ইরানের সঙ্গে যুদ্ধের পর ইসরাইলের মিডিয়ায় কাতারকে নিয়ে একটি উদ্বেগজনক বয়ানের ভিত্তি দাঁড় করানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ইরানের পর ইসরাইলের ‘পরবর্তী শত্রু’ হচ্ছে কাতার। ইসরাইলের বিশেষ কিছু মিডিয়া ও কলামিস্ট কাতারের বিরুদ্ধে এ ধরনের বয়ানকে ক্রমেই শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর জন্য লেখালেখি শুরু করেছে। সম্প্রতি টাইমস অব ইসরাইলে কাতারের বিরুদ্ধে এ ধরনের একটি উসকানিমূলক নিবন্ধ লিখেছেন ইলাজার গাবায়া। তার লেখার শিরোনাম ‘কাতার: ইসরায়েলস নেক্সট এনিমি আফটার ইরান’। তার এই নিবন্ধে কাতারকে বিশেষ করে দেশটির আলোচিত আন্তর্জাতিক মিডিয়া আল জাজিরাকে টার্গেট করা হয়েছে। বলা হচ্ছে, ইরানের পর ইসরাইলের অস্তিত্বের জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে উঠছে কাতার ও আল জাজিরা।

ইসরাইলি কলামিস্টের এই বয়ানের লক্ষ্য হচ্ছে, কাতারের সফ্‌ট পাওয়ার চর্চাকে হেয় এবং আল জাজিরার বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার সুনামকে ক্ষুণ্ণ করা। আঞ্চলিক বিভিন্ন বিরোধ মীমাংসায় মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করে কাতার ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছে এবং আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে নিজের গুরুত্ব তুলে ধরেছে। দেশটির এই ভূমিকা পালনে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে আল জাজিরা। এই মিডিয়াটির মুক্ত সাংবাদিকতা চর্চার কারণে গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনসহ এই অঞ্চলের দেশগুলোর অনেক স্পর্শকাতর তথ্যই জনসমক্ষে উঠে এসেছে। ফলে কেবল ইসরাইল নয়, এই অঞ্চলের কিছু মুসলিম দেশও ক্ষুব্ধ কাতার ও আল জাজিরার ওপর।

ইসরাইলের মিডিয়ায় এই অপপ্রচারের সময় ও বিষয়বস্তু বিশেষভাবে লক্ষণীয়। গাজায় সামরিক আগ্রাসন ও গণহত্যা চলাকালে কাতার ও আল জাজিরার বিরুদ্ধে ইসরাইলি মিডিয়ায় এই অপপ্রচার কোনো কাকতালীয় বিষয় নয়। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে হামাস ও ইসরাইলের মধ্যে অস্ত্রবিরতিতে মধ্যস্থতাসহ আঞ্চলিক বিভিন্ন বিরোধে মধ্যস্থতায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে কাতার। ইরানের সঙ্গেও দেশটির সুসম্পর্ক দীর্ঘদিনের। এমনকি দেশটি তার ভূখণ্ডে হামাসের নির্বাসিত রাজনৈতিক নেতাদের বসবাস করারও সুযোগ দিয়েছে।

হামাসের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য কূটনৈতিক চ্যানেল খোলা রাখার স্বার্থে এই বাস্তবতা মেনে নিয়েছে ইসরাইল ও তার প্রধান মিত্র যুক্তরাষ্ট্র। বিশেষ করে গাজায় বন্দি থাকা ইসরাইলি জিম্মিদের মুক্তির জন্য হামাসের সঙ্গে যোগাযোগের স্বার্থেই ইসরাইল কাতারে সংগঠনটির শীর্ষ নেতাদের অবস্থান করা নিয়ে কোনো আপত্তি করেনি।

কিন্তু কাতারের এসব ভূমিকাকেই এখন ইসরাইলের স্বার্থের পরিপন্থি আখ্যা দিয়ে দেশটিকে ইরানের পর ইসরাইলের বড় শত্রু উল্লেখ করে অপপ্রচার চালাচ্ছেন কট্টর ইহুদিবাদী সাংবাদিক ও কলামিস্টরা। কেবল ইলাজার গাবায়া নয়, তার মতো আরো অনেক ইহুদি লেখক, সাংবাদিক ও কলামিস্ট হামাসের সঙ্গে সম্পর্ক রক্ষা এবং যুদ্ধবিরতি আলোচনায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাতারের ভূমিকাকে সন্ত্রাসবাদের প্রতি দেশটির সক্রিয় সমর্থনের প্রমাণ বলে ব্যাখ্যা দিচ্ছেন।

ইসরাইলি ইহুদিদের কাতারকে টার্গেট করার লক্ষ্য অত্যন্ত পরিষ্কার। তারা চাচ্ছে, কাতার যেন তার মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা থেকে সরে যায়। একইসঙ্গে তারা উপসাগরীয় অঞ্চলের ছোট কিন্তু প্রভাবশালী এই দেশটিকে আন্তর্জাতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলতে চাইছে। অথচ ইসরাইল অতীতে তার নিজের প্রয়োজনেই কাতারের দ্বারস্থ হয়েছে বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু এখন কাতারের বিরুদ্ধে অপপ্রচারের কারণ হচ্ছে, দেশটির আন্তর্জাতিকভাবে প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম আল জাজিরা। কাতারের যে সফ্‌ট পাওয়ার ও বৈশ্বিক প্রভাব তার প্রধান হাতিয়ার এই সংবাদমাধ্যমটি। ইসরাইলি মিডিয়া সে কারণেই আল জাজিরাকে টার্গেট করেছে।

বিশেষ করে আল জাজিরার আরবি ভাষায় প্রচারিত চ্যানেল গাজা উপত্যকায় ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরাইলি গণহত্যার যে সচিত্র প্রতিবেদন প্রচার করে আসছে, তা আরব বিশ্ব এবং এর বাইরেও বিপুলসংখ্যক দর্শক দেখেন প্রতিনিয়ত। আল জাজিরার এসব প্রতিবেদনে গাজায় মানবিক বিপর্যয় নিয়ে পশ্চিমা মিডিয়ার প্রচারিত বয়ানের সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্র তুলে ধরা হয়, যেটা বিশ্বাস করেন দর্শক-শ্রোতারা। ফলে আল জাজিরার এসব প্রতিবেদন কেবল ইসরাইলকে নয়, বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে পশ্চিমা মিডিয়াকেও।

আর এজন্যই এখন কাতার ও আল জাজিরাকে সন্ত্রাসবাদের সমর্থক আখ্যায়িত করা হচ্ছে। ইসরাইলে আল জাজিরার সম্প্রচার নিষিদ্ধ চ্যানেলটির অফিস বন্ধ করে দিয়েছে নেতানিয়াহুর সরকার। ইসরাইল এখন মধ্যপ্রাচ্য ও এর বাইরের মিত্র দেশগুলোকেও একই পদক্ষেপ গ্রহণে উসকানি দিচ্ছে।

ইসরাইলের এই তৎপরতা মুক্ত গণমাধ্যমের ওপর সরাসরি হামলা হিসেবে বিবেচনা করছেন বিশ্লেষক ও বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, ফিলিস্তিনিদের ওপর পরিচালিত বর্বরতা ও গণহত্যার চিত্র ধারণ ও সম্প্রচারের মতো স্বাধীন সাংবাদিকতাকে ‘সন্ত্রাসী তৎপরতা’ আখ্যা দিয়ে অপপ্রচার চালানো কর্তৃত্ববাদী কৌশলেরই অংশ। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে ভিন্নমত দমন ও তাদের বক্তব্য নিয়ন্ত্রণ করা।

আল জাজিরাকে টার্গেট করার দুটো উদ্দেশ্য আছে—আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাতারের বর্তমান অবস্থানের ক্ষতিসাধন এবং গাজার যুদ্ধে ইসরাইলের নিজের তৈরি বয়ানকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে প্রকৃত ঘটনা তুলে ধরা আল জাজিরা বন্ধ এবং কাতারকে চাপের মধ্যে রাখা। ‘কাতার ইসরাইলের পরবর্তী শত্রু’ এই বয়ান তৈরি করে দেশটির বিরুদ্ধে অপপ্রচারের মাধ্যমে সেটার ভিত্তি তৈরি করা হচ্ছে। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে কাতারের যে সম্পর্ক আছে, তাতেও ফাটল ধরানোর সূক্ষ্ম একটা উদ্দেশ্য আছে ইসরাইলের।

মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের যেসব সামরিক ঘাঁটি আছে, তার মধ্যে কাতারের আল উদেইদ ঘাঁটি সবচেয়ে বড়। ন্যাটোর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র ও মার্কিন সমরাস্ত্রের অন্যতম বড় ক্রেতা কাতার। অন্যদিকে হামাস ও মুসলিম ব্রাদারহুডের মতো ইসলামি সংগঠনের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার কারণে সমালোচনার মুখেও পড়তে হয়েছে কাতারকে। তবে এসব সংগঠনের সঙ্গে কাতারের সম্পর্কের মূল কারণ বাস্তবভিত্তিক আঞ্চলিক কূটনীতি এবং পশ্চিমাদের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে হামাসসহ বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে মধ্যস্থতা করা।

ইরানের সঙ্গেও অনেক আগে থেকেই সুসম্পর্ক আছে কাতারের। এটিও কাতারকে ইসরাইলের ‘শত্রু’ হিসেবে গণ্য করার একটি কারণ। আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টার পাশাপাশি ইসরাইলকে পর্যদুস্ত এবং এই অঞ্চলের মার্কিন ঘাটিগুলোকে তটস্থ করে রাখতে হামাস, লেবাননের হিজবুল্লাহ ও ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের সামরিক-অর্থনৈতিক সহযোগিতা দিয়ে আসছে ইরান। কিন্তু এসবের সঙ্গে কাতারের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। ইসরাইলের বিরুদ্ধেও কাতারের সক্রিয় কোনো ভূমিকা নেই। বরং যুক্তরাষ্ট্রের অংশীদার হিসেবে সব সময় ইতিবাচক ভূমিকাই পালন করে কাতার। কিন্তু ইরানের সঙ্গে কাতারের সুসম্পর্ককে ভালো চোখে দেখছে না ইসরাইল। দেশটির বিরুদ্ধে এই অপপ্রচারের এটিও অন্যতম কারণ।

তবে কাতারের বিরুদ্ধে ইসরাইলের এই অপপ্রচারের ফল যে নেতিবাচক হবে, তা বলাই বাহুল্য। প্রথমত, এর ফলে কাতার বর্তমানে মধ্যস্থতাকারীর যে ভূমিকা পালন করছে, তা ব্যাহত হতে পারে। কারণ হামাসের শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ রাখে এমন অল্প কয়েকটি পক্ষের একটি কাতার। কিন্তু এই চ্যানেলটিকে ধ্বংস করার চেষ্টা ভবিষ্যতে ইসরাইলের জিম্মিমুক্তি, অস্ত্রবিরতি ও উত্তেজনা প্রশমনের পদক্ষেপ নেওয়াকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। বিশেষ করে ইসরাইল-হামাস সংঘাতকে দীর্ঘমেয়াদি করবে।

দ্বিতীয়ত, আল জাজিরার বিরুদ্ধে ‘সন্ত্রাসবাদের’ তকমা দেওয়ার ইসরাইলি অপচেষ্টা বিশ্বব্যাপী মুক্ত গণমধ্যম ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে দমন করার একটি বিপজ্জনক উদাহরণ হয়ে থাকবে। এটা ইসরাইলের মতো বিশ্বের অন্যান্য কর্তৃত্ববাদী সরকারগুলোকেও সমালোচনাকারী সংবাদমাধ্যমের কণ্ঠরোধের অপচেষ্টাকে উৎসাহিত করবে।

তৃতীয়ত, কাতারের বিরুদ্ধে ইসরাইলের এই অপপ্রচার উপসাগরীয় সহযোগিতা পরিষদের (জিসিসি) মধ্যে বর্তমানে যে ভারসাম্য রয়েছে, সেটাকে বিনষ্ট করবে। কাতার তখন বাধ্য হয়ে বিকল্প জোট গড়ার জন্য পথ খুঁজবে, যা প্রকারান্তরে পশ্চিমা বিশ্ব ও ইসরাইলের বৃহত্তর স্বার্থের বিরুদ্ধেই যাবে। কারণ তখন আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট হবে। এতে করে মধ্যপ্রাচ্যে সংঘাতের রাজনৈতিক সমাধানের পথ জটিল হয়ে পড়বে।

ইসরাইল তার নিরাপত্তা নিয়ে যে চ্যালেঞ্জের মুখে আছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই। কিন্তু কাতারকে ইরানের পর পরবর্তী শত্রু বানিয়ে দেশটির বিরুদ্ধে চালানো অপপ্রচার ইসরাইলকেই আত্ম-পরাজয়ের দিকে নিয়ে যাওয়ার পথ তৈরি করবে।

লেখক : শিক্ষাবিদ ও গবেষক, শান ডং বিশ্ববিদ্যালয়, চীন

মডার্ন ডিপ্লোমেসি থেকে অনুবাদ : মোতালেব জামালী

বিষয়: ইসরাইল ,ইরান, ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ

সূত্র, আমার দেশ