ত ছাড়া দেওয়া কঠিন।

দার্শনিকভাবে এ ইস্যুতে আমরা শক্তি, সত্য ও নৈতিকতার সংঘাতের মধ্য দিয়ে যাই। হান্না আরেন্টের ‘প্রকাশ্য ক্ষেত্র’ (public realm) ও গণতন্ত্রের ওপর আরোপিত দাবিগুলো এই পরিপ্রেক্ষিতে প্রাসঙ্গিক—যেখানে রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত ও শক্তি প্রয়োগের স্বচ্ছতা অনুপস্থিত। আর যখন প্রকাশ্য ক্ষেত্র দমন ও বঞ্চনায় ডুবে যায়, তখন আপাতত আন্তর্জাতিক জনমত, সামাজিক আন্দোলন এবং নৈতিক প্রতিবাদই আংশিক সমাধান হিসেবে উপস্থিত থাকে। মিশেল ফুকো যখন বলতেন যে শক্তি শুধু দমন নয়—এটি জ্ঞান গঠনের মাধ্যমে স্ব-বিচ্ছিন্নতা ও স্ব-নিয়ন্ত্রণও রচনা করে—তাহলে গাজা-ইস্যুতে ইসরাইলের আধিপত্য শুধু সামরিক নয়, জ্ঞান/ধারণারও আধিপত্য : ‘সন্ত্রাস’Ñরচনা করে গাজাকে নিরাপত্তা-খাতিতে চিহ্নিত করা হয়, যেখানে মানবতাবাদী কথোপকথনকে অবক্রমে অপরাধ বা নিরাপত্তাঝুঁকি বলে আখ্যায়িত করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ফিলিস্তিনি কষ্টকে প্যাথোলোজাইজ (pathologize) করা হয় এবং সামগ্রিক ন্যারেটিভে ইসরাইলের আচরণকে ন্যায্য বলে গঠন করা হয়।

তা ছাড়া, তত্ত্বীয় ও নৈতিক বিশ্লেষণে আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ কনসেপ্ট হলো ‘কোলোনিয়াল সাইকোলজি’—ফ্রান্স ফ্যানন এই পরিপ্রেক্ষিতে গুরুত্বপূর্ণ নাম। ফ্যাননের তত্ত্ব অনুসারে উপনিবেশীকৃত জনগোষ্ঠীর ওপর যে ধরনের অব্যাহত উপেক্ষা, দমন ও মনুষ্যত্ব-হীন আচরণ হয়, তা একটি স্মৃতিশূন্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করে। গাজায় যে মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং দমন রয়েছে—এটি ওই কোলোনিয়াল মাইলস্টোনের আধুনিক রূপ বলে বলা যায়। ফ্যাননের দৃষ্টিতে এ ধরনের দমন-মনোভাব মানবিক পরিচয়ের ক্রমেই হ্রাস ঘটায় এবং দমন করা জনগোষ্ঠীর বিদ্রোহকে অস্বাভাবিক বা ওভার-রিঅ্যাকশনে পর্যবসিত করে উপস্থাপন করে।

মোরাল-ফিলোসফিক্যাল আলোচনায় ‘জাস্ট ওয়ার’ (just war) তত্ত্বও প্রাসঙ্গিক : মাইকেল ওয়ালজারের মতো তত্ত্ববিদরা যুদ্ধ ও সহিংসতার নৈতিক সীমা নির্ণয় করেছেন—কিন্তু গাজা ইস্যুতে প্রশ্ন রয়েই যায়—যুদ্ধের নামে কীভাবে অসামরিকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হবে? ফ্লোটিলা, যাদের উদ্দেশ্য মানবিক সহায়তা পৌঁছানো, তারা নিজেরাই অস্ত্রধারী নয়; তাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ বা কয়েকজনকে আটক করে অপমান করা হলে সেটিও স্তরবিন্যাসে ন্যায়ের বিচারে প্রশ্নবিদ্ধ। আন্তর্জাতিক মানবিক আইন (আইএইচএল) অনুযায়ী অসামরিকদের বিরুদ্ধে আক্রমণ, গ্রুপ-শাস্তি, ব্লকেডের মাধ্যমে মৌলিক সহায়তা জবরদস্তি করা—সবকিছু নির্দিষ্ট সীমায় অবৈধ।

এখানে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় খেলপঙকেও সমালোচনার আওতায় আনা দরকার। পারিবারিক বা জোটীয় কূটনীতি, অস্ত্র সরবরাহ ও রাজনৈতিক সমর্থন ইসরাইলের কৌশলগত অবস্থাকে শক্ত করে। এই পৃষ্ঠে রাজ্যগুলোর দ্বৈতনীতি (double standards) খোলসছাড়া হয়—যেখানে মানবাধিকার-উপদেশক নীতিশাস্ত্র প্রণয়ন করা হয়, কিন্তু ভূরাজনৈতিক স্বার্থের কারণে নির্দিষ্ট রাষ্ট্রকে জানা-অজানা সমর্থন দেওয়া হয়। নীতিশাস্ত্রীয় সমালোচনায় চমস্কির প্রচলিত বক্তব্য উল্লেখযোগ্য : রাষ্ট্রীয় আচরণকে ব্যাখ্যা করার সময় শুধু নৈতিক ভাষা নয়, শক্তি, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক বাস্তবতাকেও উপলব্ধ করতে হয়।

ফ্লোটিলার পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক আইনি প্রতিক্রিয়া ও বিচারযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কখনো কখনো জাতিসংঘের বিভিন্ন তদন্ত-সংসদ ও মানবাধিকার সংস্থা সংঘটিত উত্থাপিত অভিযোগের তদন্ত করে প্রতিবেদন প্রকাশ করে; কিন্তু বাস্তবে আনুষ্ঠানিকতা এবং ক্ষমতার সীমাতেই সেগুলো বাধ্যতামূলক প্রভাব রাখতে পারে। পাশাপাশি আন্তর্জাতিক জনগণের নৈতিক জবাবদিহি—বিমানবাণিজ্য, বন্দর অবরোধ ও মানবিক সাপ্লাইচেইন—এসব কূটনৈতিক সিদ্ধান্তকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। ফ্লোটিলা এবং তৎসমান আন্দোলনগুলো বিশ্বব্যাপী সমর্থন জোগাড় করে যখন, তখন রাষ্ট্রীয় নীতিও প্রভাবিত হতে পারে; তবে দীর্ঘমেয়াদি নীতিগুলো পরিবর্তিত করার জন্য বহুমাত্রিক কূটনৈতিক চাপ, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কোর্টের স্বাধীন তদন্ত ও শক্তিশালী রাজনৈতিক স্বয়ংক্রিয় উপায়ের প্রয়োজন।

গতিশীলতার দিক থেকে ফ্লোটিলা আন্দোলনগুলো কী বাস্তব পরিবর্তন আনতে পারে? যদি আমরা রাজনীতিবিদ হাবারমাসের কমিউনিকিটিভ অ্যাকশনে (communicative action) ফিরে যাই, তবে দেখা যায় সংলাপ ও যুক্তিভিত্তিক বিস্তার আইডিয়াল হলেও বাস্তবে রাষ্ট্রগুলো ক্ষমতাভিত্তিক সিদ্ধান্ত নেয়। তবু ফ্লোটিলা একটি গণতান্ত্রিক-নাগরিক অসহযোগ আন্দোলন হিসেবে ‘পরিস্থিতি তৈরির’ কাজ করতে পারে—সচেতনতা বৃদ্ধি করা, মিডিয়া ও রাষ্ট্রীয় ন্যারেটিভ চ্যালেঞ্জ করা, কূটনৈতিক চাপ তৈরি করা এবং এই প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক নীতিনির্ধারকদের ওপর সামাজিক-রাজনৈতিক চাপ বাড়ানো সম্ভব।

গাজা ফ্লোটিলা ঘটনা আমাদের জিজ্ঞাসা করে—কোন মূল্য সবার ওপরে? রাষ্ট্রের নিরাপত্তা নাকি মানবতার মৌলিক মর্যাদা? আইনি প্রক্রিয়া কি আন্তর্জাতিক ন্যায়কে কার্যকরভাবে রক্ষা করতে পারে? গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলার মতো আন্দোলনগুলো, যদিও অবিলম্বে সবকিছু বদলে দিতে পারে না, তা বিশ্বজনীন নৈতিক প্রশ্ন উত্থাপনে সক্ষম এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতির বাইরে থাকা লোক-দুর্দশার অভিজ্ঞতাগুলো শুধু ভেসে না গিয়ে নীরব মানবতাবাদকে পুনরুজ্জীবিত করে। তবে কোনো আন্দোলনই যখন বেসরকারি শক্তির মাধ্যমে রাজনৈতিক অর্জনে লিপ্ত হয় না, তখনই সেটি আদর্শগতভাবে শক্তিশালী থাকবে—একই সঙ্গে প্র্যাকটিক্যালি সরকারি-নৈতিক-আইনি ফ্রেমও বিবেচনায় রাখতে হবে।

আখেরে বলা যায়, ফ্লোটিলা আন্দোলন শুধু গাজার নয়, এটি এক নৈতিক পুনর্জাগরণ। এটি সেই প্রশ্ন উত্থাপন করে : ‘মানবতা কি রাষ্ট্রের নিচে নত হবে, না রাষ্ট্রকে মানবতার কাছে দায়বদ্ধ হতে হবে?’ এই প্রশ্নের উত্তরই আসলে আগামী শতকের মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। গ্রেটা থুনবার্গের প্রতি ইসরাইলের হেনস্তা প্রমাণ করে দিয়েছে, এই রাষ্ট্র মানবিক যুক্তির সীমা ছাড়িয়ে গেছে এবং ‘নিরাপত্তা’ শব্দটি ব্যবহার করছে এক নব্য-নাৎসি রাজনৈতিক মতাদর্শের আবরণ হিসেবে। এই বাস্তবতায়, গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা শুধুই এক মানবিক কনভয় নয়, বরং এক দার্শনিক ও নৈতিক চ্যালেঞ্জ, যা রাষ্ট্রের সীমারেখা ভেঙে বলছে : মানুষই সর্বোচ্চ মূল্য এবং মানবিকতাই সর্বশেষ প্রতিরোধ।

লেখক : সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, লেখক ও গবেষক, ফ্রাই ইউনিভার্সিটি বার্লিন, জার্মানি

সূত্র, প্রথম আলো