দুজনই ভারতে নির্বাসিত। তবে এদের একজন শান্তির বার্তাবাহক হিসেবে পরিচিত। অন্যজন প্রতিহিংসার ‘বাণী’ বিস্তারক হিসেবে কুখ্যাত। তাদের একজন হলেন তিব্বতের ধর্মগুরু—যিনি ‘দালাই লামা’ উপাধিসংবলিত বৌদ্ধ গুরু হিসেবে পরিচিত। অন্যজন বাংলাদেশের পদত্যাগী ও পলাতক প্রধানমন্ত্রী ফ্যাসিবাদের জননী শেখ হাসিনা। দালাই লামা ১৯৫৯ সাল থেকে ভারতে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। আর শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট থেকে ভারতে স্বেচ্ছায় আশ্রয় নিয়ে আছেন। দুজনই পরদেশে আশ্রিত। তবে দুজনের কর্মকাণ্ডে বিস্তর ফারাক।

ভারতে অবস্থানরত বর্তমান ‘দালাই লামা’ হলেন তিব্বতি বৌদ্ধ গুরুর পাশাপাশি তিব্বতের নির্বাসিত সরকারের প্রধান হওয়ার দাবিদার। তার প্রকৃত নাম তেনজিন গিয়াৎসো। তিনি তিব্বতিদের চতুর্দশ দালাই লামা। এটি একটি ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক পদ, যা তিব্বতের ঐতিহ্যবাহী আধ্যাত্মিক নেতা ও শাসকদের প্রতিনিধিত্ব করে। বর্তমান দালাই লামার প্রকৃত নাম তেনজিন গিয়াৎসো। তিনি ১৯৪০ সালে চতুর্দশ দালাই লামা হিসেবে অভিষিক্ত হন। ১৯৫৯ সালে তিব্বতে চীনা অভিযানের পর তিনি ভারতে পালিয়ে যান এবং সেখানে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন।

দালাই লামা বিশ্বজুড়ে বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও শান্তির বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য পরিচিত। চীন সরকার দালাই লামার এই ভূমিকাকে ভালোভাবে নেয় না এবং তাদের মধ্যে এ নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে। চীন সরকার মনে করে, ‘দালাই লামা’ নির্বাচনের অধিকার চীনের রয়েছে, যা বর্তমান দালাই লামা তেনজিন গিয়াৎসো অস্বীকার করেছেন। এ ক্ষেত্রে অন্য কারো হস্তক্ষেপ তিনি বরদাস্ত করবেন না। তিব্বতে চীনা অভিযানের মুখে ভারতে পালিয়েছিলেন তিনি। চীনা সৈন্যরা তার খোঁজে পার্বত্য এলাকাগুলোয় অনুসন্ধান চালাচ্ছিল। লাসায় চীনা সৈন্যদের চোখ এড়িয়ে পাঁচ দিন ধরে পার্বত্য পথ পাড়ি দিয়ে দালাই লামা অবশেষে ভারতে পৌঁছান।

চীন তিব্বতে সেনা পাঠায় ১৯৫০ সালে। তিব্বতীয়রা অনিচ্ছা সত্ত্বেও চীনের কাছে নিজেদের সার্বভৌমত্ব ত্যাগ করে। এর বিনিময়ে দালাই লামার সরকারকে মোটামুটি আগের মতোই তিব্বত পরিচালনা করতে দেওয়া হয়। কিন্তু ১৯৫৯ সালে চীন যখন সেখানে ভূমি সংস্কার শুরু করতে যায়, তখনই সেখানে উত্তেজনা দানা বাঁধতে শুরু করে। মার্চ মাসে পরিস্থিতি হয়ে দাঁড়ায় সংঘাতপূর্ণ। তিন লাখ তিব্বতি দালাই লামার গ্রীষ্মকালীন প্রাসাদ ঘেরাও করে। কয়েক দিনের মধ্যেই শুরু হয়ে যায় অভ্যুত্থান। সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, দালাই লামা ও তার পরিবারকে অবশ্যই দেশ ছেড়ে যেতে হবে। এরপরের দুসপ্তাহ ধরে ছোট একটি দল কখনো ঘোড়ায় চড়ে, কখনো হেঁটে রুক্ষ সমভূমি আর পার্বত্য পথ পাড়ি দেয়। মার্চ মাসের ৩১ তারিখ সারা পৃথিবীতে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে দালাই লামা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ঢুকেছেন। তাকে ভারতে আশ্রয় দেওয়া হয় এবং তারা উত্তর ভারতের ধর্মশালায় তাদের আবাস গড়ে তোলেন। তার সঙ্গে যোগ দেয় প্রায় ৮০ হাজার তিব্বতি। তারাও ওই এলাকাতেই থাকতে শুরু করে। জায়গাটার নাম হয়ে যায় ‘লিটল লাসা’ আর সেটাই হয়ে ওঠে তিব্বতের নির্বাসিত সরকারের কেন্দ্র।

Hasina-Dalailama

অতঃপর সময়ের ব্যবধানে দালাই লামা একান্ত ধর্মীয় কার্যক্রম নিয়ে নিবেদিত হয়ে পড়েন। তিব্বতে তার অধিকার কিংবা তিব্বতের রাজনীতি ও শাসন নিয়ে কোনো হুমকি-হুংকার দিতে শোনা যায়নি। তবে এর নেপথ্যে হয়তো এমন বিষয় আছে যে কারণে তিনি এ নিয়ে উচ্চবাচ্য করতে পারেন না। চীনের মতো বৃহৎ শক্তি, যার সঙ্গে ভারত ১৯৬২ সালের যুদ্ধে পরাজিত হয়ে গলার স্বর নিচু করে ফেলতে বাধ্য হয়। এছাড়া তিব্বতকে চীনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ভারত স্বীকারও করে নিয়েছে। ভারত এ কারণে চীনের বিরুদ্ধে দালাই লামাকে কোনোপ্রকার দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহারের অবকাশও পাবে না।

শেখ হাসিনার অবস্থান

অন্যদিকে শেখ হাসিনার অবস্থান কী? সেই যে গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে শেখ হাসিনা সেখানে আশ্রয় নিয়ে অডিও-ভিডিয়োসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনীতিতে উসকানি ছড়িয়ে চলেছেন। এর প্রতিক্রিয়ায় গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন স্থানে দলের কিছু সমর্থক অরাজকতা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালায়। এটি যে অন্য একটি দেশের ভেতরে বসে একজন মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত আসামির অনধিকার চর্চা, সেটা আশ্রয়দাতা দেশটি ভ্রুক্ষেপ করছে না অথবা ইচ্ছাকৃতভাবে তাকে সুযোগ করে দিচ্ছে।

এটি প্রতিষ্ঠিত সত্য যে, ‘কোটাবিরোধী’ ও ‘বৈষম্যবিরোধী’ আন্দোলন থেকে সরকার পতনের ঘটনাবলির সূত্রপাত হলেও এর প্রেক্ষাপটে ছিল দীর্ঘ দুঃশাসনের কালো ছায়া। গত দেড় দশকে দেশে এমন কিছুর জন্ম দেওয়া হয়, যা ছিল শরীর শিউরে ওঠার মতো। সৃষ্টি করা হয় ‘আয়না ঘর’ নামক গোপন ও চরম নির্যাতনমূলক গোপন গৃহ ও ‘টর্চার সেল’। এছাড়া, গুপ্তহত্যা, ক্রসফায়ার, গায়েবি মামলা প্রভৃতি ছিল স্বৈরশাসকের অস্ত্র। এই দুঃশাসন প্রতিষ্ঠা করে ক্ষমতা ধরে রাখার দায়ে শেখ হাসিনাকে ধাওয়া করেছিল সাধারণ ছাত্র-জনতা। লাখ লাখ জনতা হাসিনার ব্যক্তিগত ‘দুর্গ’ গণভবন পর্যন্ত ঘেরাও করার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিল। দিনটি ছিল ৫ আগস্ট সোমবার সকাল। শেখ হাসিনা তার লাঠিয়ালদের ওপর ভরসা ছেড়ে দেশের গৌরবের প্রতীক সেনাবাহিনীর ওপর ভর করেন। সেই সেনাবাহিনীর এক বার্তায় পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। অতঃপর ঘটতে থাকে একের পর এক রুদ্ধশ্বাস ঘটনা।

হাসিনা রেজিমের অবসানের পর একের পর এক ভয়াবহ বিবরণ উদঘাটিত হতে থাকে। এরই অংশ হিসেবে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ২৫ জুলাই ২০২৫ এক বিবৃতিতে বলে, জুলাই অভ্যুত্থানের সময়গুলোয় বিক্ষোভ দমনে আইনবহির্ভূতভাবে প্রাণঘাতী অস্ত্রের ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশে সহিংসতার তিনটি ভিডিও বিশ্লেষণ করে তারা এর প্রমাণ পাওয়ার কথা জানায়। এছাড়া ৩০ জুলাই শেখ হাসিনার উদ্দেশে এক খোলা চিঠিতে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মহাসচিব অ্যাগনেস ক্যালামার্ড লেখেন, ‘আমরা দেখতে পেয়েছি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিক্ষোভকারী শিক্ষার্থীদের ওপর গুলির বেআইনি ব্যবহার, শিক্ষার্থীরা আবদ্ধ স্থানে থাকা অবস্থায় সেখানে কাঁদানে গ্যাসের বিপজ্জনক ব্যবহার এবং এ কে (কালাশনিকভ) ঘরানার অ্যাসল্ট রাইফেলের মতো প্রাণঘাতী আগ্নেয়াস্ত্রের নির্বিঘ্ন ব্যবহার করেছে।’

এমতাবস্থায় এ কথা মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের কোনো ব্যক্তি বা দলবিশেষ শেখ হাসিনাকে দেশত্যাগে বাধ্য করেনি। নির্যাতিত জনসাধারণ ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাকে ক্ষমতা থেকে সরে যেতে বলেছে। কিন্তু তিনি পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এটি একান্তই তার নিজের দায়।

ভারতের আশ্রয়ে অপতৎপরতা : একটি উদাহরণ

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের পরিপ্রেক্ষিতে ভারতে বসে শেখ হাসিনা গত বছরের অক্টোবরে গোবিন্দগঞ্জের একজন দলীয় কর্মীর সঙ্গে কথোপকথনের একপর্যায়ে হুমকি দেন, ‘ওই লোকদের তালিকা করো আর অফিসারদের বলো আমরা তালিকা পাঠাচ্ছি নেত্রীর কাছে। উনি চাইছেন, ভবিষ্যতে কাজে লাগবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘চাকরি সামনেও করতে হবে, এটি ভুলে যেও না। এক মাঘে শীত যায় না।’

এই কথোপকথনের রেকর্ড পরীক্ষা করে নিশ্চিত হয়ে শেখ হাসিনাকে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১। শেখ হাসিনার পাশাপাশি এ মামলায় গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের আওয়ামী লীগ নেতা শাকিল আকন্দ বুলবুলকেও দুই মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। তদন্তে আরো উঠে আসে, ‘এ টিম’ নামের একটি গ্রুপের (অনলাইনভিত্তিক) মাধ্যমে হোয়াটসঅ্যাপে ও জুমে আওয়ামী লীগের (কার্যক্রম নিষিদ্ধ) গোপন সভা হতো। গত বছরের ২৫ অক্টোবর সে রকম একটি সভায় শেখ হাসিনা উসকানিমূলক বক্তব্য দেন।

শেখ হাসিনা সে দেশে বসে তার দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার জন্য নেতাকর্মীদের নির্দেশ দিচ্ছেন। এমনকি তিনি দিল্লিতে অফিস খুলে বসেছেন বলে খবর প্রকাশ হয়েছে। কলকাতাতেও পলাতক আওয়ামী লীগ নেতারা অফিস খুলে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন। সামাজিক মাধ্যমে শেখ হাসিনার বক্তব্যের জেরে দেশে এরই মধ্যে ঘটে গেছে বেশ কিছু ঘটনা। কিন্তু তিনি বরং হুংকার দিয়ে চলেছেন। রাজনৈতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, শেখ হাসিনা দিল্লিতে বসে দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র করছেন। তার বক্তব্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে উঠছে।

এদিকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় পরোয়ানাভুক্ত আসামি শেখ হাসিনার এ ধরনের কর্মকাণ্ডের জন্য ইতোমধ্যে ভারতের কাছে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশ। এসব বক্তব্য-বিবৃতি থেকে শেখ হাসিনাকে বিরত রাখার জন্য প্রতিবাদপত্র দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ঢাকায় ভারতের হাইকমিশনারকে চারবার তলব করেছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এ ব্যাপারে অসন্তোষ প্রকাশের পাশাপাশি তাকে বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়া থেকে বিরত রাখতে বাংলাদেশ লিখিতভাবে ভারতকে অনুরোধ জানালেও দিল্লিতে বসে শেখ হাসিনা বক্তৃতা-বিবৃতি প্রদান অব্যাহত রাখেন।

বাংলাদেশ এখন অতীতের গ্লানিকর অভিজ্ঞতার স্তূপের ওপর একটি নয়া রাজনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার জন্য অপেক্ষমাণ। এই সঙ্গে প্রতিবেশীসহ সব দেশের সঙ্গে সমতা এবং মর্যাদার ভিত্তিতে পারস্পরিক সম্পর্ক বিনির্মাণ করতে চায়। এরই মধ্যে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও পরিচ্ছন্ন নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রা শুরু করেছে। এমতাবস্থায় ভারতে আশ্রিত শেখ হাসিনা বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে নীরবতাকে অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করবেন। এই সঙ্গে ভারত সরকারও একজন ‘আসামি’ হিসেবে শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশের কাছে প্রত্যর্পণ করবে। সে পর্যন্ত তাকে অন্ততপক্ষে দালাই লামার মতো নির্বিরোধী এক আশ্রয়প্রার্থী হিসেবে বিবেচনা করেই তার অবস্থান নির্ধারণ করবে বলে আমরা আশাবাদী।

লেখক : সাংবাদিক, কলামিস্ট

সূত্র, আমার দেশ