ইদানীং আর ক্ষোভ হয় না। রাগও হয় না। বিরক্ত লাগে। সংবাদপত্র খুললে কিংবা টিভি টকশোতে বড় রাজনৈতিক দলের কর্তাদের বক্তব্য, ভাবসাব দেখলে মনে হয়, এ দেশে পতিত স্বৈরাচারের দেড় দশকের শাসনামলে তারা খুব সুখে শান্তিতে ছিলেন। তারা যে মজলুম ছিলেন, নিপীড়িত ছিলেন, সেসব যেন ভুলে গেছেন।

মনে হচ্ছে দেশে যত সমস্যা আছে, সব সমস্যা যেন পাঁচ আগস্টের পর থেকেই শুরু। আর এসব সমস্যার জন্য দায়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার।

রাজনীতিবিদরা ভুলেই গেছেন যে, একটি ফ্যাসিবাদী শাসকগোষ্ঠী গত ১৭ বছর জগদ্দল পাথর হয়ে এ দেশের মানুষের বুকের ওপর চেপে বসেছিল। নাকি তারা ইচ্ছে করে জনসাধারণকে সেটি ভুলিয়ে রাখতে চাইছেন!

প্রফেসর ইউনূসের উপদেষ্টা পরিষদ যে একটা সর্বাত্মক ‘গণ-অভ্যুত্থানের সরকার’, আট মাস পরে এসে রাজনীতিবিদরা তা থেকে সরে এসে এটাকে ‘অনির্বাচিত সরকার’ বলে বয়ান দিয়ে যাচ্ছেন।

প্রফেসর ইউনূসের সংস্কার কার্যক্রম কতটুকু সফল হবে জানি না। কিন্তু তিনি ব্যর্থ হলে সেটির একক দায় কেবল তাকে বা তার সরকারের ওপর দেয়া মোটেই যথার্থ হবে না। বরং এর বেশির ভাগ দায় রাজনীতিবিদদেরই নিতে হবে, যারা ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পাগলপ্রায় হয়ে পড়েছেন। বারবার ভোটের তাগাদা দিয়ে মসনদে উঠে পড়তে চাইছেন।

রাষ্ট্র মেরামত বা সংস্কার কার্যক্রম সফলতার কাছাকাছি কিংবা বেশিদূর গেলেও রাজনীতিবিদদের সদিচ্ছা না থাকলে তা টেকসই হবে না। টেকসই সংস্কার ও রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের জন্য অবশ্যই রাজনৈতিক দলগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে এবং ইতিবাচক মনোভাব দেখাতে হবে। রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন না এলে প্রশাসন জনবান্ধব হবে না এবং প্রত্যাশিত সংস্কার আশা করা যাবে না। আর আমরা অতীতে দেখেছি, প্রশাসনে যখন জবাবদিহি থাকে না, তখনই রাজনীতিতে ফ্যাসিজমের জন্ম হয়। ফলে একটা দল টানা ১৬ বছর হত্যা, খুন, গুমের মধ্য দিয়ে শাসন করে যায়, আর বিরোধীরা সেসব নিপীড়ন-নিষ্পেষণের শিকার হয়। যে দেশে এখনো কোনো দুষ্কৃতকারী ও চাঁদাবাজ গ্রেফতার করলে মাঝরাস্তায় পুলিশের ওপর হামলা হয়, থানা ঘেরাও করে তাদের ছিনিয়ে নেয়া হয়, সে দেশে এখনই নির্বাচন ঘোষণা করলে তা কতটুকু প্রভাবমুক্ত, শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে তা বলার অবকাশ রাখে না।

বিএনপির কিছু বুদ্ধিজীবী ও দলের কিছু লোক এখনই বলতে শুরু করেছেন, যারা প্রফেসর ইউনূসকে ডিফেন্ড করছেন তাদের গলায় নাকি ‘হাসিনার সুর খুঁজে পাচ্ছেন’। ক্ষমতার মোহে কতটুকু অন্ধ আর বিবেকহারা হলে দেড় সহস্রাধিক মানুষ হত্যায় অভিযুক্ত এক ফ্যাসিস্ট শাসকের সাথে দেশের বড় দুঃসময়ের ত্রাণকর্তা ইউনূসকে তুলনা করা যায়, তা বলা বাহুল্য।

আবার শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদদের কেউ এমনও দম্ভোক্তি করেছেন, ‘যতই সংস্কার করুক আমরা ক্ষমতায় এলে তা বাতিল করে দেবো’। এরা কি কেউ ভাবছেন না, এসব দম্ভোক্তি মানুষকে হতাশ করছে, বিরক্ত করছে। তারা কি চিন্তা করছেন না, ভোটের সময় জনগণের কাছেই তাদের যেতে হবে? তারা কি অতীত এত সহজেই ভুলে গেলেন যে ১৬ বছর ধরে আন্দোলনের পর বিতাড়িত যে ফ্যাসিবাদ, সেটি যদি সংস্কার ঠিকঠাক না হওয়ার কারণে আবার চেপে বসার সুযোগ পায়, তাদের অবস্থান কোথায় দাঁড়াবে?

তাদের এসব দম্ভের কথাবার্তা গত ১৬ বছরের নিপীড়িত ও জনপ্রিয়তার শীর্ষস্থানে থাকা বিএনপির মতো একটা দলের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন করছে। বিপরীতে প্রফেসর ইউনূসের সরকারের প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা বাড়ছে। এরই ধারাবাহিকতায় অনেকে বলছেন, ‘এতদিন স্বৈরাচারী সরকার হটানোর জন্য আন্দোলন করেছি। এবার না হয় অন্তর্বর্তী সরকারকে রক্ষার জন্য আন্দোলন করব।’ এমনকি ঈদের আগে একটা আওয়াজ উঠেছিল, ‘ড. ইউনূসকে পাঁচ বছরের জন্য ক্ষমতায় চাই।’

যদিও এসব কথা প্রফেসর ইউনূসকে রাজনৈতিক বিতর্কে ফেলে দিতে পারে। যেহেতু রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক উপায়ে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদ পাঁচ বছর। সেহেতু, একই মেয়াদে তাকে এভাবে থাকতে রাজনৈতিক দলগুলো দেবে না। এ ক্ষেত্রে গণভোট বা সাংবিধানিক কোনো পন্থা ঠিক করা গেলে সেটিই হতো কল্যাণকর।

তবু বিতর্কের বাইরে থেকে মানুষ মনে করে, হাজার শহীদের রক্ত আর গণ-অভ্যুত্থানের মধ্যে দিয়ে আসা এই অন্তর্বর্তী সরকারকে রাষ্ট্র পরিচালনায় যৌক্তিক সময় (যার সর্বোচ্চ মেয়াদ চার বছর) দেয়া যেতে পারে। তাহলে নির্বাচিত সরকার ও গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আসা এই অন্তর্বর্তী সরকারের ‘ক্ষমতার মেয়াদে’ একটা দৃশ্যমান পার্থক্য দেখা যাবে।

তবে এটা মনে রাখতে হবে যে, যারা এই সরকারকে নানামুখী চাপে রেখে, অসহযোগিতা করে এবং বেকায়দায় ফেলে নির্বাচন আদায় করতে চায়, ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে তাদের অবস্থানও সুদৃঢ় হবে না। পতিত ফ্যাসিবাদেরও আগের সময়ে দেশের মানুষ দেখেছে, বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলনের চাপে সরকারগুলো কেমন নড়বড়ে অবস্থায় মেয়াদ পার করেছে। ভবিষ্যতে এমন আন্দোলনের মুখে যদি জনগণ পাশে না থাকে, তারা কিভাবে সরকার চালাবে, সেটি সময়ই বলে দেবে।

জুলাইয়ের স্পিরিট ধারণ না করে, হাজারো হত্যাকাণ্ডের বিচার না চেয়ে শুধু অন্তর্বর্তী সরকারের সমালোচনা করে ও নির্বাচনী রোডম্যাপের জন্য সরকারের ওপর চাপ তৈরি করে মানুষের আকাক্সক্ষা অবদমিত করা হচ্ছে। যার ফলে এ সুযোগে পতিত স্বৈরাচারের দোসররা রাস্তায় নামার দুঃসাহস দেখাচ্ছে। যারা এখনই জুলাই আন্দোলনের মূল্যায়ন করতে পারছেন না, তাদের কাছে আগামীর বাংলাদেশ কতটা নিরাপদ থাকবে সেই প্রশ্ন থেকে যায়।

লেখক : পর্যবেক্ষক

সূত্র, নয়া দিগন্ত