বাংলাদেশে সংরক্ষিত নারী আসন প্রথম দেওয়া হয় ১৯৭২ সালে, যার সংখ্যা ছিল ১৫টি। এরপর পর্যায়ক্রমে ১৯৭৮ সালে ৩০টি, ২০০৪ সালে ৪৫টি এবং ২০১১ সালে ৫০টি। এবারের ঐকমত্য কমিশন কর্তৃক সংস্কার প্রস্তাবে বলা হচ্ছে, নারীর জন্য সংরক্ষিত আসন হবে ১০০টি। পর্যায়ক্রমে এমন আসন বৃদ্ধি রাজনীতির ময়দানে নারীর পক্ষে কতটা সহায়ক? বা মৌলিক যেই সমস্যাগুলোর কারণে নারীরা রাজনীতিতে পিছিয়ে আছেন, সেই সমস্যাগুলোর কতটা ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে এমন আসন বৃদ্ধিতে?

রাজনীতি নিজেই একটা অসম্ভব পাওয়ার প্লের জায়গা, সে ক্ষেত্রে আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক সংস্কৃতির কথা তো বলাই বাহুল্য। তাই ‘নারী’ বিষয়টি ভাবার আগে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আগে ভাবতে হবে এমন পাওয়ার প্লের জায়গায় মানুষের মনস্তত্ত্ব কীভাবে কাজ করে? সেখানে এই সংরক্ষিত সিটগুলোয় যারা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বসবেন, তারা মানুষ হিসেবে এবং এই জনপদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির ‘পাওয়ার প্লে’ বিষয়টিকে কতটুকু ম্যানেজ করে চলতে পারবেন? অর্থাৎ এই আসনগুলোয় আমরা কি বাস্তবিকভাবে কিছু যোগ্য নারীকে দেখব, নাকি রাজনৈতিক নেতাদের পরিবার বা ঘনিষ্ঠজনদের চেহারা দেখব?

অধ্যাপিকা মাহমুদা বেগম সংগ্রাম ও দৃঢ়তার প্রতীকঅধ্যাপিকা মাহমুদা বেগম সংগ্রাম ও দৃঢ়তার প্রতীক

রাজনীতির মাঠে নারী পদপ্রার্থী বা কর্মীদের অনেক ধরনের বৈষম্যের এবং অনৈতিক আচরণের শিকার হতে হয়। যার কারণে একজন নারী পদপ্রার্থীর অবস্থান একজন পুরুষ পদপ্রার্থীর চেয়ে অনেক বেশি নাজুক এবং সংখ্যায় কম। অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক দল একজন যোগ্য নারীর চেয়ে তুলনামূলক কম যোগ্যতাসম্পন্ন পুরুষকে নমিনেশন দেয়, কারণ নারীর তুলনায় পুরুষ নেতার সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা বেশি, তাই ভোটে জেতার সম্ভাবনা বেশি বা বিপরীত পক্ষের প্রার্থী যদি একজন পুরুষ হন, তাহলে তার বিপরীতে নারী পদপ্রার্থীকে তুলনামূলক দুর্বল মনে করা হয়।

এখন কথা হচ্ছে, পর্যায়ক্রমে সংরক্ষিত আসন বাড়িয়ে নারী পদপ্রার্থী বা কর্মীদের প্রতি বৈষম্য এবং অনৈতিক আচরণের প্রভাব কতটুকু কমানো গিয়েছে? আগে এসব অনৈতিক আচরণ বা বৈষম্যের প্রতি কী কী শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে? গায়িকা, নায়িকা, অভিনেত্রী যাদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রের যথেষ্ট মেরিট আছে কিন্তু এই আসনে বসার জন্য যথেষ্ট মেরিট নেই, শুধু রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষকতায় এমন মানুষেরই কি আবার এই আসনে বসতে দেখতে হবে?

যেহেতু রাজনীতির মাঠে নারীরা ন্যায্য সুযোগ পান না, সে হিসেবে কিছুসংখ্যক নারী আসন হয়তো প্রয়োজন আছে, যেই আসনে বসবেন যোগ্য নারীরা। কিন্তু তার আগে, নারী রাজনৈতিক কর্মী বা প্রার্থীর ক্ষেত্রে প্রত্যেকটি দলকে ন্যায্যতা এবং ইনসাফ নিশ্চিত করতে হবে। আসন বৃদ্ধির চেয়ে সংস্কারের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো মূল প্রাধান্য পাচ্ছে কি? তা না হলে আসন বৃদ্ধি শুধু একটা সুগার কোটিং ছাড়া আর কোনো কাজ দেবে না। আসন বৃদ্ধির আড়ালে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন তৃণমূলপর্যায়ের নেত্রী বা কর্মীরা, কারণ এই আসনগুলো ভাগবাটোয়ারা হয়ে যায় উচ্চপর্যায়ের সুবিধাভোগীদের ঘনিষ্ঠদের মধ্যে বা মোটা অঙ্কের লেনদেনের বিনিময়ে।

সংরক্ষিত আসনের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি না করে শুধু নারীর নাম দিয়ে আসন বৃদ্ধি করলেই নারীর ক্ষমতায়ন হয়ে যায় না। রাজনৈতিক টকশোগুলোয় আসন নিয়ে প্রচুর আলাপ শোনা গেলেও, রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণে কেন এত জটিলতা, অন্যায্যতা, অসদাচরণÑএসব নিয়ে এখন পর্যন্ত তেমন কোনো ডিসকোর্স গড়ে উঠেনি।

লেখক : সিনিয়র লেকচারার, অর্থনীতি বিভাগ, ইনডিপেনডেন্ট ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশ

নারী অধিকারকর্মী

সূত্র, আমার দেশ