পৃথিবী আজ এক ভয়াবহ জলবায়ু সংকটের মুখোমুখি। মানুষের বেপরোয়া আচরণই এই অবস্থার জন্য দায়ী বলে বিজ্ঞানীদের অভিমত। পরিবেশদূষণ, বন উজাড়, জীবাশ্ম জ্বালানির লাগামহীন ব্যবহার ও শিল্পবিপ্লব-পরবর্তী নগরায়ণের ফলে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি হয়ে চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে আজ।

গবেষণা বলছে, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা শিল্পপূর্ব সময়ের চেয়ে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। আর সেটি হবে মানবসভ্যতার অস্তিত্বের জন্য মারাত্মক হুমকি। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার (ডব্লিউএমও) সর্বশেষ প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২৫ থেকে ২০২৯ সালের মধ্যে যেকোনো সময় বৈশ্বিক তাপমাত্রার রেকর্ড ভাঙার আশঙ্কা রয়েছে। অর্থাৎ আমরা এমন এক সময়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি, যেখানে আবহাওয়ার বিরূপ আচরণ, ভয়াবহ খরা, বন্যা ও বনে দাবানলের মতো দুর্যোগ নিয়মিতভাবে হতে পারে। বিজ্ঞানীরা আরো পূর্বাভাস দিয়েছেন, ২০৩০ সালের আগেই এমন একটি বছর আসতে পারে, যখন গড় বৈশ্বিক তাপমাত্রা শিল্প-পূর্ব সময়ের তুলনায় দুই ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি হতে পারে। যদিও এমনটি হওয়ার আশঙ্কা খুবই কম, তবুও বিষয়টি একেবারে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।

এখন সবচেয়ে উদ্বেগজনক দিক হলো প্যারিস চুক্তির লক্ষ্য ভঙ্গের আশঙ্কা। এই চুক্তিতে বৈশ্বিক উষ্ণতা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস সীমার মধ্যে রাখার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে এই সীমা গত পাঁচ বছরের গড় অতিক্রম করার আশঙ্কা ৭০ শতাংশ, আর এক বছরে তা অতিক্রমের আশঙ্কা রয়েছে ৮৬ শতাংশ, যা ২০২০ সালে ছিল মাত্র ৪০ শতাংশ। উইসকনসিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আন্দ্রেয়া ডাটন বলেন, ‘১ দশমিক ৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা বৃদ্ধি মানেই কয়েক মিটার সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধি—এটা সময়ের ব্যাপার মাত্র।’ বিশেষ কিছু অঞ্চলে এই পরিবর্তনের প্রভাব আরো তীব্রতর হবে।

আর্কটিক অঞ্চলে শীতকালে তাপমাত্রা বাড়বে বৈশ্বিক গড়ের চেয়ে ৩ দশমিক ৫ গুণ বেশি, বরফ গলে গিয়ে প্রতিফলন হার কমে যাওয়ায় তাপমাত্রা আরো বাড়বে। আমাজন বন ক্রমাগতভাবে ভয়াবহ খরার কবলে পড়বে এবং এর ফলে জীববৈচিত্র্যও হুমকির সম্মুখীন হবে। দক্ষিণ এশিয়া ও উত্তর ইউরোপে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বহুগুণ বেড়ে যেতে পারে। এর ফলে বন্যার ঝুঁকি বেড়ে যাবে। ২০২৫ সাল ইতোমধ্যে রেকর্ড করা উষ্ণতম তিন বছরের মধ্যে একটি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে (যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া অফিস)।

২০২৩ ও ২০২৪ সাল ছিল গত ১৭৫ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ বছর। গত শতকের নব্বইয়ের দশক থেকে আজ পর্যন্ত বরফ গলার হার চারগুণ বেড়েছে। বর্তমানে প্রায় ২৩ কোটি মানুষ সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র এক মিটার উচ্চতায় বসবাস করছে এবং ১০ মিটারের মধ্যে বসবাস করছে ১০০ কোটিরও বেশি মানুষ। এ অবস্থায় মাত্র ২০ সেন্টিমিটার সমুদ্রপৃষ্ঠ বৃদ্ধি পেলে বিশ্বের ১৩৬টি প্রধান উপকূলীয় শহরে প্রতিবছর এক ট্রিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থনৈতিক ক্ষতি হতে পারে।

যুক্তরাজ্যের ফেনস ও হাম্বারসাইডের মতো এলাকাগুলো সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বৃদ্ধি পেলেই পানির নিচে ডুবে যাবে। পাশাপাশি বরফযুগ-পরবর্তী সময়ে প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সামান্য উষ্ণতা বৃদ্ধি পেলেই বরফ গলার হার ১০ গুণ বেড়ে যেতে পারে, ঠিক যেমনটি হয়েছিল ১৫ হাজার বছর আগে। যদি গ্রিনহাউস গ্যাস নিঃসরণ যথাযথভাবে হ্রাস না করা হয়, তবে এই শতকের মধ্যেই তাপমাত্রা ২ দশমিক ৫ থেকে ২ দশমিক ৯ ডিগ্রি পর্যন্ত বেড়ে যেতে পারে, যা গ্রিনল্যান্ড ও পশ্চিম অ্যান্টার্কটিকার বরফচাদর গলা ‘টিপিং পয়েন্ট’ অতিক্রম করবে এবং ১২ মিটার পর্যন্ত সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করবে (স্টোকস ও অন্যান্য, ২০২৪)। এটি শুধু উপকূলীয় শহর নয়, বরং সমগ্র জাতি ও জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বকেই হুমকির মুখে ফেলবে।

বেলিজের জলবায়ু আলোচক কার্লোস ফুলার বলেন, এ ধরনের গবেষণা থেকে তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সীমা বজায় রাখা কতটা জরুরি তা বোঝা যায়। ভবিষ্যতে নিচু তাপমাত্রায় ফিরে যাওয়া এবং আমাদের উপকূলীয় শহরগুলোকে রক্ষার প্রতি গুরুত্ব দেন তিনি। বিজ্ঞানীদের মতে, যথাযথ পদক্ষেপ নিলে এখনো ১ দশমিক ৫ ডিগ্রির লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব। এজন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করতে হবে। সৌর, বায়ু, জলবিদ্যুৎসহ নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। বন সংরক্ষণ করতে হবে এবং প্রচুর বৃক্ষরোপণ করতে হবে। বিশেষ করে রেইনফরেস্ট ও ম্যানগ্রোভ অঞ্চলে বৃক্ষ রোপণ বাড়াতে হবে। কার্বন ক্যাপচার, ক্লিন টেকনোলজি প্রভৃতির মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব শিল্পনীতি গ্রহণ করতে হবে। সর্বোপরি জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। নাগরিকদের পরিবেশ-সচেতন জীবনে অভ্যস্ত করে তুলতে হবে। আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও অর্থায়নের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভিযোজনের জন্য জলবায়ু তহবিল নিশ্চিত করতে হবে।

বৈশ্বিক উষ্ণতা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি কেবল একটি পরিবেশগত ইস্যু নয়, এটি মানবসভ্যতার অস্তিত্বের জন্য সরাসরি হুমকি। প্রতিদিনের উষ্ণতা, দুর্যোগ ও জলবায়ুবৈচিত্র্য আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছে—সময় খুব কম। এই দুরবস্থা শুধু বর্তমান প্রজন্মের জন্যই হুমকি নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মেরও অস্তিত্বের প্রশ্নও এর সঙ্গে সম্পৃক্ত। তাই রাষ্ট্র, শিল্প খাত ও নাগরিক—সবাইকে একসঙ্গে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আমাদের রেখে যাওয়া পৃথিবী হবে দুর্যোগপূর্ণ ও অনিরাপদ।

লেখক : কবি ও সাংবাদিক

সূত্র, আমার দেশ