জাতি ও জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতার ইতিহাসে অত্যন্ত জটিল কিন্তু মৌলিক ধারণা, যা আধুনিক রাজনৈতিক এবং সামাজিক জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘জাতি’ শব্দটি লাতিন Natio থেকে এসেছে, যার আক্ষরিক অর্থ জন্ম বা বংশ। প্রথমদিকে এই শব্দটি মূলত একই বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীকে বোঝাতে ব্যবহৃত হলেও সময়ের সঙ্গে এর কনোটেশন ও এস্তেমাল গভীর সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক মাত্রা অর্জন করেছে। আজকে জাতি বলতে বোঝায় কোনো জনগোষ্ঠী, যারা অভিন্ন ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, অর্থনৈতিক জীবন, ভূখণ্ড এবং রাজনৈতিক চেতনার ভিত্তিতে নিজেদের আলাদা সত্তা হিসেবে দেখতে চায়।

সমাজবিজ্ঞানীরা একমত যে, জাতি জন্মসূত্রে শুধু রক্তের বন্ধনে আবদ্ধ গোষ্ঠী নয়; বরং এটি দীর্ঘ ঐতিহাসিক প্রক্রিয়ার ফসল, যেখানে একটি জনগোষ্ঠী নিজেদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য রক্ষার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। অধ্যাপক হায়েস জাতিকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে বলেছেন, একটি জনগোষ্ঠী যখন স্বাধীনতা অর্জন করে এবং নিজেদের ভাগ্য নিজেদের হাতে তুলে নেয়, তখনই তারা জাতিতে পরিণত হয়। ম্যাকাইভার মনে করেন, জাতি হলো আধ্যাত্মিক চেতনায় সমর্থিত এমন এক সমাজ, যারা নিজেদের রাজনৈতিক সংবিধান প্রণয়ন করতে চায়।

ব্রাইসের মতে, জাতি হলো রাষ্ট্রনৈতিকভাবে সংগঠিত এমন এক জনগোষ্ঠী, যারা বহিঃশাসন থেকে মুক্ত অথবা মুক্তিকামী। জোসেফ স্টালিন জাতিকে আরো স্পষ্ট কাঠামোগত আকারে সংজ্ঞায়িত করে বলেছেন, জাতি হলো ঐতিহাসিকভাবে গঠিত স্থায়ী জনসমাজ, যাদের অভিন্ন ভাষা, ভূখণ্ড, অর্থনৈতিক জীবন এবং মানসিক গঠন রয়েছে, যা সাধারণ সংস্কৃতির মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। স্টালিনের সংজ্ঞায় জাতিকে একটি প্রায় অপরিবর্তনীয় একক হিসেবে কল্পনা করা হলেও আধুনিক সমালোচকরা মনে করেন, জাতি আসলে সবসময় পরিবর্তনশীল এবং সামাজিক নির্মাণ (social construct)। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়, জাতি কখনোই নিছক রক্তের বন্ধনে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি অভিন্ন অভিজ্ঞতা, পারস্পরিক স্মৃতি, রাজনৈতিক লক্ষ্য এবং সংস্কৃতির ধারাবাহিকতার ওপর নির্ভরশীল।

জাতীয়তা হলো জাতির পূর্বশর্ত ও ভিত্তি। জাতীয়তা মূলত এক ধরনের মানসিক ও আত্মিক অনুভূতি, যা একটি জনগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করে তোলে। এই ঐক্য হতে পারে ভাষার ভিত্তিতে, হতে পারে ধর্ম বা সংস্কৃতির ভিত্তিতে, আবার কখনো তা রাজনৈতিক আদর্শ বা ভূখণ্ডকেন্দ্রিক আবেগ থেকেও জন্ম নিতে পারে। জাতীয়তাকে তাই কোনো একক উপাদানের মাধ্যমে সংজ্ঞায়িত করা যায় না। অনেক সময় একটি মাত্র উপাদানও জাতীয়তার জন্য যথেষ্ট হয়ে দাঁড়ায়, যেমন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অভিন্ন রাজনৈতিক আদর্শ মানুষকে একত্র করেছে, যদিও তারা বিভিন্ন জাতি ও সংস্কৃতি থেকে এসেছে। আবার ভারতের জাতীয়তা মূলত বহুবিধ ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতির মিলন থেকে গড়ে উঠেছে।

জন স্টুয়ার্ট মিলের মতে, জাতীয়তাবাদ তখনই জন্ম নেয়, যখন জনগোষ্ঠী পারস্পরিক সহানুভূতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে অভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃত্ব মেনে নিতে রাজি হয়। আর্নল্ড টয়েনবি জাতীয়তাকে আত্মিক ও মানসিক অনুভূতি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। লাস্কি মনে করেন, জাতীয়তা প্রাচীন স্মৃতি ও পারস্পরিক সহাবস্থানের মাধ্যমে গড়ে ওঠা এক মানসিকতা। ডুর্খেইম জাতীয়তাকে রাষ্ট্রীয় আইন ও একক রাজনৈতিক কাঠামোর অধীনে মানুষের বসবাসের চেতনা হিসেবে দেখেছেন। এই সংজ্ঞাগুলোর বিশ্লেষণ থেকে বোঝা যায়, জাতীয়তা আসলে এমন এক প্রক্রিয়া, যা মানুষকে অভিন্ন স্মৃতি, অভিন্ন সংস্কৃতি ও অভিন্ন রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ করে, যদিও তারা এখনো স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে না-ও পারে।

জাতি ও জাতীয়তার পার্থক্য এখানে স্পষ্ট। জাতি হলো একটি বাস্তব রাজনৈতিক সত্তা, যেখানে সার্বভৌমত্ব, সংগঠন এবং স্বাধীন রাষ্ট্রকাঠামো থাকে। জাতীয়তা হলো মানসিক ও আত্মিক ঐক্য, যা এখনো রাষ্ট্রে রূপ নেয়নি। জাতি অধিকতর স্থায়ী ও সুসংহত, জাতীয়তা তুলনামূলকভাবে ক্ষণস্থায়ী এবং শিথিল। লর্ড ব্রাইস যথার্থই বলেছেন, জাতীয়তা হলো জাতি গঠনের প্রক্রিয়া। যখন জাতীয়তা রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করে, তখনই তা জাতিতে রূপান্তরিত হয়। তবে আধুনিক সমালোচকরা মনে করেন, বাস্তবে এই পার্থক্য সবসময় সরল নয়। যেমন : ফিলিস্তিনি জনগোষ্ঠীর জাতীয়তা আছে, কিন্তু তারা এখনো স্বাধীন জাতি নয়। আবার সুইজারল্যান্ডে বহুভাষিক ও বহুসাংস্কৃতিক জনগোষ্ঠী মিলিত হয়ে এক জাতি গঠন করেছে। ফলে বলা যায়, জাতি ও জাতীয়তার সম্পর্ক সবসময় প্রেক্ষাপটনির্ভর ও পরিবর্তনশীল।

জাতীয়তা থেকে জন্ম নেয় জাতীয়তাবাদ, যা আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থার ভিত্তি। জাতীয়তাবাদ হলো এমন এক রাজনৈতিক মতাদর্শ, যা জনগোষ্ঠীকে তাদের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও স্বাতন্ত্র্য অর্জনে অনুপ্রাণিত করে। এটি একই সঙ্গে আবেগ, চেতনা এবং রাজনৈতিক বাস্তবতা। জাতীয়তাবাদের দুটি বৈশিষ্ট্য সুস্পষ্টÑঅভ্যন্তরীণ ঐক্যবোধ এবং বহির্বিশ্ব থেকে স্বাতন্ত্র্যবোধ। হ্যান্স কোহন জাতীয়তাবাদকে মানসিক অবস্থা বলেছেন। টয়েনবি একে আত্মিক অনুভূতি হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন। পাডেলফোর্ড ও লিংকন একে শুধু চেতনা নয়, বরং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে সেই চেতনার রূপায়ণ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। জাতীয়তাবাদ একদিকে জনগণকে স্বাধীনতা-সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছে, যেমন ভারত, বাংলাদেশ বা আফ্রিকার দেশগুলোয় দেখা যায়। অন্যদিকে উগ্র জাতীয়তাবাদ ভয়াবহ যুদ্ধ ও ধ্বংসের কারণ হয়েছে, যেমন হিটলারের নাৎসিবাদ বা মুসোলিনীর ফ্যাসিবাদ। ফলে জাতীয়তাবাদকে সবসময় দ্বিমুখী শক্তি হিসেবে দেখা হয়Ñএটি যেমন মুক্তির হাতিয়ার, তেমনি ধ্বংসের অস্ত্রও।

জাতীয়তাবাদের উৎপত্তি ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে বিভিন্ন রূপে দেখা দিয়েছে। প্রাচীন গ্রিক নগররাষ্ট্রে স্থানীয় নাগরিকরা নিজেদের সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক কাঠামোকে শ্রেষ্ঠ মনে করত। হিব্রুরা ধর্মীয় জাতিসত্তার ভিত্তিতে নিজেদের আলাদা করেছিল। তবে রোমান সাম্রাজ্যের উত্থান ও খ্রিষ্টধর্মের সার্বজনীন আদর্শ স্থানীয় জাতীয় চেতনার বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। মধ্যযুগে গির্জার প্রভাব এত প্রবল ছিল যে, জাতীয় চেতনা বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায়নি। তবে ধীরে ধীরে রাজতন্ত্র শক্তিশালী হয় এবং জাতীয় রাষ্ট্রের ভিত্তি গড়ে ওঠে। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স শতবর্ষ যুদ্ধের মাধ্যমে নিজেদের জাতীয় সত্তা নির্মাণ করে।

রেনেসাঁ জাতীয়তাবাদের বিকাশে নতুন মাত্রা যোগ করে। মানুষের মধ্যে নতুনভাবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য, সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীন চিন্তার-চেতনা জন্ম নেয়। ম্যাকিয়াভেলি জনগণকে জাতীয় ঐক্যের আহ্বান জানালেও তাৎক্ষণিকভাবে সফল হননি। তবে তার রাজনৈতিক বাস্তববাদ আধুনিক রাষ্ট্রতত্ত্বে গভীর প্রভাব ফেলেছিল। সংস্কার আন্দোলনও জাতীয়তাবাদকে শক্তিশালী করে। মার্টিন লুথারের নেতৃত্বে প্রোটেস্ট্যান্ট সংস্কার আন্দোলন জাতীয় চার্চের ধারণা প্রতিষ্ঠা করে, যা গির্জার সার্বজনীন কর্তৃত্বকে ভেঙে দেয় এবং জাতীয় রাষ্ট্রের ভিত্তি দৃঢ় করে। অষ্টাদশ শতাব্দীর বিপ্লবী যুগ জাতীয়তাবাদের প্রকৃত উত্থান ঘটায়। ফরাসি বিপ্লব ঘোষণা করে যে, জাতিই সব ক্ষমতার উৎস। জনগণের অধিকার, স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন তখন জাতীয়তাবাদের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে আসে। এই ধারণা শুধু ফ্রান্সেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, সমগ্র ইউরোপ ও আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে। ঊনবিংশ শতাব্দী জাতীয় ঐক্যের যুগ। ইতালিতে ম্যাৎসিনি, গ্যারিবল্ডি ও ক্যাভুর জাতীয় ঐক্যের আন্দোলন চালান এবং অবশেষে ইতালি ঐক্যবদ্ধ হয়। জার্মানিতে ফিখতে সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ প্রচার করেন, যা পরে রাজনৈতিক ঐক্যে রূপ নেয়। এভাবে ইউরোপের বিভিন্ন স্থানে জাতীয়তাবাদ শক্তিশালী আন্দোলনের জন্ম দেয়।

বিংশ শতাব্দীতে জাতীয়তাবাদের পরিধি আরো বিস্তৃত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উইলসনের ঘোষণায় জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া ও আফ্রিকায় ঔপনিবেশিক মুক্তি আন্দোলন মাথাচাড়া দেয়। ভারত, পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া ও আফ্রিকার বহু দেশ জাতীয়তাবাদের প্রেরণায় স্বাধীনতা অর্জন করে। বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে প্রায় একশোরও বেশি নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়, যা জাতীয়তাবাদের শক্তিকে স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত করে।

সমকালীন বিশ্বে জাতীয়তাবাদ একদিকে মুক্তির সংগ্রামে অনুপ্রেরণা জোগাচ্ছে, অন্যদিকে উগ্র জাতীয়তাবাদ যুদ্ধ ও সংঘাতের জন্ম দিচ্ছে। ফিলিস্তিনি ও কুর্দিদের সংগ্রামে জাতীয়তাবাদ মুক্তির আকাঙ্ক্ষা হয়ে ওঠে, আবার অনেক জায়গায় জাতীয়তাবাদ ধর্মীয় মৌলবাদ বা উগ্র সন্ত্রাসবাদে রূপ নেয়। বিশ্বায়ন, অভিবাসন ও বহুজাতিক সংস্কৃতির যুগে জাতীয়তাবাদ নতুনভাবে রূপ নিচ্ছে। কেউ একে পরিচয় রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন, আবার কেউ একে বিশ্বশান্তির প্রতিবন্ধক বলছেন। তাই জাতীয়তাবাদকে শুধু ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া হিসেবে নয়, বরং সমসাময়িক বৈশ্বিক রাজনীতির আলোকে মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।

জাতি, জাতীয়তা ও জাতীয়তাবাদ নিয়ে আলোচনা করতে গেলে শুধু সংজ্ঞা বা ঐতিহাসিক বিবর্তনই যথেষ্ট নয়, বরং সমালোচনামূলক দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ করা জরুরি। জাতীয়তাবাদ একদিকে মুক্তির আন্দোলনের অনুপ্রেরণা দিয়েছে, অন্যদিকে তা অনেক সময় দমন ও সহিংসতার অস্ত্রও হয়েছে। তাই সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ ছাড়া এর প্রকৃত তাৎপর্য বোঝা মুশকিল। যাই হোক, জাতীয়তাবাদ আসলে কতটা প্রাকৃতিক আর কতটা সামাজিক নির্মাণ, সেটি নিয়ে দীর্ঘ বিতর্ক রয়েছে। প্রিমর্ডিয়ালিস্ট তত্ত্ব অনুযায়ী, জাতি মানুষের জন্মগত এক বাস্তবতা; অর্থাৎ ভাষা, রক্ত, সংস্কৃতি, ধর্মÑএসব মিলেই জাতি স্বয়ংক্রিয়ভাবে তৈরি হয়। কিন্তু আধুনিক তাত্ত্বিকরা, যেমন আর্নেস্ট গেলনার, মনে করেন জাতি আসলে শিল্পবিপ্লব ও আধুনিক রাষ্ট্রের চাহিদা অনুযায়ী তৈরি এক সামাজিক নির্মাণ। বেনেডিক্ট অ্যান্ডারসনের ধারণা আরো ভিন্নÑতিনি জাতিকে বলেছেন ‘ইম্যাজেন্ড কমিউনিটি’ (Imagined Community), অর্থাৎ এমন এক কল্পিত সম্প্রদায়, যেখানে মানুষ পরস্পরকে কখনো না-ও চিনতে পারে, কিন্তু মানসিকভাবে নিজেদের এক সম্প্রদায়ের সদস্য বলে মনে করে। এই সমালোচনামূলক ব্যাখ্যা আমাদের বুঝতে সাহায্য করে, জাতীয়তাবাদ শুধু প্রাকৃতিক নয়, বরং ক্ষমতার কাঠামো ও সামাজিক প্রক্রিয়ার ফসল।

আদতে, জাতীয়তাবাদের দ্বিমুখী চরিত্র নিয়ে সমালোচনা প্রয়োজন। একদিকে জাতীয়তাবাদ ঔপনিবেশিক মুক্তি আন্দোলনের শক্তি দিয়েছে। বাংলাদেশে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ জাতীয়তাবাদের ইতিবাচক রূপ দেখিয়েছেÑযেখানে সাধারণ মানুষ নিজেদের সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অধিকার রক্ষার জন্য লড়াই করেছে। কিন্তু একই জাতীয়তাবাদ আবার উগ্র রূপ নিয়ে সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করতে পারে। যেমন : ইউরোপে নাৎসি জাতীয়তাবাদ ভয়াবহ গণহত্যার জন্ম দেয়। তাই সমালোচনামূলক প্রশ্ন হচ্ছেÑজাতীয়তাবাদ সবসময় মুক্তির হাতিয়ার হতে পারে কি না, নাকি তা একই সঙ্গে নিপীড়নের কাঠামোও তৈরি করে।

তাছাড়া, জাতীয়তাবাদ ও বিশ্বায়নের সংঘাত নিয়েও চিন্তা করা জরুরি। বিশ্বায়ন মানুষকে আন্তর্জাতিকভাবে সংযুক্ত করছে এবং প্রযুক্তি, অর্থনীতি ও সংস্কৃতির সীমানা ভাঙছে। কিন্তু জাতীয়তাবাদ আবার স্থানীয় পরিচয় রক্ষার দাবি তোলে। এতে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়Ñমানুষ কি আগে বৈশ্বিক নাগরিক, নাকি জাতীয় নাগরিক? উদাহরণস্বরূপ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন চেষ্টা করেছে বহুজাতিক ইউরোপীয় পরিচয় গড়তে, কিন্তু ব্রেক্সিট আন্দোলন দেখিয়েছে যে জাতীয়তাবাদ এখনো প্রবল তাকাতদার। তাই প্রশ্ন হচ্ছেÑজাতীয়তাবাদ কি বিশ্বায়নের সঙ্গে সহাবস্থান করতে পারে, নাকি এটি হর হামেশা প্রতিরোধের জায়গায় দাঁড়াবে? আদতে, জাতীয়তাবাদের ভেতরে ক্ষমতার রাজনীতি লুকিয়ে থাকে। জাতীয়তাবাদের নামে অনেক সময় শাসকগোষ্ঠী নিজেদের আধিপত্য কায়েম করে, ভিন্নমত দমন করে এবং সংখ্যালঘুদের কণ্ঠস্বর চেপে দেয়। এই জায়গায় মিশেল ফুকোর ক্ষমতা ও জ্ঞানতত্ত্ব প্রযোজ্যÑজাতীয়তাবাদী বয়ান শুধু ঐক্যের গল্প নয়, বরং এটি ক্ষমতার বয়ানও বটে। ঠাহর করতে হবে, জাতীয়তাবাদ কাদের জন্য মুক্তি আনে আর কাদের জন্য নিপীড়ন তৈরি করে। আখেরে বলা যায়, জাতীয়তাবাদ এক জটিল ধারণা, যার ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় দিক আছে। চিন্তাভাবনা ছাড়া একে শুধু মুক্তির টেপিস্ট্রি হিসেবে দেখলে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। জাতীয়তাবাদকে এমনভাবে গড়ে তোলা জরুরি, যাতে তা বহুত্ববাদী, অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং মানবিক হয়। জাতি বা রাষ্ট্রের পরিচয় যেন শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের জন্য নয়, বরং সব মানুষের জন্য সমান মর্যাদা নিশ্চিত করে।

লেখক : সাবেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, লেখক ও গবেষক, ফ্রাই ইউনিভার্সিটি বার্লিন, জার্মানি

সূত্র, আমার দেশ