কেউ বলেন বিপ্লব, আবার কেউ বলেন ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থান। যে নামই দেওয়া হোক, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সর্বস্তরের মানুষের সফল আন্দোলন অনেক দিনের আওয়ামী ফ্যাসিবাদকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে অপসারণ করে। এই সাফল্য মানুষের মধ্যে জাগ্রত করে বিরাট পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা। যে রাজনীতি, যে রাষ্ট্রব্যবস্থা, যেসব আইনকানুন ও যেসব প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো দীর্ঘকাল ধরে সাধারণ মানুষকে পীড়ন ও বৈষম্যের শিকার করেছে এবং ক্ষমতাসীনদের স্বার্থরক্ষার হাতিয়ার হয়েছে, সেগুলো বদলে ফেলার প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে। কিন্তু নতুন কী দিয়ে পুরোনোকে প্রতিস্থাপন করা হবে, সে বিষয়ে সর্বসাধারণের স্পষ্ট ধারণা নেই। অন্তর্বর্তী সরকার বিশেষজ্ঞদের দিয়ে কতগুলো সংস্কার কমিটি করে দিয়েছে। তাদের প্রস্তাব সম্পর্কে আলোচনার মাধ্যমে রাজনৈতিক ঐকমত্য তৈরির জন্য পলিটিক্যাল পার্টিগুলোকে নিয়ে দফায় দফায় আলোচনা চলছে। এতে আগামীর সম্ভাব্য শাসকরা নির্ণয় করছেন কতটা পরিবর্তন তারা মেনে নেবেন। পরবর্তী জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ও অন্যান্য কিছু ইস্যু নিয়ে সরকার ও রাজনৈতিক বড় শক্তিগুলোর দ্বন্দ্বে এই সংস্কার প্রক্রিয়া মাঝে কিছুটা থমকে গেলেও লন্ডন সমঝোতার পর ওই উদ্যোগে ফের গতি ফিরে এসেছে। আশু ও দীর্ঘমেয়াদি করণীয় নিয়ে অল্পস্বল্প মতৈক্যও সৃষ্টি হচ্ছে। বলা চলে, বাংলাদেশে এখন সংস্কারের একটি জোরালো হাওয়া বইছে। অর্থনীতি থেকে শুরু করে প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা—সর্বত্রই যেন এক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা দৃশ্যমান। নানা মহলে রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও আইনি সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, যা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই আলোচনার গভীরে গিয়ে যদি আমরা বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করি, তবে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, শুধু কাঠামোগত বা আইনি পরিবর্তন দিয়ে প্রকৃত অর্থে একটি সুস্থ ও কার্যকর রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব নয়। এর চেয়েও জরুরি হলো রাজনৈতিক, দলীয় ও রাজনীতিবিদদের মন-মানসিকতার সংস্কার। রাষ্ট্রীয় কাঠামো বা আইন হচ্ছে একটি গাড়ির ইঞ্জিনের মতো। কিন্তু চালকের যদি সঠিক দিকনির্দেশনা না থাকে, যদি তিনি নিয়মকানুন না মানেন, তবে সেই উন্নত ইঞ্জিন দিয়েও কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে পৌঁছানো সম্ভব নয়। বাংলাদেশে আজ যে অচলাবস্থা, যে অস্থিরতা, তার মূলে রয়েছে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের আচরণ, তাদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া এবং সামগ্রিকভাবে তাদের নৈতিক স্খলন। কেন মনোভঙ্গির সংস্কার এত জরুরি? ১. গণতন্ত্রের প্রকৃত রূপায়ণ : বাংলাদেশে বারবার গণতন্ত্রের কথা বলা হয়, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত মূল্যবোধগুলো প্রায়ই উপেক্ষিত। নির্বাচনকে শুধু একটি আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে দেখা হয়, যেখানে জয়লাভই একমাত্র লক্ষ্য। অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্র, বিরোধী মতের প্রতি শ্রদ্ধা, জবাবদিহি—এ বিষয়গুলো যেন গৌণ হয়ে উঠেছে। রাজনীতিবিদদের মনোভঙ্গির সংস্কার ছাড়া সত্যিকারের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা অসম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন শুধু ক্ষমতার জন্য নয়, বরং জনগণের সেবা ও দেশের উন্নতির জন্য রাজনীতি করার মানসিকতা। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শক্তিশালী করতে হলে রাজনীতিবিদদের আন্তরিকতা ও সততা অত্যাবশ্যক। ২. সুশাসন ও দুর্নীতির মূলোৎপাটন : দুর্নীতি বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান ব্যাধি। আইন আছে, কিন্তু তার প্রয়োগে আসে দীর্ঘসূত্রতা, পক্ষপাতিত্ব এবং রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ। যখন একজন রাজনীতিবিদ নিজেই অন্যায়ভাবে সম্পদ অর্জনে লিপ্ত হন অথবা দুর্নীতির প্রশ্রয় দেন, তখন কোনো কঠোর আইন বা শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানও কার্যকর হতে পারে না। দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহনশীলতার যে নীতি, তা শুধু মুখের বুলি না হয়ে বাস্তবে রূপ নিতে হলে রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও নৈতিক দৃঢ়তা অপরিহার্য। রাজনীতিবিদদের মনোভঙ্গির পরিবর্তন না হলে দুর্নীতির চক্র ভাঙা শুধুই স্বপ্ন থেকে যাবে। ৩. সহিংসতার অবসান ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা : বাংলাদেশের রাজনীতিতে সহিংসতা একটি নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। রাজপথে সংঘর্ষ, জ্বালাও-পোড়াও, প্রতিপক্ষের প্রতি অসহিষ্ণুতা—এগুলো যেন আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতির অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সহিংসতা শুধু জনগণের জানমালের ক্ষতি করে না, বিনিয়োগ ও উন্নয়নের পথেও বড় বাধা সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্মান ও সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হলে নেতাদের মনোভঙ্গিতে পরিবর্তন আনতে হবে। তারা যদি মনে করেন, প্রতিপক্ষকে নির্মূল করাই রাজনীতির উদ্দেশ্য, তবে কোনো আইনি সংস্কারই এ অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারবে না। ৪. জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা : রাজনীতি হওয়া উচিত জনগণের জন্য। কিন্তু প্রায়ই দেখা যায়, রাজনীতিবিদরা নিজেদের স্বার্থ, দলীয় আনুগত্য এবং ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেদের অবস্থানকে অগ্রাধিকার দেন। জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, তাদের দৈনন্দিন সমস্যাগুলো সমাধানের পরিবর্তে তাদের মনোযোগ থাকে কীভাবে ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করা যায়। এই প্রবণতা থেকে বেরিয়ে আসতে হলে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা ও দায়িত্বশীলতার মানসিকতা গড়ে তোলা জরুরি। এটি কোনো আইন দিয়ে শেখানো সম্ভব নয়, এটি আত্ম উপলব্ধি ও নৈতিকতার বিষয়। ৫. দূরদর্শী নেতৃত্ব ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা : একটি জাতির অগ্রগতির জন্য প্রয়োজন দূরদর্শী নেতৃত্ব। কিন্তু যখন রাজনীতি স্বল্পমেয়াদি লাভ-ক্ষতির হিসাব কষে চলে, যখন শুধু পরবর্তী নির্বাচনই একমাত্র লক্ষ্য হয়, তখন দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন সম্ভব হয় না। নদীভাঙন, জলবায়ু পরিবর্তন, নগরায়ণ, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতের সংকট—এসব সমস্যা সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ও তার বাস্তবায়নে রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং দূরদর্শী মনোভঙ্গি প্রয়োজন। শুধু ক্ষমতার চেয়ার ধরে রাখার মানসিকতা দিয়ে এসব বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা অসম্ভব। ৬. দলীয় কোন্দল ও অগণতান্ত্রিক চর্চা : রাজনৈতিক দলগুলোর অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অভাবও একটি বড় সমস্যা। যখন দলের ভেতরের প্রক্রিয়াগুলো অস্বচ্ছ হয়, যখন নির্দিষ্ট কিছু ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকে, তখন যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি হয় না। কর্মীরা দলীয় আদর্শের চেয়ে ব্যক্তির আনুগত্যে বেশি বিশ্বাসী হন। এটি শুধু দলের ক্ষতি করে না, সামগ্রিকভাবে দেশের গণতান্ত্রিক কাঠামোকেও দুর্বল করে। দলগুলোর ভেতরের অগণতান্ত্রিক চর্চা বন্ধ করতে এবং প্রকৃত অর্থেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হলে দলীয় নেতৃত্বের মনোভঙ্গি পরিবর্তন অপরিহার্য। কীভাবে এই মনোভঙ্গির পরিবর্তন আনা সম্ভব? এই পরিবর্তন রাতারাতি আসবে না, এর জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত প্রচেষ্টা এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা : শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন : ছোটবেলা থেকেই শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিকতা, সহনশীলতা এবং দেশপ্রেমের বীজ বপন করতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর আত্মবিশ্লেষণ : প্রতিটি রাজনৈতিক দলের উচিত নিজেদের অভ্যন্তরীণ ত্রুটিগুলো চিহ্নিত করা এবং সেগুলো দূর করার জন্য আন্তরিকভাবে কাজ করা। সুশীল সমাজের ভূমিকা : সুশীল সমাজকে আরো সক্রিয় হয়ে রাজনীতি ও রাজনীতিবিদদের আচরণ নিয়ে গঠনমূলক সমালোচনা এবং ইতিবাচক পরামর্শ দিতে হবে। গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা : গণমাধ্যমকে পক্ষপাতহীনভাবে সংবাদ পরিবেশন করতে হবে এবং রাজনীতিবিদদের জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। তরুণ প্রজন্মের অংশগ্রহণ : তরুণ প্রজন্মকে সুস্থধারার রাজনীতিতে অংশগ্রহণে উৎসাহিত করতে হবে, যাতে তারা ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব হিসেবে নৈতিক মূল্যবোধ নিয়ে উঠে আসতে পারে। জনগণের চাপ : সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো জনগণের পক্ষ থেকে চাপ সৃষ্টি করা। যদি জনগণ অন্যায়ের প্রতিবাদ করে, যদি তারা নীতিহীন রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান করে, তবে রাজনীতিবিদরা নিজেদের আচরণ পরিবর্তনে বাধ্য হবেন। রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও আইনি সংস্কার নিঃসন্দেহে প্রয়োজনীয়। সংসদকে কার্যকর করা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা, স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করা—এগুলো সবই জরুরি। কিন্তু এসবই অকার্যকর হয়ে পড়বে যদি যারা এই কাঠামো পরিচালনা করবেন, যারা এই আইন প্রয়োগ করবেন, তাদের মানসিকতায় সততা, নৈতিকতা, দেশপ্রেম এবং জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা না থাকে। আমরা একটি জাতি হিসেবে তখনই সত্যিকার অর্থে উন্নত হতে পারব, যখন আমাদের রাজনীতি, আমাদের রাজনৈতিক দলগুলো এবং আমাদের রাজনীতিবিদরা নিজেদের ক্ষুদ্র দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশের বৃহত্তর স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবেন। যখন তারা শুধু ক্ষমতার জন্য নয়, বরং একটি সুস্থ, সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ার জন্য রাজনীতি করবেন। এই মানসিকতার সংস্কারই বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে এবং এটিই সবচেয়ে বড় এবং জরুরি সংস্কার। লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
ই-মেইল : [email protected]
বিষয়: মারুফ কামাল খান