বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলকে (বিএনপি) ‘কোনো অবস্থাতেই ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হবে না’—এমন ঘোষণা শুনি ২০১৩ সালে রিপোর্টিংয়ের এক আড্ডায় জনৈক আওয়ামী উপকারভোগী সহকর্মীর মুখে। তাদের নির্ধারিত সময়কাল পরবর্তী ১০ বছর বা সংসদীয় সরকারের দুই মেয়াদ, যার মানে দাঁড়ায় দুটি জোচ্চুরির নির্বাচন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে শেখ হাসিনার ক্ষমতা আঁকড়ে থাকা।
এদেশের জনগণ বিএনপিকে ভোট দিতে চাইলেও তা করতে না দেওয়ার প্রতিজ্ঞা যে গণতন্ত্রবিরোধী, তা ফ্যাসিবাদী প্রধানমন্ত্রী হাসিনার দল আওয়ামী লীগের কেউ ভুলেও স্বীকার করেননি।
ইতিহাসের কী আশ্চর্য ন্যায়বিচার! ‘হাসিনা আ্যন্ড কোম্পানি’র চূড়ান্ত পতন হয় গণমানুষের বিপ্লবের তোড়ে, কোনো ক্যু কিংবা বিদেশি হস্তক্ষেপে নয়।
সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে ভীত হাসিনা কৌশল হিসেবে বেছে নেন ভোটাধিকার হরণের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত। পরিণতিতে গণরোষে চব্বিশের ৫ আগস্ট মুহূর্তে হাওয়া হয়ে যায় আওয়ামী লীগ। হত্যাকাণ্ড, গুম, অত্যাচার, জুলুমসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ ও দুর্নীতির বিচারের ভয়ে পলাতক আওয়ামী গোষ্ঠী।
তারাই এখন নির্বাচনি রাজনীতিতে ফিরতে চায় কোন অধিকারে? গণতন্ত্র না মানা কোনো দল গণতান্ত্রিক দেশে রাজনীতি করতে পারবে এবং পরে আবার ভিন্ন মতাবলম্বীদের খতম করবে—সেরকম রাজনৈতিক বন্দোবস্ত যেকোনো সভ্য সমাজের জন্যই তো বিপজ্জনক।
শেখ হাসিনা ও নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা সামাজিক মাধ্যমে কেবল প্রতিশোধ ও সহিংসতার হুমকি দিয়ে চলেছেন। তারপরও তাদের দেশীয় সুশীল পৃষ্ঠপোষক এবং বিদেশি প্রভুরা ফ্যাসিবাদী দলটির শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তনের পক্ষে ওকালতি করছেন কোন যুক্তিতে, তা বোধগম্য নয়।
‘মানুষকে ভোট দেওয়ার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করলেও আওয়ামী লীগ দেশবাসীকে এত কিছু দেবে যে দলটির জনপ্রিয়তা বেড়ে যাবে’—২০১৩ সালে এমন দাবিই করেছিলেন বর্তমানে প্রবাসী ও অবসরপ্রাপ্ত ওই সাংবাদিক। সেটা ছিল উন্নয়নের নামে বাংলাদেশকে গণতন্ত্রহীন করার আওয়ামী বয়ানের অংশ।
২০১৪ সালে বিনা ভোটে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন (১৫৪) জেতা এবং ২০১৮ সালে নৈশকালীন নির্বাচন সম্পন্ন করে ২০২৪ সালে ডামি ভোটাভুটির বোনাসও পেয়ে যান হাসিনা ও তার লোকেরা।
আমৃত্যু ক্ষমতায় থাকতে চাওয়া বাকশাল নেতা শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনারও আজীবন ক্ষমতালিপ্সার প্রমাণ মেলে আগেও। ২০০১ সালে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের আগেই পরবর্তী নির্বাচন জিততে আওয়ামী কায়দায় প্রশাসন সাজানোর অপচেষ্টা চালান।
নির্বাচন-পূর্ব এক দাতা সংস্থার পরামর্শসভায় এই লেখক সাবেক ক্যাবিনেট সেক্রেটারি মুজিবুল হককে জিজ্ঞাসা করেন, ভোট কতটা সুষ্ঠু হবে? উত্তরে তিনি বলেন, ‘নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হবে, তা ইম্ম্যাটেরিয়াল (অপ্রাসঙ্গিক)। তবে এই নির্বাচনের পর হাসিনার উত্থান হবে এক ভিন্ন নেতা হিসেবে।’
২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট ৩০০ আসনের দুই-তৃতীয়াংশে জিতে যায় এবং ৬২ আসন পায় আওয়ামী লীগ। পরাজিত ও রাগান্বিত হাসিনা তখন ‘স্থূল কারচুপি’র অভিযোগ করেন।
১৯৯০ সালে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে হাসিনার ভবিষ্যদ্বাণী ছিল—‘বিএনপি ১০ আসন পাবে।’ বাস্তবে তার লীগ পায় ৮৮ আসন ও বিএনপি ১৪২। বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া পাঁচ আসনেই জেতেন, কিন্তু হাসিনা তিনটির দুটিতে ফেল করেন। সেবার তিনি ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’কে পরাজয়ের কারণ হিসেবে দাঁড় করান।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে হাসিনার দল জেতে অল্প ব্যবধানে—সদ্য ক্ষমতাত্যাগী বিএনপির ১১৮ আসনের বিপরীতে আওয়ামী লীগ লাভ করে ১৪৬ আসন।
এই তিনটি নির্বাচনের ফলাফলে হতাশ এবং রাজনৈতিক আচরণে দুর্বিনীত হাসিনা ‘যেন-তেন প্রকারেণ’ ঘায়েল করার লক্ষ্যবস্তু ঠিক করেন বিএনপি ও বেগম খালেদা জিয়াকে। মুজিবুল হকের কথামতো হাসিনা ‘ভিন্ন নেতা হিসেবে’ আবির্ভূত হন ঠিকই, তবে তা নষ্ট রাজনীতির পথ ধরে।
২০০৮ সালে জেনারেল মইন-মাসুদ নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট দুই-তৃতীয়াংশের বেশি আসন বাগিয়ে নেয়। এর আড়াই বছরের মাথায় ২০১১ সালে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে ১৯৯৬ সালে প্রবর্তিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বিলুপ্ত করেন হাসিনা। ২০২৪ সালে পতনের আগ পর্যন্ত তিনি কী কী করেছিলেন, তা এতক্ষণে আমাদের অজানা নয়।
নিজের ক্ষমতায় থাকার খায়েশ পূর্ণ করার পাশাপাশি হাসিনা বিএনপিকে অত্যাচার, নিপীড়ন ও কূটকৌশলে নাস্তানাবুদ করে ফেলেন। দলটিকে টুকরো টুকরো করা এবং খালেদা জিয়াকে নিস্তব্ধ করতে না পারলেও নিজের দল আওয়ামী লীগকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যান ফ্যাসিবাদী শাসক হাসিনা।
১৯৯৬ সালে গঠিত সরকারটিকে ব্যতিক্রম ধরলে নিজস্ব ইতিহাসের ধারা ঠিক রেখে আওয়ামী লীগ ১৯৫৬, ১৯৭৫ ও ২০২৪ সাল—কখনোই শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করেনি।
১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ড এবং ১৯৮২ সালে জেনারেল এরশাদের ক্যু, ১৯৯৬ সালের অসহযোগ, ২০০৬ সালের লগি-বৈঠা আন্দোলন এবং ২০০৭ সালের সেনানিয়ন্ত্রিত ওয়ান-ইলেভেন সরকার গঠন ও ২০০৮ সালে গড়া-পেটার নির্বাচন—এসব ঘটনায় বিএনপির ক্ষমতা থেকে অস্বাভাবিক বিদায় বা রাজনৈতিক বিপর্যয়ে আওয়ামী লীগ নেত্রী হাসিনার নাম জড়িয়ে আছে।
সুতরাং ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে মুজিবের একদলীয় বাকশালে মিশে যাওয়া এবং জিয়ার দয়ায় পুনরুজ্জীবিত আওয়ামী লীগের হাল ধরে হাসিনা বাংলাদেশের রাজনীতিকে ফ্যাসিবাদী ধারায় রূপান্তরের দীর্ঘ সময় পান।
৪৩ বছর আগে নয়াদিল্লি থেকে এসে ২০২৪ সালে গণ-ধাওয়া খেয়ে সেখানেই ফিরে গিয়ে ঢাকার কূটনৈতিক কার্যক্রমের ক্ষেত্রে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি করেছেন। তিনি প্রমাণ রেখেছেন তিনি কে।
শেষ বিকালে হেলে পড়া সূর্যের বিপরীতে মানুষের আসল আকৃতির চেয়ে দীর্ঘ ছায়ার মতোই দেশের রাজনীতিতে হাসিনার ছায়া এতটা লম্বা যে সেই অলীক (ফ্যান্টম) বাস্তবতাকে অনেকে সত্য বলেই ধরে নিচ্ছেন।
তবে শারীরিকভাবে হাসিনা বাংলাদেশে অনুপস্থিত থাকলেও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে তার অপচ্ছায়া বর্তমান এবং হয়তো তার অশরীরী উপস্থিতি থাকবে আরো কিছু কাল, তাই বলে অনন্তকাল নয়।
হাসিনার সাঙ্গোপাঙ্গদের রাজনৈতিক ভাষা সমাজকে এতটাই কলুষিত করেছে যে গণতান্ত্রিক শক্তি, সুশীল সমাজ এবং ক্ষমতাকেন্দ্রের কেউ কেউ সেগুলো হরহামেশাই ব্যবহার করেন এখনো।
দেখুন, ২০২৩ সালের ১১ জানুয়ারি হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকারকে উৎখাতের মতো শক্তি দেশে তৈরি হয়নি; ২০২৫ সালের ৭ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সেক্রেটারি বলেন, পৃথিবীর কোনো শক্তি নেই (২০২৬ সালের) ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন ঠেকানোর।
হাসিনার সর্বশেষ সাড়ে পনেরো বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনের শিক্ষা ও ফেলে যাওয়া সংস্কৃতি এই যে, গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল একে অপরকে আক্রমণ করে বক্তৃতা দেবে এবং তার বিষয়বস্তু হবে কেবল প্রতিপক্ষের রাজনীতির ভুল ধরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সদ্য সমাপ্ত ছাত্র সংসদগুলোর নির্বাচন এবং অন্যান্য কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক বিতর্কে বোঝা যাচ্ছে, সেকেলে মানসিকতার রাজনীতিকরা হাসিনার বৃত্ত থেকে বেরুতে পারছেন না। নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হলে আপনি অযথা কলঙ্কিত করতে পারবেন না, আর কারচুপি হলে দিতে পারবেন না নৈতিক বৈধতা; এটা জেনেও জনসমাজের দেখা ও বোঝাপড়াকে হাসিনার আদলে অগ্রাহ্য করাটা রাজনৈতিক বোকামি।
আমাদের আজকের উদ্বেগের বিষয় আগামী নির্বাচনকে রাজনীতিক ও অন্য অংশীজনরা শেখ হাসিনা-নির্মিত বিকৃত আয়নায় দেখবে কি না।
বাংলাদেশের রাজনীতি যে চিরদিনের জন্য পাল্টে গেছে, অনেকে তা দেখতে বা বুঝে উঠতে পারছেন না। অবশ্যই এ পরিবর্তনের ধারা প্রতিফলিত হবে আগামী নির্বাচনে, ভবিষ্যৎ রাজনীতিতে।
আমরা অনেকেই দেখে অবাক হবো, হাসিনার আওয়ামী সমর্থক বা ভোটব্যাংকই শুধু সংকুচিত হয়েছে তা নয়, বদলে গেছে রাজনীতির মেরূকরণ এবং সাধারণ মানুষ বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গি ও রাজনীতিকদের প্রতি দাবি ও প্রত্যাশা।
স্বীকার করছি, জনমিতি ও রাজনৈতিক দিনবদলসহ ব্যাপক পরিবর্তন প্রমাণ করার মতো উপাত্ত এখনো আমাদের কাছে নেই; তারও কারণ হাসিনা ভোটের মাধ্যমে জনমত প্রতিফলনের আয়োজন রেখে যাননি। সেই প্রেক্ষিতে কিছু জনমত জরিপের ফলাফলও মানুষকে বিভ্রান্ত করে।
যেমন সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত এক জরিপ বলছে, প্রায় ৪৬ শতাংশ সম্ভাব্য ভোটার নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার পক্ষে এবং অনুরূপ হার বিপক্ষে। একই জরিপ আওয়ামী লীগের প্রতি ভোটারদের সমর্থন দেখাচ্ছে প্রায় ১৯ শতাংশ।
দলটিকে নির্বাচনে আনার পক্ষে জনমত এত প্রবল (৪৬ শতাংশ) হলে তাকে ভোট দিতে আগ্রহীর হার এত কম (১৯ শতাংশ) হবে কেন? শতকরা ৭৫ ভাগের বেশি ভোটার আওয়ামীবিরোধী এবং ওই আমলে অত্যাচারিত দলগুলোকে পছন্দ করলেও কেন মাত্র ৫০ শতাংশের কম (৪৬ শতাংশ) ভোটার হাসিনার দলকে নির্বাচনে আনার বিপক্ষে থাকবে?
ওই জরিপ থেকে বোঝা যাচ্ছে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে না থাকলে আট শতাংশের মতো সমর্থক বিএনপি ও জামায়াতের দিকে চলে যাবে এবং ওরকম হারেই আওয়ামী ভোটাররা গোস্সা করে ভোটকেন্দ্রে যাওয়া থেকে বিরত থাকবে।
তাহলে চলমান পরিস্থিতি আসলে গতিশীল। ২৫ শতাংশ বা তার বেশি আওয়ামী ভোটব্যাংকের দাবিও খুব পুরোনো। এই জাতি অসত্যকে আঁকড়ে ধরে থাকলে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়া হাসিনার ছায়া তাড়াতে কোটি জনতা রাস্তায় নেমে আসত না।
লেখক : সাংবাদিক