দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদী শাসন ও রাজনৈতিক দমন-পীড়নের পর অবশেষে বাংলাদেশের মানুষ একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচনের স্বপ্ন দেখছে। স্বৈরশাসনের পতনের মাধ্যমে জাতির হৃদয়ে নতুন করে আশার সঞ্চার হয়েছে—গণতন্ত্র, ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিমূলক শাসনের প্রত্যাশা জেগে উঠেছে। কিন্তু এই প্রত্যাশা বাস্তবায়নের পথে এখনো রয়েছে বহু চ্যালেঞ্জ—বিশেষ করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, নির্বাচনি স্বচ্ছতা ও প্রশাসনিক নিরপেক্ষতা নিয়ে। এই সংকটগুলোর দ্রুত সমাধান না হলে একটি নিরাপদ নির্বাচনি পরিবেশ সৃষ্টি করা অসম্ভব।

বর্তমানে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হলো পুলিশ বাহিনীর দুর্বলতা ও অকার্যকারিতা। শেখ হাসিনার ফ্যাসিবাদী শাসনামলে পুলিশ দলীয় স্বার্থে ব্যবহৃত হয়েছে। তারা জনগণের ওপর নিপীড়ন চালিয়েছে, বিরোধী কণ্ঠ রোধ করেছে এবং জুলুমের হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। ফলে জনগণের মধ্যে পুলিশকে ঘিরে রয়েছে ক্ষোভ, সন্দেহ ও অনাস্থা। শেখ হাসিনার পতনের পর বহু থানা লুট হয়েছে, পুলিশের সদস্যরা নিহত হয়েছে, অনেকে পালিয়ে গেছে বা বরখাস্ত হয়েছে। এখন যা অবশিষ্ট আছে, তা দিয়ে কোনোভাবেই একটি জাতীয় নির্বাচন পরিচালনা করা সম্ভব নয়। নির্বাচন পরিচালনায় কমপক্ষে অতিরিক্ত ৫০ হাজার পুলিশের প্রয়োজন—সেনাবাহিনীর পাশাপাশি। নির্বাচন সামনে রেখে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে সুসংহত করা এখন একটি অবিলম্বে করণীয় জাতীয় অগ্রাধিকার। হাতে আছে মাত্র ছয়-সাত মাস। এই সময়ের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য, নিরাপদ ও অংশগ্রহণমূলক জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের জন্য উপযুক্তসংখ্যক ও দক্ষ পুলিশ সদস্যের ঘাটতি পূরণ করা একান্ত আবশ্যক।

বর্তমানে বাহিনীতে যে বিপর্যয় ও সংকট বিরাজ করছে, তাতে বিদ্যমান সদস্যদের দিয়ে নির্বাচন পরিচালনার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। তাই একটি জরুরি ও পরিকল্পিত পুলিশ নিয়োগ প্রক্রিয়া অবিলম্বে শুরু করা প্রয়োজন। একজন নতুন পুলিশ কনস্টেবলকে আধুনিক মডিউলভিত্তিক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তিন মাসেই নির্বাচনি দায়িত্ব পালনে প্রস্তুত করা সম্ভব। দেশে হাজার হাজার শিক্ষিত, সুস্বাস্থ্যসম্পন্ন ও বেকার যুবক রয়েছে, যারা দেশপ্রেম নিয়ে এই দায়িত্ব নিতে প্রস্তুত। একটি স্বচ্ছ ও দ্রুত নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু করে তাদের মধ্য থেকে নির্বাচনকেন্দ্রিক প্রশিক্ষিত বাহিনী গড়ে তোলা সম্ভব।

এছাড়া দেশের আনুমানিক ৬০ হাজার অবসরপ্রাপ্ত সেনাসদস্য রয়েছেন, যারা অভিজ্ঞ, দেশপ্রেমিক ও শৃঙ্খলাপূর্ণ। তাদের দুই বছরের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে দু-তিন সপ্তাহের সংক্ষিপ্ত ওরিয়েন্টেশন প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে সম্পৃক্ত করা যেতে পারে। এতে একদিকে যেমন সময় ও সম্পদের সাশ্রয় হবে, অন্যদিকে একটি নির্ভরযোগ্য ও চৌকস বাহিনী নির্বাচন ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করবে। বর্তমানে পুলিশ বাহিনীতে বহু সদস্য কম গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক কিংবা দাপ্তরিক দায়িত্বে (যেমন গাড়িচালক, দেহরক্ষী, গেটম্যান বা ক্লারিকাল স্টাফ) নিয়োজিত রয়েছেন। এই সদস্যদের একটি অংশকে নির্বাচনি নিরাপত্তা কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত, কারণ নির্বাচন কেবল রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, এটি একটি জাতীয় নিরাপত্তা-সংক্রান্ত গুরুতর দায়িত্ব।

সমন্বিতভাবে এই তিনটি উদ্যোগ—১. নতুন নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ, ২. অবসরপ্রাপ্ত সেনাদের পুনর্নিয়োগ এবং ৩. বিদ্যমান পুলিশ সদস্যদের পুনর্বিন্যাস—বাংলাদেশে একটি নিরাপদ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচনি পরিবেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচন আয়োজনের জন্য শুধু বাহ্যিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা নয়, বরং ভোট পরিচালনার কেন্দ্রীয় প্রশাসনিক কাঠামোর বিশুদ্ধতা ও নিরপেক্ষতাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

বর্তমানে বাংলাদেশের নির্বাচনি ব্যবস্থায় যে একটি বড় সংকট বিদ্যমান, তা হলো প্রশাসনিক কাঠামোর বিশ্বাসযোগ্যতার অভাব, বিশেষ করে যারা নির্বাচন পরিচালনার সরাসরি দায়িত্বে রয়েছেন। জেলা প্রশাসক (ডিসি), উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), নির্বাহী ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট এবং নির্বাচন কর্মকর্তাদের একটা বড় অংশ এখনো সেই পুরোনো ফ্যাসিস্ট সরকারের আমলে নিযুক্ত, প্রশিক্ষিত ও প্রভাবিত। তাদের মধ্যে অনেকেই এক যুগের বেশি সময় ধরে নির্দ্বিধায় ভোট ডাকাতি, ব্যালট বাক্স রাতেই ভরাট, ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, বিরোধী দলের এজেন্ট বের করে দেয়া, এমনকি গণহারে ভুয়া ভোট গণনার মতো গুরুতর অনিয়মে জড়িত ছিলেন। তারা নিরপেক্ষ প্রশাসনের ধারণাকে নস্যাৎ করে একদলীয় কর্তৃত্ববাদী শাসনকে টিকিয়ে রাখার ‘নীরব সেনা’ হিসেবে কাজ করেছেন।

নির্বাচনের দিন মাঠে সেনাবাহিনী বা অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী উপস্থিত থাকলেও ভোট গণনা, ফলাফল ঘোষণা, ভোটকেন্দ্র ব্যবস্থাপনা—সবই থাকে এই সিভিল প্রশাসনের হাতে। সেনাবাহিনী গার্ডের মতো থাকলেও কার ব্যালট গণনা হচ্ছে, ফলাফল কোথায় পাঠানো হচ্ছে, কার স্বাক্ষরে কি ঘোষণা হচ্ছে—এসবই নির্ধারণ করে সিভিল প্রশাসনের এসব কর্মকর্তা। তাই তারা যদি দলীয় ও দুর্নীতিগ্রস্ত মনোভাব নিয়ে বহাল থাকে, তবে যেকোনো বাহিনীর উপস্থিতি সত্ত্বেও নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হওয়া কঠিন।

এই বাস্তবতা থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে নির্বাচন কমিশনের উচিত হবে অবিলম্বে একটি নিরপেক্ষ কর্মকর্তার তালিকা প্রণয়ন, যেখানে রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা, পেশাদারত্ব ও অতীত ইতিহাস বিবেচনায় নেওয়া হবে। সদ্য অবসরপ্রাপ্ত বা নির্ভরযোগ্য ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করে বিকল্প তালিকা প্রস্তুত করা হবে। নির্বাচনকালে প্রশাসনের পদায়নে সেনাবাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থার মূল্যায়ন এবং পরামর্শ যুক্ত করা হবে।

একটি সুষ্ঠু নির্বাচন কখনোই কেবল বাহিনীর উপস্থিতিতে নয়, বরং প্রশাসনিক কাঠামোর নিরপেক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতায় নির্ভর করে। সুতরাং প্রশাসনিক এই স্তরে আমূল পরিবর্তন ছাড়া জনগণের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা যাবে না। যদিও দেশে সরকার বদল হয়েছে, কিন্তু এই কৌশলগত প্রশাসনিক কাঠামোয় যদি পরিবর্তন না আনা হয়, তাহলে সেই পুরোনো দলদাস কর্মকর্তারাই নতুন সরকারের অধীনে নির্বাচনের নিয়ন্ত্রণ করবে, যা জনগণের আস্থার জন্য মারাত্মক হুমকি। নির্বাচন কমিশনের উচিত অবিলম্বে সব ভোট-সম্পৃক্ত প্রশাসনিক কর্মকর্তাকে পুনর্মূল্যায়ন করা এবং জাতীয় ঐক্য ও নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে নতুন ও সৎ কর্মকর্তাদের নির্বাচনি কাজে নিয়োগ নিশ্চিত করা।

পূর্ববর্তী সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা সশস্ত্র রাজনৈতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো এখনো দেশের জন্য মারাত্মক নিরাপত্তা হুমকি হিসেবে রয়ে গেছে। সরকারের পতনের পর কিছু পুলিশ স্টেশনে হামলা চালিয়ে তারা বিপুল পরিমাণ অস্ত্র, গুলি ও সরঞ্জাম লুট করে নিয়ে গেছে। এদের অনেকেই এখনো আত্মগোপনে রয়েছে এবং কোনো সংঘাতময় পরিস্থিতিকে পুঁজি করে দেশজুড়ে সহিংসতা ছড়ানোর পরিকল্পনা করছে।

এই চক্রগুলোর প্রতি রাজনৈতিক আনুগত্য থাকায় তারা সহজেই গোষ্ঠী বা বহিরাগত শক্তির ইন্ধনে দেশে নৈরাজ্য সৃষ্টি করতে পারে। তাই অবিলম্বে একটি সমন্বিত বিশেষ অভিযান চালানো প্রয়োজন, যার নেতৃত্বে থাকবে গোয়েন্দা সংস্থা, র‍্যাব, সশস্ত্র বাহিনী ও পুলিশ বাহিনী। এই অভিযানের লক্ষ্য হবে—লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধার, পলাতক সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার, অবৈধ অস্ত্রের উৎস চিহ্নিত করা এবং সম্ভাব্য রাজনৈতিক সহিংসতার আগেই তা প্রতিহত করা। এটি শুধু আইন-শৃঙ্খলা নয়, বরং আসন্ন নির্বাচন ও জাতীয় স্থিতিশীলতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ।

নির্বাচনকালে সেনাবাহিনী শুধু সহায়ক শক্তি নয়, বরং জাতীয় নিরাপত্তা ও নিরপেক্ষতার প্রতীক হিসেবে জনগণের আস্থার সর্বোচ্চ স্তম্ভ। সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনীর ভূমিকাকে সীমিত নয়, বরং পূর্ণাঙ্গ ও কার্যকর করতে হবে। শুধু নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই নয়, সেনাবাহিনী গোয়েন্দা তথ্য বিশ্লেষণ, অপারেশনাল পরিকল্পনা, লজিস্টিক সহায়তা এবং সংকটময় এলাকায় তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপ—সব ক্ষেত্রেই দক্ষ ও অভিজ্ঞ হতে হবে। নির্বাচন কমিশনের অধীন থেকে কাজ করলেও সেনাবাহিনীর পেশাদারত্ব ও নিরপেক্ষতা দেশের স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার জন্য অনন্য সহায়ক হতে পারে।

এই নির্বাচন শুধু একটি রাজনৈতিক প্রক্রিয়া নয়, বরং বাংলাদেশের ভবিষ্যতের নির্ধারক মুহূর্ত। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হলে আইন-শৃঙ্খলা, প্রশাসনিক শুদ্ধি এবং জনগণের আস্থা ফেরানো অপরিহার্য। অন্তর্বর্তী সরকারকে এখনই সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আর দেরি নয়। যদি এসব করা না হয়, তবে নির্বাচন ব্যর্থ হবে, জনগণ হতাশ হবে এবং দেশ আবার সংকটে পড়বে। এবার যেন ব্যালট বিজয়ী হয়, বুলেট নয়। আর ইতিহাস যেন সাক্ষ্য দেয়—এই নির্বাচনেই বাংলাদেশের গণতন্ত্র পুনর্জন্ম লাভ করেছে।

লেখক : নিরাপত্তা বিশ্লেষক, গবেষক ও লেখক

সূত্র, আমার দেশ