জার্মানির সাবেক চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল বলেছেন, ‘শিক্ষকরা সাধারণ মানুষ নন, তাই যোগ্যতা ছাড়া শিক্ষকতা পেশা গ্রহণ করা কাম্য নয়।’ জার্মানির বিচারক, চিকিৎসক ও প্রকৌশলীরা যখন সে দেশের সর্বোচ্চ বেতনভোগী শিক্ষকদের সমতুল্য বেতন প্রদানের অনুরোধ জানান, তখন জার্মানির তৎকালীন চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল তাদের বলেন, ‘যারা আপনাদের শিক্ষাদান করেছেন, তাদের সঙ্গে কীভাবে আপনাদের তুলনা করি?’ প্রকৃতপক্ষে আদর্শ শিক্ষকই হলেন সমাজের শ্রেষ্ঠ সন্তান। সংগত কারণেই শিক্ষকের সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদার কথা বলতে গেলে যোগ্যতা, দায়িত্ব ও কর্তব্যের বিষয়টি সামনে চলে আসে। তাই শিক্ষককে হতে হবে গবেষণাধর্মী ও সৃষ্টিশীল। তার কর্তব্যনিষ্ঠা, নিরলস শ্রমশীলতা ও কঠোর নিয়ম-শৃঙ্খলাবোধ শিক্ষার্থীদের প্রেরণার উৎস। তার চারিত্রিক দৃঢ়তা হবে গ্রানাইট শিলের মতো কঠিন।

এখন প্রশ্ন হলো, এই মহান পেশার প্রতি আমরা শিক্ষকরা কতটুকু যত্নবান, কতটুকু নিষ্ঠাবান এবং কতটুকু আন্তরিক? এসব বিষয়ে শিক্ষকদের আত্মবিশ্লেষণের এখনই উপযুক্ত সময়। সুন্দর সমাজ, সুন্দর দেশ তথা সুন্দর পৃথিবীর জন্য গুণগত মানসম্পন্ন শিক্ষা অপরিহার্য; আর সেজন্য মেধাসম্পন্ন ও যোগ্য শিক্ষকের কোনো বিকল্প নেই।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দেশে দেশে যখন নতুন ভাবনা নিয়ে পুনর্গঠনের কাজ শুরু হয়, তখন ১৯৪৭ সালে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থার (ইউনেস্কো) এক সভায় বিশ্বের শিক্ষকদের জন্য একটি ‘সনদ’ প্রণয়নের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করা হয়। ১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা ঘোষণা করে, ‘শিক্ষা লাভ মানুষের মৌলিক অধিকার এবং ব্যক্তিত্ব বিকাশের হাতিয়ার।’ এরই ফলে ১৯৫২ সালে বিশ্ব শিক্ষক সংঘ (ডাব্লিউসিওটিপি) গঠিত হয়। এরপর আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বিশেষজ্ঞদের এক সভায় শিক্ষকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক সমস্যা এবং তা সমাধানের জন্য কিছু প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালের ৫ অক্টোবর ইউনেস্কোর এক সভায় শিক্ষকতা পেশার জন্য কী দায়িত্ব ও কর্তব্য এবং কী অধিকার ও মর্যাদা, তা নিয়ে ১৪৬ ধারা-উপধারাবিশিষ্ট একটি সুপারিশমালা প্রণয়ন করা হয়। এই ইউনেস্কো/আইএলও’র সুপারিশকেই ‘শিক্ষক সনদ’ বলা হয়। বিশ্বের ১৭২টি দেশের ২১০টি শিক্ষক সংগঠনের প্রতিনিধিত্বশীল সংস্থা এডুকেশন ইন্টারন্যাশনালের ক্রমাগত অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত ইউনেস্কোর ২৬তম অধিবেশনে গৃহীত সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে ইউনেস্কোর তৎকালীন মহাপরিচালক ড. ফ্রেডারিক মেয়রের যুগান্তকারী ঘোষণার ফলে ওই বছর থেকে প্রতি বছর ৫ অক্টোবর বিশ্ব শিক্ষক দিবস পালিত হয়। এর লক্ষ্য শিক্ষক সনদ বাস্তবায়ন করা। ১৯৯৫ সালে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রথমবারের মতো সরকারি উদ্যোগে বিশ্ব শিক্ষক দিবস উদ্‌যাপিত হয়।

ইউনেস্কো গতিশীল মনের অধিকারী কর্তব্যনিষ্ঠ ও নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক সমাজের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ২০২৫ সালে ৩১তম বিশ্ব শিক্ষক দিবসের মূল বিষয় হিসেবে ‘Teachers: Leading in Crisis, Reimagining the Future’ নির্ধারণ করেছে। এই দিবসটি উদ্‌যাপনকালে সারা বিশ্বের শিক্ষকদের মতো আমাদের দেশের শিক্ষকদেরও অতীতের সব অর্জন ও ব্যর্থতার সমীক্ষা করতে হবে এবং সেইসঙ্গে বিশ্বমানের শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার নিয়ে সম্মিলিতভাবে সচেষ্ট হতে হবে।

এখন ৩১তম বিশ্ব শিক্ষক দিবসে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা তথা শিক্ষকদের অবস্থা প্রসঙ্গে কিছুটা আলোকপাত করা প্রয়োজন। ১৯৭৩ সালে প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলো জাতীয়করণ করা হলেও মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও ডিগ্রি পর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি বৈষম্যের কবলে পড়ে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থার ৯৫ শতাংশ বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক সমাজ ন্যূনতম পেশাগত অধিকার ও মর্যাদাবঞ্চিত চরম এক লজ্জাজনক ও বেদনাদায়ক অবস্থার মধ্যে দিনযাপন করতে থাকে। কেননা তখন বেসরকারি শিক্ষকদের জন্য যেমন ছিল না কোনো চাকরিবিধি, আবার তেমনই ছিল না কোনো বেতন স্কেল। আর অন্যান্য কোনো ভাতার কথা কল্পনাতেও আনা যেত না। তাই বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা কোনোভাবেই সম্মানজনক পেশা বা চাকরি ছিল না। ফলে তখন থেকে বেসরকারি শিক্ষকরা আন্দোলনে নামেন। পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান বেসরকারি শিক্ষকদের এই দুরবস্থা জেনে মর্মাহত হন এবং তাৎক্ষণিকভাবে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য চাকরিবিধি প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন এবং বেসরকারি শিক্ষকদের জাতীয় বেতন স্কেলে অন্তর্ভুক্ত করে সরকারি কোষাগার থেকে বেতন স্কেলের ৫০ শতাংশ অর্থ প্রদানের নির্দেশ দেন। ১৯৮০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে তা কার্যকর হয়। সেদিনকার সেই সম্মানজনক অর্জনের সিঁড়ি বেয়ে আজ বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা এমপিও’র মাধ্যমে জাতীয় বেতন স্কেলের ১০০ শতাংশ বেতনের অর্থ সরকারি কোষাগার থেকে পায়। আজ বিশ্ব শিক্ষক দিবসে ইতিহাসের এই কালজয়ী নায়কের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি নিবেদন করছি।

লেখক : সভাপতি, বাংলাদেশ অধ্যক্ষ পরিষদ এবং সাবেক ট্রেজারার, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়

সূত্র, আমার দেশ