বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা বাণিজ্যিকীকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসার মান উন্নত করার কথা থাকলেও সেখানে আমাদের দেশে তা ব্যাহত হচ্ছে। অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার ফলে সাধারণ মানুষ দেশের হাসপাতাল ও চিকিৎসাসেবার প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। হাসপাতাল-ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোয় সঠিক রোগ নির্ণয় না হওয়াসহ বিভিন্ন কারণে আস্থা রাখতে পারছেন না মানুষ। সাধারণ মানুষের বিদেশ যাওয়ার প্রবণতাকে কমানোর জন্য সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় সাশ্রয়ী সেবার সঙ্গে চিকিৎসা পর্যটন খাতকেও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিতে হবে। এ ছাড়া একটি জাতীয় বীমা স্কিম তৈরি করতে হবে, যাতে জটিল সার্জারি ও আন্তর্জাতিক মানের চিকিৎসাসহ সব চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভবপর হয়।

বহু বছর ধরে বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাত যেমন একদিকে বিকশিত হয়েছে, অন্যদিকে নানা সংকটে ক্রমেই ডুবছে। সম্প্রতি বিবিএস কর্তৃক পরিচালিত জরিপে প্রকাশ পেয়েছে, দেশের প্রতি তিনজনের মধ্যে একজন মানুষ সরকারি বা বেসরকারি হাসপাতালে অবহেলা, অযত্ন ও অপচিকিৎসার শিকার হয়েছেন। স্বাস্থ্যসেবার প্রতি সাধারণ মানুষের অসন্তোষ ক্রমেই বৃদ্ধি পেয়েছে। জরিপে দেখা গেছে, শহরাঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে অবহেলার হার গ্রামাঞ্চলের তুলনায় অধিক। জরিপে চিকিৎসকের দায়িত্বহীনতা, প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে অতিরিক্ত ব্যয়ের বিষয়টিও উঠে এসেছে। সরকারি হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, জেলা সদর হাসপাতাল ও সরকারি মেডিকেল কলেজে দেশের বহু মানুষ চিকিৎসা গ্রহণ করলেও সরকারি সেবার মান নিম্নমানের হওয়ায় বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকের প্রতি মানুষের নির্ভরশীলতা বেড়ে চলছে। অথচ বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে চিকিৎসার ব্যয় সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে ।

আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের পরিণতি হবে বিপজ্জনকআওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের পরিণতি হবে বিপজ্জনক

চিকিৎসার জন্য বিদেশমুখী প্রবণতা দেশের চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থার অভাবেরই প্রতিফলন। অথচ এসব রোগের চিকিৎসার জন্য দেশে যথেষ্ট দক্ষ চিকিৎসক ও প্রযুক্তির অভাব নেই; কিন্তু সঠিক পরিকল্পনা, স্বচ্ছতা ও উন্নত ব্যবস্থাপনার অভাবের কারণে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা জনগণের চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। দেশে একদিকে যেমন চিকিৎসার ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে, অন্যদিকে অনেকের কাছেই ওষুধের মূল্য ক্রমেই নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্রে কোম্পানির ওষুধের নামের পরিবর্তে জেনেরিক নাম লেখা উচিত বলে জরিপে মতপ্রকাশ দিয়েছে বহু মানুষ। তবে তা যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হচ্ছে না। তা ছাড়া অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার, ওষুধের মূল্য নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থতা, ওষুধ কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্য সাধারণ রোগীর জন্য এক অসহনীয় অবস্থা তৈরি করেছে বলে জরিপে মতামত উঠে এসেছে।

বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, দেশের জিডিপির ন্যূনতম ৫ শতাংশ স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ না করলে এ সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহার, চিকিৎসা ব্যবস্থাপনার আধুনিকীকরণ এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ করলে জনগণের কষ্ট অনেকাংশে লাঘব হবে। এর সঙ্গে দুর্নীতিমুক্ত স্বাস্থ্যব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় নিয়মিত মনিটরিং জোরদার করা প্রয়োজন। চিকিৎসকদের দায়িত্বহীনতার জন্য কঠোর শাস্তির বিধান থাকা উচিত এবং রোগীদের সঠিক চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ তদারকির প্রয়োজন। পাশাপাশি জনগণের জন্য স্বাস্থ্যসেবা বাধ্যতামূলক সাংবিধানিক অধিকার হিসেবে বাস্তবায়ন করার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করাও জরুরি। জরিপে দেখা গেছে, ৯১ শতাংশ মানুষ চাচ্ছে, সরকার যেন সব নাগরিকের জন্য প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে আইনগতভাবে বাধ্য হয়। এই দাবি বাস্তবায়িত হলে স্বাস্থ্য খাতে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসতে পারে।

স্বাস্থ্যসেবার অভাবে সাধারণ মানুষের কর্মক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে। ফলে উৎপাদনশীলতা কমে যাচ্ছে। দীর্ঘ মেয়াদে তা জাতীয় অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। কারণ রোগব্যাধিতে আক্রান্ত জনগোষ্ঠী চিকিৎসার জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতে বাধ্য হয়েছে, যা সঞ্চয় ও বিনিয়োগের সুযোগ হ্রাস করছে। সুতরাং, স্বাস্থ্যব্যবস্থার উন্নয়ন শুধু মানবিক প্রয়োজনই নয়, তা অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম পূর্বশর্তও বটে।

লেখক : সাংবাদিক

সূত্র, আমার দেশ