মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যতে কী ঘটতে যাচ্ছে, সেই সম্পর্কে নির্দিষ্ট করে কিছু বলা কঠিন। তবে ইরানের ওপর ইসরাইলের এ হামলা বেশ কিছু ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটিয়েছে। প্রথমত, ইসরাইল আবার দেখিয়ে দিল যে তাদের গোয়েন্দা সংস্থা ইরানের কতটা ভেতরে প্রবেশ করতে সক্ষম।

সামরিক এবং গোয়েন্দা বাহিনী যুগপৎ হামলা পরিচালনা করল। একদিকে ইসরাইলি জেটগুলো আকাশ দখল করে রাখল, অন্যদিকে মোসাদের এজেন্টরা ইরানের ভেতরে ড্রোন ঘাঁটি বানিয়ে বাকি কাজের আঞ্জাম দিল।

দ্বিতীয়ত, ইরানের প্রক্সিগুলো দুর্বল হয়ে যাওয়ার পর দেশটির না আছে কোনো কার্যকর আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা আর না আছে শক্তিশালী গোয়েন্দা সক্ষমতা। ফলে ইরানের পক্ষে কার্যকর প্রতিশোধ নেওয়া কঠিন। আছে কিছু ড্রোন আর ব্যালাস্টিক মিসাইল। এর ব্যবহার অবশ্য আমরা দেখছি।

তৃতীয়ত, ইসরাইলি হামলার ফলে বোঝা গেল যে ইসরাইল-আমেরিকা-ইরানের ত্রিমাত্রিক সম্পর্ক (‘লাভ ট্রায়াঙ্গেল’) কতটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে।

ইসরাইলের এবারের আক্রমণটি শুধু ইরানের পারমাণবিক স্থাপনা ও পরমাণু বিজ্ঞানীদের ওপর হামলার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। আক্রমণটি এমনভাবে চালানো হয়েছে, যাতে ইরান সহসা পাল্টা আক্রমণ না করতে পারে। এ কারণে সে একই সঙ্গে বিমানবাহিনীর ঘাঁটিগুলোর প্রধান ও ইরানের রেভল্যুশনারি গার্ড কমান্ডার হোসেন সালামিকে হত্যা করেছে।

আর ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে টার্গেট করার মধ্য দিয়ে তারা এই বার্তা দিল, ইসরাইল চাইলে যে কাউকে যেকোনো সময় নিঃশেষ করে দিতে পারে। এমনকি আয়াতুল্লাহ খামেনিকেও।

ইরান এতদিন আলাপ-আলোচনা নিয়েই মগ্ন ছিল। কিন্তু তার মানে তো এই না যে ইসরাইলি আক্রমণের ব্যাপারে তার অসতর্ক থাকা উচিত হয়েছে। ইসরাইলের হামলা যে ইরানের কল্পনারও বাইরে চলে যেতে পারে, তা ইরানের বিবেচনায় রাখা উচিত ছিল।

অবশ্য এক অর্থে ইসরাইলি হামলা আর পরমাণু চুক্তি একই কথা। কারণ ট্রাম্প আগে থেকেই ইরানকে স্পষ্ট বার্তা দিয়েছিল যে পরমাণু বিষয়ে একটা চুক্তিতে পৌঁছানোর জন্য ইরানের হাতে বেশি সময় নেই। দেরি করলে ইসরাইল হামলা করে বসতে পারে।

ঘটনাচক্রে, এই ইসরাইলি হামলার সময়টা ডোনাল্ড ট্রাম্পের বেঁধে দেওয়া সময়সীমার সঙ্গেও মেলে। গত ১২ মে ট্রাম্প খামেনিকে একটা চিঠি পাঠিয়ে দুই মাসের সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন।

আবার গত ১২ জুন আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ) ঘোষণা দেয়, গত দুই দশকের মধ্যে প্রথমবারের মতো ইরান পরমাণু বিস্তার রোধে তার কৃত অঙ্গীকার ভঙ্গ করেছে। সংস্থাটির মন্তব্যের জবাবে ইরান বলেছে, সে পরমাণু সমৃদ্ধকরণের জন্য আরো একটি স্থাপনা চালু করবে। ইরান এই ঘোষণা দেওয়ার মাত্র এক দিনের মাথায় এ হামলার ঘটনা ঘটল।

ইসরাইলি আক্রমণের পরপর ট্রাম্পের দেওয়া বিবৃতিটাও খুব তাৎপর্যপূর্ণ। ট্রাম্প বলেছেন, ‘পরমাণু চুক্তি করার জন্য আমি ইরানকে দফায় দফায় সুযোগ দিয়েছি। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়েছে। আমি বলেছিলাম, পরমাণু চুক্তি না করলে এর পরিণাম হবে অত্যন্ত ভয়াবহ। এমন কিছু ঘটবে, যা তাদের ধারণারও বাইরে।’… ‘সবকিছু খতম হয়ে যাওয়ার আগেই ইরানকে এই চুক্তিতে সম্মত হতে হবে। অন্যথায় এককালে ইরানি সাম্রাজ্য বলতে যা কিছু ছিল, তার কোনো অস্তিত্বই থাকবে না।’

ট্রাম্প প্রশাসন তেহরানের সঙ্গে একটি চুক্তি করতে উদগ্রীব হয়ে আছে। ট্রাম্প প্রশাসন মনে করে, এ হামলার পর পরমাণু চুক্তিতে ইরানকে রাজি করানো যাবে। তবে ইরান যেভাবে অনড় অবস্থান নিয়েছে, তাতে ইরানকে হয়তো অনেক বেশি মূল্য চুকাতে হবে। বিশেষ করে ইরান যদি এই হামলার যথাযথ জবাব না দিতে পারে, তাহলে ইরানের অবস্থান খুবই দুর্বল হয়ে যাবে।

ট্রাম্প প্রশাসন সরাসরি এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। তবে হামলার আগে ইসরাইলের তরফ থেকে হামলার লক্ষ্যবস্তু ও সময় জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর বর্তমানে ট্রাম্প প্রশাসনের সামরিকভাবে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কোনো ইচ্ছাও নেই। তবে ইসরাইল যদি বেকায়দায় পড়ে যায়, সে কথা ভিন্ন। অবশ্য ইসরাইলের বেকায়দায় পড়ার সম্ভাবনাও নেই।

গতকাল রোববার (১৫ জুন) ওমানে ইরান ও আমেরিকার কর্মকর্তাদের মধ্যে ষষ্ঠ দফায় বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। তবে, ইরান আক্রান্ত হওয়ার পর এই বৈঠক প্রায় অসম্ভব। আক্রান্ত হওয়ার পরপরই ইরান জানিয়ে দিয়েছে তারা আর বৈঠকে বসবে না। ইরান ইতোমধ্যে পাল্টা আক্রমণ শুরু করেছে। তাতে ইসরাইলের যথেষ্ট ক্ষতি হয়েছে। পাল্টা হামলা ছাড়া ইরানের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই।

ইসরাইলের এই আক্রমণের স্বল্পমেয়াদি প্রভাব খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। একদিকে এ হামলা ছিল বাস্তবিক অর্থেই যুদ্ধ ঘোষণা করার শামিল, অন্যদিকে আলোচনার টেবিলে ইরানের অবস্থান এখন খুবই দুর্বল। কারণ আক্রমণের ফলে ইরানের অধিকাংশ পরমাণু উপকরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে, দীর্ঘ মেয়াদে হয়তো ইরানের পরমাণু কর্মসূচিতে খুব একটা প্রভাব পড়বে না। কারণ ইরান তার পূর্ব অভিজ্ঞতা দিয়ে আবার পরমাণু কর্মসূচি এগিয়ে নিতে পারবে।

গত এপ্রিলে নেতানিয়াহু যখন ওভাল অফিসে গিয়েছিলেন, তখন নেতানিয়াহুকে অবাক করে দিয়ে ট্রাম্প ইরানের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। আর নেতানিয়াহুকেও কোনো ধরনের সামরিক পদক্ষেপ নিতে নিষেধ করেছিলেন, যাতে কূটনৈতিক উপায়ে সমস্যা সমাধানের পথ খোলা থাকে। কিন্তু নেতানিয়াহু যখন সাবেক মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা মাইক ওয়াল্টজের সঙ্গে গোপনে যোগাযোগ করেন, তখন ট্রাম্প অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কারণ গত মে মাসের ১ তারিখেই ট্রাম্প এই উপদেষ্টাকে পদচ্যুত করেছিলেন।

তবে, পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, ট্রাম্প এবং নেতানিয়াহু তাদের সম্পর্ক অন্তরালে হলেও ঠিক করে নিয়েছেন। আর যতক্ষণ পর্যন্ত ইসরাইল আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে নাক গলাচ্ছে না, ততক্ষণ ট্রাম্পের কোনো সমস্যা নেই। ট্রাম্প চায় আমেরিকার পররাষ্ট্র নীতি যদি ইসরাইলের বিপক্ষেও যায়, তাহলেও যেন ইসরাইল নাক গলাতে না আসে। এতটুকু নিশ্চিত করলে ইসরাইল ইরানের সঙ্গে কী করল না করল তাতে ওয়াশিংটনের তেমন কিছু যায় আসে না।

প্রত্যেক ত্রিমাত্রিক সম্পর্কেই (লাভ ট্রায়াঙ্গেল) জটিলতার ‍সৃষ্টি হয়, যখন কোনো একটি পক্ষ অন্যপক্ষ থেকে তার কাঙ্ক্ষিত জিনিসটি না পায়। এখন মনে হচ্ছে, আমেরিকা ও ইসরাইল নরমে-গরমে ইরানের সঙ্গে বেশ ভালোই চালিয়ে নিচ্ছে।

বর্তমান পরিস্থিতিতে ইরানের জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়া বেশ কঠিন। ইরানকে প্রথমে এই হামলার ধাক্কা সামলে উঠতে হবে। তারপর ভাবতে হবে কতটুকু পাল্টা হামলা করলে তার মুখরক্ষা হয়। এ অবস্থায় পরমাণু চুক্তি করলে তা আত্মসমর্পণ বলে গণ্য হবে কি না, তাও মাথায় রাখতে হবে। সর্বোপরি এই সংঘাত চলমান আঞ্চলিক যুদ্ধের একটা অংশমাত্র, কিন্তু এই ঘটনা রাষ্ট্র হিসেবে ইরানের ভেতরে অনেক পরিবর্তন এনে দিতে পারে।

দ্য নিউ আরব থেকে ভাষান্তর : এইচ এম নাজমুল হুদা

সূত্র, আমার দেশ