বর্তমানে কোনো দেশের আকাশ যদি অরক্ষিত থাকে, তবে যেকোনো সময় ভূলুণ্ঠিত হতে পারে সে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব। বিশেষ করে কোনো দেশ যদি সামরিক দিক থেকে দুর্বল হয়, আধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম না থাকে এবং এরকম কোনো দেশের প্রতিবেশী যদি সামরিকভাবে শক্তিশালী ও আগ্রাসী হয়, তাহলে দুর্বল দেশটির স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব সদা হুমকির সম্মুখীন থাকে। সর্বশেষ ইরান-ইসরাইল যুদ্ধ, কাতারে ইসরাইলের হামলাসহ বিভিন্ন ঘটনায় এটি প্রমাণিত।

ইসরাইলের আগ্রাসনে প্রতিদিন ভূলুণ্ঠিত হচ্ছে সিরিয়া আর লেবাননের সার্বভৌমত্ব। সিরিয়া ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো যুদ্ধ ঘোষণা করেনি বা ইসরাইলের বিরুদ্ধে কোনো ধরনের হুমকিও দেয়নি। কিন্তু তারপরও ইসরাইল যখন খুশি সিরিয়ায় বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। সিরিয়া যাতে ভবিষ্যতে ইসরাইলের জন্য নিরাপত্তা হুমকি হয়ে উঠতে না পারে, সেজন্য বাশার আল-আসাদের পতনের পর টানা আট দিন পর্যন্ত ইসরাইল গোটা সিরিয়ায় বিমান হামলা চালিয়ে দেশটির ৯০ শতাংশ সামরিক শক্তি ধ্বংস করে দেয়। দখল করে নেয় সিরিয়ার গুরুত্বপূর্ণ কিছু এলাকা।

কাতারে ইসরাইলের হামলার ঘটনায় এটি প্রতিষ্ঠিত যে, একটি দেশ হতে পারে বিশ্বের সবচেয়ে ধনী, থাকুক সে দেশে যতই বিলিয়ন ডলারের আকাশচুম্বী স্থাপনা, মুহূর্তে তা মাটির সঙ্গে মিশে যেতে পারে যদি সে দেশটি সামরিক দিক থেকে দুর্বল হয় এবং না থাকে উন্নত আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা।

কাতার ছিল একসময় বিশ্বের শীর্ষ ধনী দেশ। ২০২৪ সালেও শীর্ষ ধনী দেশের তালিকায় কাতারের স্থান চতুর্থ। কিন্তু এত বিত্তবৈভব, সুরম্য সব স্থাপনা, মানমর্যাদা—সবই যেন আজ অর্থহীন। কারণ এত ধনী দেশ হয়ে ও সামরিক শক্তিতে দেশটি খুবই দুর্বল। কাতারের সবচেয়ে শক্তিশালী এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম হলো যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি প্যাট্রিয়ট মিসাইল। দেশটির সবচেয়ে শক্তিশালী যুদ্ধবিমান হলো ফ্রান্সের তৈরি রেফালে এবং এর সংখ্যা মাত্র ১৫টি। কাতারের সবচেয়ে শক্তিশালী রণতরী হলো করভেট এবং এর সংখ্যা মাত্র চারটি। কাতারে রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি। কিন্তু ইসরাইলের হামলা থেকে কাতারকে রক্ষায় এ ঘাঁটি থেকে আকাশে ওড়েনি কোনো যুদ্ধবিমান, কোনো মিসাইল।

কাতার ও ইসরাইল উভয়ই ছোট দেশ। ইসরাইলের আয়তন আট হাজার বর্গমাইল এবং কাতারের আয়তন সাড়ে চার হাজার বর্গমাইল। গোটা ইসরাইলের আকাশ তাদের নিজস্ব নির্মিত আয়রন ডোম, ডেভিড সিলিং ও অ্যারো নামক তিন স্তরের মিসাইল সিস্টেমে আচ্ছাদিত; রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি শত শত আধুনিক ফাইটার জেট। ফলে ইরানের ছোড়া হাজারের ওপর মিসাইলের ৯২ শতাংশই ইসরাইল আকাশে প্রতিহত করেছে।

কাতারের আয়তন ইসরাইলের অর্ধেক আর তাদের রয়েছে অগাধ সম্পদ। গত মে মাসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্য সফরের সময় কাতার যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অস্ত্র ক্রয়সহ ১ দশমিক ২ ট্রিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ চুক্তি করেছে। অথচ বিপুল এই অর্থের ক্ষুদ্র অংশও যদি কাতার সামরিক খাতে ব্যয় করে, তবে দেশটি নিজেদের সম্পূর্ণভাবে দুর্ভেদ্য এয়ার ডিফেন্স সিস্টেমের চাদরে ঢেকে রাখতে পারত। কিন্তু অঢেল বিত্ত থাকার পরও কাতারসহ কোনো আরব দেশই সামরিক শক্তিতে নিজেদের শক্তিশালী করেনি। কেবল আমদানির মাধ্যমে তারা যুক্তরাষ্ট্রের অনেক অস্ত্র জমা করেছে। ফলে দুর্ভিক্ষপীড়িত ইয়েমেনের ছোড়া মিসাইলও প্রতিহত করতে পারে না ধনী সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো দেশ।

মিসাইল শক্তির দিক দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ ইরান। কিন্তু দেশটির এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ও আধুনিক যুদ্ধবিমানসহ অনেক দিক থেকে দুর্বলতা আছে। ফলে ইসরাইল ২০০ যুদ্ধবিমান নিয়ে ইরানের ১০০টির বেশি লক্ষ্যবস্তুর ওপর হামলা চালিয়ে নিরাপদে ফিরে গেছে জুন মাসের যুদ্ধে। একটি বিমানও ভূপাতিত করতে পারেনি ইরান। একইভাবে ইরানের গভীরে প্রবেশ করে যুক্তরাষ্ট্রের বি-২ স্পিরিট নামক এক ডজন কৌশলত বোমারু বিমান পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা করে নিরাপদে ফিরে গেছে। অথচ ইসরাইলের আকাশসীমায় প্রবেশ করে কোনো আরব দেশের এ ধরনের হামলা পরিচালনা করা কল্পনারও বাইরে। ইরানের যদি শক্তিশালী এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম ও আধুনিক যুদ্ধবিমান থাকত, তবে কখনোই ইসরাইল ও যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধবিমান এভাবে ইরানের আকাশে প্রবেশ করার সাহস পেত না।

আধুনিক যুদ্ধবিমান কীভাবে একটি দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বকে সুরক্ষা দেয়, তার উজ্জ্বল উদাহরণ মে মাসের ভারত-পাকিস্তান সংঘাত। চীনের তৈরি জে-১০সি যুদ্ধবিমানের সাহায্যে মাত্র পাঁচ ঘণ্টায় ভারতকে সম্পূর্ণরূপে ধরাশায়ী করে পাকিস্তান।

নিরাপত্তা ঝুঁকির দিক দিয়ে বর্তমানে বাংলাদেশ ও সিরিয়ার অবস্থা প্রায় এক। বাংলাদেশ ও সিরিয়া উভয় দেশ ২০২৪ সালে নতুন করে স্বাধীনতা লাভ করে। তুরস্কসহ বিভিন্ন আরব দেশ সিরিয়াকে নতুন করে দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু ভবিষ্যতে সামরিক ও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে একটি শক্তিশালী সিরিয়াকে ইসরাইল হুমকি হিসেবে মনে করে। ১৯৪৮ সালে ইসরাইল রাষ্ট্র জন্মের পর সিরিয়া আর মিসর মিলে বারবার ইসরাইল রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। এসব যুদ্ধে যদি যুক্তরাষ্ট্র ইসরাইলকে রক্ষায় এগিয়ে না আসত তাহলে আজ ইসরাইল রাষ্ট্র বলতে কিছু থাকত না। তাই ইসরাইল কখনোই চায় না সিরিয়া আবার নতুন করে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। সেজন্য ইসরাইল নিয়মিতভাবে বিমান হামলা চালিয়ে যাচ্ছে সিরিয়ায়।

সিরিয়াকে যেমন ইসরাইল তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি হিসেবে মনে করে, বাংলাদেশকেও ভারত তার নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি হিসেবে মনে করে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর স্পষ্ট করে বলেছেন, বাংলাদেশের অস্তিত্ব ভারতের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।

সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী বাংলাদেশকে ভারত তার অখণ্ডতার প্রতি বড় ধরনের হুমকি হিসেবে মনে করে। নয়াদিল্লি মনে করে তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে বাংলাদেশ যদি চীন, পাকিস্তানসহ অন্যান্য দেশের সঙ্গে প্রতিরক্ষা সম্পর্ক গড়ে তোলে, তাহলে সেভেন সিস্টার্স বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে পারে। সে কারণে জন্মের পর থেকেই ভারত চেয়েছে বাংলাদেশকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখতে, যার পূর্ণ রূপ আমরা দেখেছি টানা সাড়ে ১৫ বছর মাফিয়া শাসক শেখ হাসিনার শাসনামলে।

চব্বিশের বিপ্লবের পর বাংলাদেশে ভারতের সর্বগ্রাসী এ নিয়ন্ত্রণ নস্যাৎ হয়ে যায়। পররাষ্ট্রনীতির ক্ষেত্রে ভারতের নিয়ন্ত্রণমুক্ত বাংলাদেশ স্বাধীনভাবে চীন, পাকিস্তান, তুরস্কসহ বিভিন্ন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে অগ্রসর হতে থাকে। এ অবস্থায় দিশাহারা হয়ে পড়ে ভারত। ভারতের উগ্র অনেক রাজনীতিবিদদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে আগ্রাসন চালানোর হুমকি দেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ ত্রিপুরার টিপরা মোথা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা, বিজেপি-ঘনিষ্ঠ নেতা বিক্রম মাণিক্য দেববর্মা চট্টগ্রাম দখলের দাবি জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সেভেন সিস্টার্সকে অর্থনৈতিকভাবে টিকিয়ে রাখতে হলে চট্টগ্রাম বন্দর তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এমনকি চট্টগ্রাম দখল অথবা বাংলাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে পূর্ব তিমুরের মতো আলাদা একটি দেশ প্রতিষ্ঠারও আহ্বান জানিয়েছেন দেববর্মা।

ভারতের প্রতি একান্ত অনুগত নয় বাংলাদেশে এমন যেকোনো সরকারকেও ভারত তার নিরাপত্তার জন্য হুমকি মনে করে। তাই বাংলাদেশে এ ধরনের সরকার উৎখাত করাকেও বৈধ মনে করেন ভারতের কোনো কোনো কূটনীতিক ও নীতিনির্ধারক। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলা সম্প্রতি নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশবিষয়ক একটি সেমিনারে এ ধরনের কথা বলেছেন।

স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের প্রতি ভারতের যে নীতি তার মাধ্যমে ভারত নিজেই নিজেদের বাংলাদেশের ঘোরতর শত্রু রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। নয়াদিল্লি প্রমাণ করেছে তারা বাংলাদেশের অস্তিত্বের দুশমন। তাই বাংলাদেশের উচিত এ ধরনের স্বঘোষিত শত্রুর আগ্রাসন থেকে রক্ষায় সর্বোচ্চ উপায়ে প্রস্তুত থাকা।

সম্প্রতি বাংলাদেশ চীন, পাকিস্তান ও তুরস্ক থেকে শক্তিশালী যুদ্ধবিমানসহ আধুনিক সমরাস্ত্র সংগ্রহের উদ্যোগ গ্রহণের পর দেশের মধ্যে আবার সক্রিয় হয়ে ওঠে ভারতীয় এজেন্টরা। তারা সরকারের নীতিনির্ধারকদের ভয় দেখাতে শুরু করে যে, বাংলাদেশ চীন, পাকিস্তান থেকে আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র সংগ্রহ করলে ভারত তার নিরাপত্তার অজুহাতে বাংলাদেশে হামলা চালাতে পারে। ফলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করার এক বছর পার হয়ে গেলেও চীন থেকে জে-১০সি ও পাকিস্তান থেকে জেএফ-১৭ ফাইটার জেট কেনার আলোচনায় এখনো দৃশ্যমান কোনো অগ্রগতি নেই।

বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে ৫৪ বছর হয়েছে, কিন্তু দেশটির সামরিক শক্তি বলতে সৈন্যসংখ্যা ছাড়া উল্লেখ করার মতো কোনো আধুনিক সমরাস্ত্র নেই। সম্পূর্ণভাবে অরক্ষিত বাংলাদেশের আকাশ। শত্রুর ছোড়া কোনো মিসাইল বা যুদ্ধবিমান প্রতিরোধ করার সাধ্য নেই বাংলাদেশের। রাশিয়ার মিগ-২৯ এবং চীনা যেসব যুদ্ধবিমান বর্তমানে বাংলাদেশে রয়েছে, তা শত্রুর আধুনিক যুদ্ধবিমান ও মিসাইলের কাছে সম্পূর্ণভাবে অকার্যকর।

অতীতের সরকারগুলো বাংলাদেশকে সামরিকভাবে শক্তিশালী করার কার্যকর উদ্যোগ নেয়নি। নিজেরা কোনো শক্তিশালী অস্ত্র নির্মাণের পদক্ষেপ নেয়নি এবং বিদেশ থেকেও আধুনিক সমরাস্ত্র সংগ্রহ করা হয়নি। যখনই কোনো সরকার সামরিক বাহিনী আধুনিকায়ন বা আধুনিক যুদ্ধবিমানসহ শক্তিশালী অস্ত্র সংগ্রহ করতে চেয়েছে, তখনই ভারতের পক্ষ থেকে প্রবল বাধার কারণে তা থেমে গেছে। গদি হারানোর ভয়ে অনেকে ভারতকে অসন্তুষ্ট করে শক্তিশালী অস্ত্র সংগ্রহে উদ্যোগী হয়নি। আর গত দেড় দশক দেশকে আধুনিকায়ন তো দূরের কথা, বরং ভারতের নীলনকশা অনুসারে পঙ্গু করে দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশের সেনাবাহিনীকে।

বাংলাদেশকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভারত এখনো মরিয়া হয়ে সর্ব উপায়ে চেষ্টা করে যাচ্ছে। ভারতের পাশাপাশি মিয়ানমারও এখন বাংলাদেশের নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যেকোনো আগ্রাসন মোকাবিলায় অবিলম্বে বাংলাদেশের চারটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য—এক. জরুরি ভিত্তিতে চীন থেকে উপযুক্ত সংখ্যক জে-১০সি যুদ্ধবিমান সংগ্রহ করা। দুই. আধুনিক এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম সংগ্রহ। তিন. সৌদি-পাকিস্তান আদলে পাকিস্তান ও চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের নিরাপত্তা চুক্তি করা। চার. এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, মিসাইল, যুদ্ধবিমান, ড্রোন বিমানসহ আধুনিক সমরাস্ত্র তৈরি শুরু করা।

লেখক : সহকারী সম্পাদক, আমার দেশ

সূত্র, আমার দেশ