মার্কিন ট্রেজারির ওপর আমার ক্ষমতা থাকলে ইউরোপের বর্তমান কোনো সরকারকেই আমি একটা পেনিও দিতাম না। এ কথা বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। মিনস্ক গ্রুপের ইউরোপীয় দেশগুলোর ব্যাপারেও একই কথা তিনি বলতে পারেন। ৩০ বছরেও তারা ককেশাস অঞ্চলে শান্তি আনতে পারেনি। ২৫ বছরের বেশি সময় ধরে এ অঞ্চলে সংঘাত আর দ্বন্দ্ব চলে আসছে। এখন একটা বড় পরিবর্তন এসেছে। বিস্তারিত থাকছে হায়দার সাইফের প্রতিবেদনে।
ককেশাসের সংঘাত পরিস্থিতিতে সবসময়ই যুক্তরাষ্ট্রের একটি ভূমিকা ছিল। সংঘাতের শুরু থেকেই তাদের সংশ্লিষ্টতা ছিল। ওএসসিই মিনস্ক গ্রুপের কো-চেয়ার হলো যুক্তরাষ্ট্র। ১৯৯২ সালে প্রথম কারাবাখ যুদ্ধের সময় এই গ্রুপ গঠিত হয়। কিন্তু আজারবাইজান আর আর্মেনিয়াকে শান্তি আলোচনায় বসানোর প্রচেষ্টা নতুন শতকে গড়িয়েছে। ২০০১ সালের এপ্রিলে ফ্লোরিডার কি ওয়েস্টে আলোচনার আয়োজন করেছিল। সেটা হয়েছিল ওএসসিই মিনস্ক গ্রুপের অধীনে। ৩ থেকে ৬ এপ্রিল আলোচনা হয়েছিল। সেই আলোচনায় অবশ্যই বড় কিছু হয়নি। কিন্তু জায়গাটার একটা তাৎপর্য ছিল। আইডিয়াটা ছিল রাষ্ট্রদূত ক্যারি ক্যাভানোর। তিনি ছিলেন নাগার্নো-কারাবাখে নিযুক্ত মার্কিন বিশেষ মধ্যস্থতাকারী।
আলোচনা ব্যর্থ হওয়ার একটা বড় কারণ ছিল। মার্কিন অবস্থান সেখানে ন্যায্য ছিল না। তারা আর্মেনিয়ার দিকে ঝুঁকে ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের আর্মেনীয় লবি আর্মেনিয়ার দৃষ্টিভঙ্গিকে বেশি সমর্থন দিয়েছিল। ককেশাস অঞ্চলে রাশিয়ার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রকে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল তাদের নিজেদের জন্যই ততটা ভালো হয়নি। তাহলে ২৫ বছর পর এসে যুক্তরাষ্ট্র কেন আবার শান্তির ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছে?
ককেশাস ইস্যুতে ওয়াশিংটন প্রধান খেলোয়াড় হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। দীর্ঘ সময় তারা দূরে ছিল। এই পরিবর্তনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ ও বিশ্ব রাজনীতির একটা যোগ আছে। স্থানীয় স্বার্থে একটি বড় শক্তি যখন লড়াই করে, সেটা সবসময় শান্তির জন্য হয় না। নিজের স্বার্থই সাধারণত প্রধান থাকে সেখানে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাকান ফিদানও সেটাই বলেছেন। তিনি বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রকে আমাদের তাদের নিজস্ব পরিকল্পনার আলোকেই দেখতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের শান্তিকামী হিসেবে আবির্ভাবের একটা কারণ হলো ট্রাম্পের প্রচার। নিজেকে তিনি যুদ্ধের যবনিকা পতনকারী হিসেবে দেখাতে চান। এতে নির্বাচনে তার সুবিধা হবে। ট্রাম্প বলেছিলেন, দুটো বড় যুদ্ধের তিনি ইতি টানবেন। সেগুলো হলো রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ। কিন্তু তিনি সফল হতে পারেননি। এখন ককেশাস অঞ্চলকে নতুন সুযোগ হিসেবে দেখছেন তিনি। তার নিজের রাজনৈতিক চাহিদার সঙ্গে এটা মানানসই।
দ্বিতীয় কারণ হলো বিশ্ব ভারসাম্যের পরিবর্তন। ট্রাম্প চান, এই অঞ্চলে রাশিয়ার দীর্ঘদিনের অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ুক। প্রায় এক শতাব্দী ধরে সেখানে প্রভাব ধরে রেখেছে রাশিয়া। চীনের বিরুদ্ধেও এই কৌশল কাজ করবে বলে মনে করছে যুক্তরাষ্ট্র। চীন তাদের অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। জাঙ্গেজার করিডোরকে চীন হুমকি মনে করে। শান্তি আসলে এই করিডোর চালু হতে পারে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ এতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই নিজের স্বার্থেই যুক্তরাষ্ট্র আজারবাইজান আর্মেনিয়ার শান্তি প্রক্রিয়ায় ভূমিকা রাখছে। সত্যিকারের স্থিতিশীলতার চেয়ে ক্ষমতা আর অর্থই তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
৮ আগস্ট ওয়াশিংটনে বড় চুক্তি হয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ এবং আর্মেনিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিকোল পাশিনইয়ানও সেখানে ছিলেন। এই চুক্তি বাকু আর ইয়েরেভেনের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক চালু করল। ওএসসিই মিনস্ক গ্রুপের প্রাসঙ্গিকতা এর মাধ্যমে শেষ হলো। এখন ‘ট্রাম্প ইন্টারন্যাশনাল পিস অ্যান্ড প্রসপারিটি রুট’ বা টিআরআইপিপি নিয়ে পরিকল্পনা হচ্ছে। জাঙ্গেজার করিডোরের এই রুট আর্মেনিয়ার ভেতর দিয়ে যাবে। যুক্তরাষ্ট্র অন্যান্য আগ্রহী দেশকে নিয়ে এই প্রকল্পে কাজ করবে। এদের অন্যতম হলো তুরস্ক।
ককেশাসের সংঘাত নিরসনে তুরস্ক নেতৃত্ব দিয়েছে। দ্বিতীয় কারাবাখ যুদ্ধের পর আজারবাইজান তাদের সীমানা ফিরে পেয়েছে। যুদ্ধ এবং আলোচনায় তুরস্কের সাহায্যের মাধ্যমেই এটা হয়েছে। সে কারণে ৮ আগস্টের চুক্তিও তুরস্ককে অবগত না করে করা সম্ভব হতো না। তুরস্ক এ ব্যাপারে সম্মতি দিয়েছিল। মাত্র ২০ দিন আগে প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান আলিয়েভ আর পাশিনইয়ানের সঙ্গে বৈঠক করেছিলেন। আলাদাভাবে দুজনের সঙ্গে দেখা করেছিলেন তিনি। এতে বোঝা যায়, চুক্তির ব্যাপারে যৌথভাবে কাজ হয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রে বসে চুক্তিতে তুরস্কের কোনো সমস্যা নেই। এটিও তাদের জন্য জয় হতে পারে। এখানে রাশিয়া বা চীনের বিরুদ্ধে তুরস্ককে সরাসরি লড়তে হবে না। তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, তারা চুক্তিতে খুশি। এরদোয়ান পরদিন আলিয়েভকে ফোন করেছিলেন। এতে সমর্থন প্রকাশ পেয়েছে। কিন্তু আজারবাইজান আর তুরস্ক মনে করে সত্যিকারের শান্তির জন্য ক্ষমতা লাগে। ক্ষমতাই একমাত্র জিনিস, যেটি আন্তর্জাতিক সম্পর্কে টিকে থাকে।
ককেশাস অঞ্চলে সমস্যার ইতিহাস দীর্ঘ। ১৯৯০-এর দশকের শুরুর দিকে সংঘাত শুরু হয়েছিল। নাগার্নো-কারাবাখের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছিল আর্মেনিয়া। এই অংশটা ছিল আজারবাইজানের অংশ। পরে যুদ্ধ হয়েছে। প্রথম কারাবাখ যুদ্ধ শেষ হয় ১৯৯৪ সালে। কিন্তু সত্যিকারের শান্তি আসেনি। মিনস্ক গ্রুপ সাহায্য করতে চেষ্টা করেছে। রাশিয়া, ফ্রান্স এবং যুক্তরাষ্ট্র সেখানে উপস্থিত ছিল। বহু বৈঠক করেছে তারা। কিন্তু সংকট মেটেনি। উত্তেজনাও দূর হয়নি।
পরে যুক্তরাষ্ট্র আরো বেশি করে জড়িয়ে পড়ে। ২০০০ সালের পর আলোচনার জন্য তারা চাপ দেয়। কি ওয়েস্টের বৈঠকও এরই অংশ। দুই পক্ষের নেতারাই সেখানে ছিল। ভূমি বিনিময় নিয়ে আলোচনা হয়েছে। স্ট্যাটাস নিয়ে কথা হয়েছে। কিন্তু কিছু আইডিয়া মানতে অস্বীকার করেছে আর্মেনিয়া। যুক্তরাষ্ট্রে আর্মেনীয় লবি বেশ শক্তিশালী। বহু আর্মেনীয় সেখানে বাস করে। রাজনীতিতেও অর্থ ঢালে তারা। এতে মার্কিন নীতির ওপর তারা প্রভাব ফেলতে পারে।
এখন পরিস্থিতি দ্রুত বদলে গেছে। দ্বিতীয় কারাবাখ যুদ্ধ হয়েছে ২০২০ সালে। আজারবাইজান তার ভূখণ্ড ফিরে পেয়েছে। এতে ক্ষমতার কেন্দ্র ঘুরে গেছে। অস্ত্রবিরতিতে তখন মধ্যস্থতা করেছিল রাশিয়া। কিন্তু সমস্যা তখনো পুরো কাটেনি। সীমান্তরেখা সুনির্দিষ্ট করা ছিল না। বাণিজ্য রুট আটকে দেওয়া হয়েছে। জাঙ্গেজার করিডোরের ধারণা তখন সামনে আসে। এর মাধ্যমে নাখশিভান ছিটমহলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সুযোগ আসে আজারবাইজানের। এই করিডোর গেছে আর্মেনিয়ার ভেতর দিয়ে। তুরস্ক ও অন্যদের সঙ্গে বাণিজ্যের দরজাও এতে খুলে যাবে।
ট্রাম্পের ক্ষমতায় ফিরে আসাটা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। তার টিম চুক্তির দিকে মনোযোগ দিয়েছে। ট্রাম্প বড় বড় অর্জন চান। যুদ্ধ শেষ করতে চান। এগুলো নিয়ে তিনি টুইট করেন। তিনি দাবি করেন, দ্রুত সমস্যা সমাধান করতে পারেন তিনি। কিন্তু ইউক্রেন এখনো যুদ্ধে আটকে আছে। গাজাও আটকে আছে। এর বিপরীতে ককেশাস অঞ্চলের সাফল্যে তিনি উজ্জীবিত হয়েছেন।
ভূরাজনীতি এখানে বড় বিষয়। রাশিয়া ইউক্রেন নিয়ে ব্যস্ত। তাদের শক্তি কমে এসেছে। চীন রোডস অ্যান্ড বেল্ট নিয়ে চেষ্টা করছে। জাঙ্গেজার করিডোর তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারে। ইউরোপের সঙ্গে এশিয়াকে এটি ভিন্নভাবে যুক্ত করেছে। যুক্তরাষ্ট্র এখানে জ্বালানি আর বাণিজ্যকেন্দ্রিক সম্ভাবনা দেখছে। আজারবাইজানের তেল আর গ্যাস আছে। এখানে পাইপলাইনও গড়ে উঠতে পারে।
চুক্তির বিস্তারিত সামনে এসেছে। কূটনীতিক সম্পর্কের অর্থ হলো দূতাবাস চালু হবে। বাণিজ্য শুরু হবে। ব্যর্থতার জন্য মিনস্ক গ্রুপ আর থাকছে না। নতুন নাম হলো টিআরআইপিপি। ট্রাম্প এটাকে যেন নিজের ব্র্যান্ড হিসেবে দাঁড় করাতে চাচ্ছেন। এই রুটে সড়ক আর রেলপথ থাকবে। নিরাপত্তা তথ্যবিনিময় হবে। তৃতীয় পক্ষ এই করিডোর নির্মাণ করতে পারে। তুরস্কের এ ধরনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। তারা আগে বড় প্রকল্পের কাজ করেছে।
তুরস্কের ভূমিকা এখানে গুরুত্বপূর্ণ। তারা সবসময় আজারবাইজানকে সমর্থন দিয়েছে। যুদ্ধে তুরস্কের ড্রোন তাদের সাহায্য করেছিল। কূটনীতিতেও সাহায্য করেছে আঙ্কারা। এরদোয়ান দুই পক্ষের সঙ্গেই কথা বলেছে। তিনি বাণিজ্যের বিনিময়ে শান্তি চান। এই করিডোর তুরস্কের অর্থনীতিকে সাহায্য করবে। এর মাধ্যমে তারা মধ্য এশিয়ার সঙ্গে যুক্ত হবে। রাশিয়ার সঙ্গে সরাসরি লড়াই চাচ্ছে না তুরস্ক। আর্মেনিয়ায় রাশিয়ার ঘাঁটি আছে। চীনের বিনিয়োগ আছে সেখানে।
চুক্তির পেছনে তুরস্কের সমন্বয়ের ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে। এরদোয়ান দুই দেশের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। শেষ মুহূর্তে যুক্তরাষ্ট্র এসেছে দৃশ্যপটে। তুরস্ক চুক্তিকে স্বাগত জানিয়েছে।
ক্ষমতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কাগজে কী লেখা হলো, সেটি যথেষ্ট নয়। সামরিক শক্তি শান্তিকে সমর্থন দিতে পারে। আজারবাইজান তাদের সেনাবাহিনী গড়তে পারবে। তুরস্ক সাহায্য করবে। এতে হুমকি কমবে। বিশ্ব রাজনীতিতে দুর্বল দেশগুলোকেই সাধারণত ভুগতে হয়। অন্যদিকে, শক্তিশালীরা শ্রদ্ধা পান।
ভবিষ্যতে কিছু আশার আলো দেখছেন কেউ কেউ। কিন্তু চ্যালেঞ্জ পুরোপুরি যায়নি। আর্মেনিয়ায় বিক্ষোভ হয়েছে। সেখানে কেউ কেউ চুক্তির বিরোধিতা করেছে। সীমান্ত পাহারা দেওয়ার দরকার আছে এখনো। করিডোরকে অবশ্যই নিরাপদ রাখতে হবে। আন্তর্জাতিক সাহায্যও লাগবে সেখানে। যুক্তরাষ্ট্র সহায়তার কথা বলেছে। তবে, ফিদান বলেছেন, আধিপত্যের জন্য আরো অনেক কিছু লাগে।
অনেকেই এটিকে অগ্রগতি হিসেবে দেখছেন। ককেশাস হয়তো সেরে উঠতে পারবে। বাণিজ্য প্রবাহ চালু হবে। মানুষ শান্তিতে বাস করবে। এই চুক্তি অনেকটা ভারসাম্য এনেছে। রাশিয়ার কর্তৃত্ব কিছু কমবে। চীনও পরিস্থিতি দেখছে। যুক্তরাষ্ট্রের শক্তি কিছুটা বাড়ল। তুরস্কেরও লাভ হলো। তবে ককেশাসে সত্যিই কতটা শান্তি ফিরল, সেটি বুঝতে আরো কিছুকাল অপেক্ষা করতে হবে।
ডেইলি সাবাহ অবলম্বনে জুলফিকার হায়দার