আমাদের দেশে অলিম্পিক বলতে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকই বোঝায়। শীতকালীন অলিম্পিক এদেশে অতটা পরিচিত নয়। গ্রীষ্মকালীন ও শীতকালীন অলিম্পিক মিলিয়ে পদকপ্রাপ্তির রেকর্ডের ভিত্তিতে সেরা ১০টি দেশের তালিকায় থাকা প্রতিটি দেশই উন্নত বিশ্বের। এর মধ্যে রয়েছে এশিয়ার দেশ মাত্র দুটি—চীন আর জাপান। রপ্তানি আয়ের দিক থেকে বলুন, জিডিপিতে বলুন, শিক্ষার মান ও গবেষণা সূচকে বলুন—সব দিক থেকেই শীর্ষ দেশের তালিকায় এ দুটি দেশের নাম পাওয়া যায়।

আমাদের প্রতিবেশীদের মধ্যে অলিম্পিকে এ পর্যন্ত ভারত ১০টি স্বর্ণসহ মোট ৪১টি পদক, পাকিস্তান চারটি স্বর্ণসহ মোট ১১টি পদক এবং শ্রীলঙ্কা মোট দুটি পদক জিতেছে। বাংলাদেশ ১৯৮৪ সাল থেকে অলিম্পিকে অংশ নিয়ে এলেও ৪০ বছরে এখন পর্যন্ত কোনো পদক জিততে পারেনি।

বাংলাদেশের মানুষ অন্যান্য জাতির তুলনায় খেলাধুলা নিয়ে বেশি মাতামাতি করলেও খেলাধুলায় তার সাফল্য প্রায় নেই বললেই চলে। এর কারণ হলো আমরা বিনা পরিকল্পনায় সাফল্য চাই। সাফল্যের জন্য যে পরিকল্পনা ও সাধনা দরকার, তার ধারেকাছেও আমরা নেই। যে জাতি খেলাধুলায় সফল, তারা শিল্প-বাণিজ্য-শিক্ষাদীক্ষায়ও সফল। কাজেই জাতি হিসেবে বিশ্বের বুকে গৌরবের আসন পেতে হলে শিল্প, বাণিজ্য ও শিক্ষার পাশাপাশি খেলাধুলার দিকেও আমাদের মনোযোগ দিতে হবে। এজন্য একটি অনুসরণযোগ্য মডেল দেশ খুঁজে বের করতে হবে, যে দেশকে অনুসরণ করে সামনে এগিয়ে যাওয়া যায়।

খেলাধুলায় সফল এশিয়ার কোনো একটি দেশই হতে পারে আমাদের মডেল। চীন অনেক বড় দেশ। জনসংখ্যা অনেক বেশি।

আমরা কোনোভাবেই চীনের সঙ্গে তুলনীয় নই। অন্যদিকে জাপানের জনসংখ্যা প্রায় ১২-১৩ কোটির মতো। আয়তনে জাপান বাংলাদেশের চেয়ে বড়, তবে বসবাস ও আবাদযোগ্য ভূমির পরিমাণ অনুযায়ী জাপান ও বাংলাদেশের আয়তন প্রায় কাছাকাছি। বাংলাদেশিদের মতোই ভাত-মাছ জাপানিদের প্রধান খাদ্য। সে হিসেবে খেলাধুলায় উন্নত দেশগুলোর তালিকায় থাকা জাপান নৃতাত্ত্বিক ও ভৌগোলিক বিচারে আমাদের জন্য মডেল দেশ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। জাপানে মানুষের গড় আয়ু ৮৫ বছর, আর বাংলাদেশে মানুষের গড় আয়ু ৭৫ বছর। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী অপেক্ষাকৃত তরুণ। যে বয়সে মানুষ খেলাধুলায় ভালো করে, সেই বয়সি মানুষের সংখ্যা বেশি। কাজেই জাপান অলিম্পিকে ৫৭৬টি পদক জিততে পারলে আমরা একটা পদকও কেন জিততে পারছি না, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন।

খেলাধুলায় জাপানের সাফল্যের পেছনে রয়েছে বহুস্তরবিশিষ্ট দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, উন্নত ক্রীড়া অবকাঠামো ও সংস্কৃতি। জাপানে ক্রীড়াশিক্ষা ছোটবেলা থেকেই শুরু হয়। সেখানে কারিকুলামের অংশ হিসেবে স্কুল ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে অত্যন্ত সুশৃঙ্খল কাঠামোগত ক্রীড়াশিক্ষার প্রচলন আছে। ঐতিহ্যগত ক্রীড়া, যেমন জুডো, ক্যারাতে ও সুমো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গুরুত্ব পেয়েছে, যা অলিম্পিকে স্থান করে নিয়েছে।

তাদের আছে উন্নত ও সুশৃঙ্খল ক্রীড়া অবকাঠামো; আছে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন স্টেডিয়াম, ট্রেনিং সেন্টার, সিমুলেশন ল্যাব আর ক্রীড়া গবেষণা প্রতিষ্ঠান। ২০০০ সালের পর থেকে জাপান অলিম্পিক কমিটি একটি প্রকল্প চালু করেছে, যাতে আট থেকে ১২ বছর আগে থেকেই প্রতিযোগীদের বাছাই ও প্রস্তুতি শুরু হয়। ২০২০ সালের টোকিও অলিম্পিকের আগে টার্গেটকৃত ক্রীড়াগুলোয় বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়। স্পোর্টস সায়েন্স, বায়োমেকানিকস, ভিডিও অ্যানালিটিকস, এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক পারফরম্যান্স অ্যানালাইসিস—সবই অ্যাথলেটদের উন্নয়নে ব্যবহৃত হয়।

জাপানে জাতীয় পর্যায়ে এবং আন্তঃস্কুল ও আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় ক্রীড়া প্রতিযোগিতাগুলোয় শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়। অ্যাথলেটরা নিয়মিত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে, যেমন এশিয়ান গেমস, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ প্রভৃতি। এসব প্রতিযোগিতা তাদের অলিম্পিকের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত করে। প্রতিটি স্কুলে রয়েছে বাধ্যতামূলক খেলাধুলাচর্চার সুবিধা, যাতে শিশু বয়সেই সম্ভাবনাময় খেলোয়াড়দের বাছাই করে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সরকারের বাজেট বরাদ্দ ছাড়াও বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রীড়াবিদদের স্কলারশিপ, পৃষ্ঠপোষকতা ও চাকরির সুযোগ দেয়। ফলে ২০২০ সালের টোকিও অলিম্পিকেই জাপান বড় সাফল্য পেয়েছে। দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ২৭টি স্বর্ণপদকসহ মোট ৫৮টি পদক জিতে রেকর্ড তৈরি করেছে। ২০২৪ সালেও ২০টি স্বর্ণপদকসহ মোট ৪৫টি পদক জিতেছে।

সব মিলিয়ে জাপান নিঃসন্দেহে এক আধুনিক ক্রীড়াশিক্ষা ব্যবস্থার মডেল তৈরি করেছে, যা অন্য অনেক উন্নয়নশীল দেশের জন্যও অনুসরণযোগ্য। এই মডেলের অনেক দিক বাংলাদেশে প্রয়োগ করে সাফল্য পাওয়া সম্ভব। তবে বাস্তব প্রেক্ষাপট ও বিনিয়োগের সামর্থ্য অনুযায়ী ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হবে। প্রথমেই দরকার টার্গেটভিত্তিক বাস্তবায়নযোগ্য রাষ্ট্রীয় ক্রীড়ানীতি প্রণয়ন এবং স্কুলপর্যায়ে ক্রীড়াশিক্ষা বাধ্যতামূলক করা। এরপর স্কুল পর্যায়ে ধাপে ধাপে বিশেষায়িত কোচ নিয়োগ দিয়ে বিজ্ঞানভিত্তিক প্রশিক্ষণ চালু করা।

যেকোনো কাজে সুফল পেতে চাইলে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। খেলাধুলাও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রতিটি স্কুলে শিক্ষার অংশ হিসেবে বাধ্যতামূলক খেলাধুলার নিয়ম চালু করতে হলে স্কুলগুলোয় পর্যায়ক্রমে খেলাধুলার মাঠসহ অবকাঠামো তৈরি করতে হবে। অবকাঠামোগত সুযোগ অনুযায়ী প্রতিটি স্কুলে দু-একটি খেলা বাধ্যতামূলক করা যেতে পারে। যেমন সঠিক মাপের মাঠ থাকলে ফুটবল, হকি, ক্রিকেট; পুকুর থাকলে সাঁতার; ইনডোর-আউটডোর কোর্ট থাকলে ভলিবল, ব্যাডমিন্টন প্রভৃতি। ফুটবল বা ক্রিকেট মাঠ প্রতিটি স্কুলে সম্ভব না হলেও প্রতি ইউনিয়নে যাতে একটি করে হয়, তার চেষ্টা করতে হবে। সরকার গুচ্ছগ্রাম তৈরির জমি বের করতে পারলে খেলার মাঠের জমিও বের করতে না পারার কারণ নেই।

জেলা পর্যায়ে স্কুল ক্রীড়া প্রতিযোগিতা চালু করে মেধাবী খেলোয়াড়দের তৃণমূল থেকে আঞ্চলিক স্তর হয়ে জাতীয় পর্যায়ে পৌঁছার পথ তৈরি করতে হবে। ক্রীড়া শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে স্কুল পর্যায়ে ক্রীড়া কার্যক্রম তদারকি করা যেতে পারে। সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে স্কুলে ক্রীড়া প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম পরিচালনা করা যেতে পারে। অন্তত প্রতিটি বিভাগে একটি করে ক্রীড়া বিদ্যালয় করা যেতে পারে, যেখানে সাধারণ শিক্ষা এবং ক্রীড়াশিক্ষা পাশাপাশি চলবে। এতে অনূর্ধ্ব-১২/১৪/১৭ বছর প্রভৃতি বিভিন্ন পর্যায়ের খেলোয়াড় গড়ে তোলা সম্ভব হবে। বড় করপোরেট সংস্থাগুলো যেন ক্রীড়াবিদদের স্কলারশিপ দেয়, ক্রীড়া প্রশিক্ষণ কর্মকাণ্ডে পৃষ্ঠপোষকতা করে এবং শিক্ষা শেষে চাকরি দেয়, তার ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশকে সব খেলায় না গিয়ে কয়েকটি সম্ভাবনাময় খেলা ফোকাস করতে হবে।

এর ফল হবে সুদূরপ্রসারী। এদেশে অনেক আন্তর্জাতিক মানের অ্যাথলেট তৈরি হবে, যারা অলিম্পিকসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পদক অর্জনের মাধ্যমে দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনবে। সামগ্রিকভাবে শিক্ষার্থীদের উন্নততর মানসিক ও শারীরিক বিকাশ ঘটবে। ক্রীড়া খাতে কর্মযজ্ঞ বাড়লে নতুন কর্মসংস্থানও তৈরি হবে।

লেখক : অধ্যাপক, যন্ত্রকৌশল বিভাগ, বুয়েট

সূত্র, আমার দেশ