যদিও রানা প্লাজা বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের ইতিহাসের সঙ্গে সব সময় উচ্চারিত হবে। তবে এ দুর্ঘটনা আজ সমগ্র বিশ্বের জন্যে একটি কেস স্টাডিও বটে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, হয়তো সেটি না হলে কখনই এসব এত তাড়াতাড়ি হতো না। কীভাবে এত বিশাল বিপর্যয় থেকে উঠে আসতে হয় এবং অন্যদের জন্য অনুকরণীয় উচ্চতায় যাওয়া যায় তা বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে।

রানা প্লাজা ভবন ধসের দুর্ঘটনা পোশাক শিল্পের জন্য একটি ওয়েকআপ কল ছিল। এর পরে বিগত বছরগুলোয় পোশাক শিল্পে নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিতে বিপুল উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

রানা প্লাজা দুর্ঘটনা একটি অপূরণীয় ক্ষতি ছিল, তবে এ ক্ষতি পরবর্তী গৃহীত পদক্ষেপগুলোর কারণে আজ বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প অন্য রকম এক উচ্চতায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশ যখন তৈরি পোশাক রফতানিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর নানা পরিকল্পনায় ছিল, ঠিক তখন এ দুর্ঘটনা বাংলাদেশকে তো বটেই গোটা বিশ্বকেও স্তব্ধ করে দিয়েছিল। দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়ে সারা বিশ্বে যখন নানা সমালোচনার ঝড় আর বাংলাদেশকে বয়কট করতে ব্যস্ত ঠিক তখন দেশে চলেছে শিল্পের অস্তিত্বকে টিকিয়ে রাখার লড়াই। বাংলাদেশ দেখিয়েছে কীভাবে লড়াই করতে আর ফিরে আসতে হয়। জাতি হিসেবে আমরা কতটা লড়াকু আর শক্তিশালী এটি তার একটা বাস্তব উদাহরণ।

বিশেষ করে, ২০১৩ সাল থেকে শিল্পে নিরাপত্তার বিষয়ে সরকার ও আন্তর্জাতিক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান ও ট্রেড ইউনিয়নের সম্পৃক্ততা বেড়েছে এবং আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থাসহ (আইএলও) অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সহযোগিতায় শিল্পে ব্যাপক সংস্কার হয়েছে। প্রায় চার হাজার পোশাক কারখানায় নিরাপত্তা নিরীক্ষা করা হয়েছে। কারখানাগুলো অগ্নি, বৈদ্যুতিক ও কাঠামোগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কঠোর নীতি অনুসরণ করেছে। অগ্নি, বৈদ্যুতিক ও কাঠামোগত নিরাপত্তায় বিপুল অর্থ ব্যয় করেছে। বাংলাদেশ তৈরি পোশাক প্রস্তুত ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) পক্ষ থেকে সদস্যভুক্ত কারখানাগুলোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিবিড়ভাবে তদারকি করা হচ্ছে। নতুন সদস্য কারখানা অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে আইনের মৌলিক বিষয়গুলোর পাশাপাশি ভবন নিরাপত্তা, অগ্নিনিরাপত্তা ও বৈদ্যুতিক নিরাপত্তার বিষয়টিও কঠোরভাবে দেখা হচ্ছে। ২০১৪ সাল থেকে শিল্পে দুর্ঘটনার হার উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে।

নিরাপত্তা সংস্কৃতির চর্চায় আইএলও যুক্ত হয়েছে। আইএলওর সহযোগিতায় নিরাপত্তা বিষয়ে কারখানাগুলোর মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও এ ব্যাপারে তাদের প্রশিক্ষণ প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ফ্যাক্টরি ইন্সপেকশন রিপোর্ট এমনভাবে প্রকাশ করা হয় যা অনলাইনে দেখা যায়, গোটা বিশ্বে এমন নজির সেফটি অ্যান্ড সিকিউরিটির ক্ষেত্রে আর কোথাও নেই।

পোশাক শিল্পে কর্মক্ষেত্রের নিরাপত্তা এবং রেমিডিয়েশন পর্যবেক্ষণ করার জন্য দেশে একক মনিটরিং সংস্থা হিসেবে আরএমজি সাসটেইনেবল কাউন্সিল (আরএসসি) গঠিত হয়েছে। বিজিএমইএ বা বিকেএমইএর অনুমোদনক্রমে পোশাক কারখানাগুলো আরএসসিতে অন্তর্ভুক্ত হতে পারছে।

সাব-কন্ট্রাক্টিং কারখানাগুলোর জন্যও গাইডলাইন তৈরি করে দেয়া হয়েছে। এ গাইডলাইন অনুযায়ী সাব-কন্ট্রাক্টিং কাজে নিয়োজিত কারখানাগুলোর ভবনের স্ট্রাকচারাল ডিজাইন বা লে-আউট প্ল্যানে যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন থাকতে হচ্ছে। নিরাপদ শিল্প গড়ে তোলার পাশাপাশি শ্রমিকদের কল্যাণে নেয়া কিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ :

তাদের অধিকার সুরক্ষার জন্য একাধিকবার শ্রম আইন সংস্কার করা হয়েছে এবং ট্রেড ইউনিয়ন রেজিস্ট্রেশন সহজ করার জন্য নতুন করে আবারো শ্রম আইন সংশোধনের কাজ চলছে। ২০২৩ সালে পোশাক শিল্পে ন্যূনতম মজুরি ৫৬ শতাংশ বৃদ্ধি করা হয়েছে। সম্প্রতি ত্রিপক্ষীয় কমিটির সিদ্ধান্ত মোতাবেক শ্রমিকদের বার্ষিক মজুরি বৃদ্ধি ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯ শতাংশ করা হয়েছে।

রফতানির বিপরীতে উদ্যোক্তারা শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীনে গঠিত কেন্দ্রীয় তহবিলে অবদান রাখছেন, যেখান থেকে শ্রমিকদের চিকিৎসায়, তাদের মেধাবী সন্তানদের উচ্চশিক্ষার জন্য বৃত্তি প্রদান, নারী শ্রমিকদের মাতৃত্বকালীন সুবিধা, দুর্ঘটনায় স্থায়ীভাবে অক্ষম শ্রমিক এবং কর্মক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় নিহত শ্রমিকের পরিবারকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হচ্ছে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে এ কেন্দ্রীয় তহবিলে উদ্যোক্তারা প্রায় ১২ মিলিয়ন ডলার অবদান রেখেছেন।

GIZ ও ILO’র কারিগরি সহযোগিতায় বিজিএমইএ Employment Injury Scheme (EIS) পাইলট ভিত্তিতে পরিচালনা করছে। এর আওতায় কর্মীরা কর্মক্ষেত্রে অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনায় মৃত্যুবরণ করলে তাদের পরিবারের সদস্যরা এবং কর্মী স্থায়ীভাবে অক্ষম হলে তিনি মাসিকভিত্তিতে দীর্ঘমেয়াদি আর্থিক সুবিধা পাবেন। এ প্রকল্পে ৬০টির অধিক ব্র্যান্ড আর্থিক সহায়তা করছে।

ঢাকা ও চট্টগ্রামে আটটি স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং চট্টগ্রামের একটি হাসপাতালের মাধ্যমে শ্রমিকদের স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হচ্ছে। ‘বিজিএমইএ মিরপুর হাসপাতালে’র নির্মাণকাজও দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে।

দেশের পোশাক শিল্প খাতের জন্য সরকার, মালিক ও শ্রমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে আরএমজিবিষয়ক ত্রিপক্ষীয় পরামর্শ পরিষদ পুনর্গঠন করেছে। এ কমিটি শ্রম ও কর্মক্ষেত্র সম্পর্কিত ইস্যুগুলো নিয়ে কাজ করছে।

ট্রেড ইউনিয়ন নিবন্ধনের সুবিধার্থে ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার জন্য নিবন্ধন প্রক্রিয়াটি একটি এসওপিসহ অনলাইন করা হয়েছে। শ্রম অধিদপ্তরে একটি হেল্প ডেস্ক খোলা হয়েছে, যাতে নিবন্ধনসংক্রান্ত বিষয়ে শ্রমিকদের সহায়তা করা যায়। প্রতিটি কারখানায় নিরাপত্তা কমিটি (সেফটি কমিটি) এবং নির্বাচিত অংশগ্রহণ কমিটি (ইলেক্টেড পার্টিসিপেশন কমিটি) বাধ্যতামূলকভাবে গঠন করা হয়েছে। শ্রমিকদের অভিযোগগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির লক্ষ্যে শ্রম আদালতের সংখ্যা বৃদ্ধিসহ শ্রম আদালত এবং শ্রম আপিল ট্রাইব্যুনাল মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য আদালতের জন্য সময়সীমা নির্ধারণ করা হয়েছে।

পোশাক শিল্পে শ্রমসংক্রান্ত সমস্যাবলি সমাধানের জন্য বিজিএমইএতে বর্তমানে চারটি আরবিট্রেশন কমিটি কাজ করছে, যেখানে চেয়ারম্যান হিসেবে অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র বিচারপতি এবং সদস্য হিসেবে দায়িত্বশীল সব শ্রমিক নেতা রয়েছেন। পোশাক কারখানায় কাজ করা মেয়েদের জন্য উচ্চশিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে। বর্তমানে এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেনে ৬০ জন নারীকর্মী উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করছেন।

মাদার্স আর্ট ওয়ার্ক প্রজেক্ট ইউনিসেফের সঙ্গে এর পার্টনারশিপে হয়েছে, যা কোনো ইউএন অর্গানাইজেশনের প্রথম কোনো পার্টনারশিপ। এ প্রজেক্টে নারী বিশেষ করে যারা সন্তান সম্ভবা অথবা সন্তানের মা হয়েছে তাদের জন্য কন্ডাক্টিভ কাজের ক্ষেত্র তৈরি করার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে।

পোশাক শিল্প কারখানাগুলোকে কমপ্লায়েন্ট হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নিয়ে আইএলও-বেটারওয়ার্ক বাংলাদেশ কাজ করে যাচ্ছে। কারখানাগুলোর এ বিষয়ে সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনীয় সহায়তা করার জন্য বিজিএমইএ বেটারওয়ার্ক বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করছে। অনেক কারখানা নিজ নিজ ভবনে শ্রমিকদের জন্য ন্যায্যমূল্যের দোকান, তাদের সন্তানদের জন্য শিশু দিবাযত্ন কেন্দ্র পরিচালনা করছে। এছাড়া পোশাক শিল্পে শ্রম আইনের বাইরেও অনেক ভালো উদ্যোগের দৃষ্টান্ত রয়েছে।

আমাদের বর্তমানে ২৪০টি লিড সার্টিফায়েড কারখানা রয়েছে, যার মধ্যে ৯৮টি প্লাটিনাম রেটেড ও ১২৮টি গোল্ড রেটেড কারখানা। বিশ্বব্যাপী শীর্ষ ১০টি লিড সার্টিফায়েড কারখানার মধ্যে ৮টি বাংলাদেশে রয়েছে, যা বিশ্বে বাংলাদেশকে নতুন পরিচিতি এনে দিয়েছে। পরিবেশবান্ধব কারখানাগুলো শ্রমিকদের জন্য কর্মক্ষেত্রগুলো আরো পরিবেশবান্ধব ও সুবিধাজনক করে তুলতে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি এবং মেশিনারিগুলো গ্রহণ করছে, প্রক্রিয়াগুলো আপগ্রেড করছে। এতে শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা বাড়ছে। বিজিএমইএ দপ্তরে সেন্টার ফর ইনোভেশন, ইফিসিয়েন্সি অ্যান্ড অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ শিল্পে উৎপাদনশীলতা, উদ্ভাবন ও দক্ষতা বাড়ানোর জন্য বিজিএমইএর প্রধান কার্যালয়ে সেন্টার ফর ইনোভেশন, ইফিসিয়েন্সি অ্যান্ড অকুপেশনাল সেফটি অ্যান্ড হেলথ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে।

ট্রান্সপারেন্সি, ডিলিজেন্স ও সাসটেইনেবিলিটি:

সামাজিক ও পরিবেশগত ডিউ ডিলিজেন্স বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং এ বিষয়ে কারখানাগুলোকে নির্দেশনা প্রদানের লক্ষ্যে বিজিএমইএতে রেসপন্সিবল বিজনেস হাব (আরবিএইচ) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জিআইজেডের সহায়তায় প্রতিষ্ঠিত এ কেন্দ্র মানবাধিকার ও পরিবেশগত ডিউ ডিলিজেন্স বিষয়ে নতুন নতুন প্রবিধানগুলোর সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার বিষয়ে কারখানাগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে সহায়তা করছে।

পোশাক কারখানাগুলোর এনভায়রনমেন্টাল, সোশ্যাল এবং গভর্নেন্স (ইএসজি) সংক্রান্ত কাজগুলোর অগ্রগতির তথ্য সংগ্রহ ও প্রকাশের জন্য বিজিএমইএ দপ্তরে একটা অনলাইন ইএসজি ডাটা ডিসক্লোজার প্লাটফর্ম ও প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে, যেখানে আমাদের কারখানাগুলো নিয়মিতভাবে রিপোর্টিং করছে।

বিজিএমইএ, লাউডস ফাউন্ডেশন এবং ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির কলাবোরেশনে ডিজিটাল আরএমজি ম্যাপ উদ্বোধন করে, যা পরবর্তী সময়ে ট্রান্সপারেন্সি ও সাসটেইনিবিলিটির এক অন্যরকম মাইলফলক হয়ে উঠেছে।

যদিও রানা প্লাজা বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্পের ইতিহাসের সঙ্গে সব সময় উচ্চারিত হবে। তবে এ দুর্ঘটনা আজ সমগ্র বিশ্বের জন্যে একটি কেস স্টাডিও বটে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, হয়তো সেটি না হলে কখনই এসব এত তাড়াতাড়ি হতো না। কীভাবে এত বিশাল বিপর্যয় থেকে উঠে আসতে হয় এবং অন্যদের জন্য অনুকরণীয় উচ্চতায় যাওয়া যায় তা বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছে।

মো. মহিউদ্দিন রুবেল: বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সাবেক পরিচালক এবং ডেনিম এক্সপার্ট লিমিটেডের অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

সূত্র, বণিক বার্তা