এই দুটি সংঘাতের মধ্যে সময়ের ব্যবধান, সংঘাতের বিস্তৃতি এবং সংঘাতের নেপথ্যে বিভিন্ন পক্ষের স্বার্থসংশ্লিষ্ট উদ্দেশ্যসহ সব ক্ষেত্রেই অনেক ফারাক রয়েছে। জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনের যাচাই করা তথ্য অনুযায়ী ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে শুরু হওয়া রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে এ পর্যন্ত ৩০,০০০-এর বেশি বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে। অন্যদিকে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে শুরু করা ইসরাইলি আগ্রাসনে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী ২০ জুলাই পর্যন্ত নিহত হয়েছে ৫৮,০০০-এর বেশি বেসামরিক ফিলিস্তিনি, যার অধিকাংশই নারী ও শিশু।
এ দুটি সংঘাতের কারণে সহিংসতা, যৌন হয়রানি, গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন অবকাঠামো ধ্বংস করা, বেসামরিক লোকজনের ব্যাপকভাবে বাস্তুচ্যুত হওয়াসহ বেশ কিছু মানবিক সমস্যার উদ্ভব হয়েছে। ১৯৪৯ সালের জেনেভা সনদ ও এর বাড়তি প্রটোকলগুলোয় হাসপাতাল, স্কুল, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা, যুদ্ধবন্দি ও সাধারণ মানুষের ওপর নির্যাতন এবং রাসায়নিক ও জীবাণু অস্ত্র ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু বর্তমানে চলমান এই দুটি যুদ্ধেই জেনেভা সনদ ও এর প্রটোকলগুলোর এই নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করা হয়েছে।
দুটি সংঘাতেই আগ্রাসন চালানো দেশ দুটির ওপর যে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, তার ধরনও ভিন্ন। এতে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন ওঠে, এখানে যে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বা দ্বৈতনীতি অনুসরণ করা হচ্ছে, তা কি করা হচ্ছে ধর্মের কারণে? ইউরোপীয় ইউনিয়ন ২০২২ সালের মে মাসে রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি নিষিদ্ধ করে। একই সঙ্গে এই জোট সাগরে রাশিয়ার তেল পরিবহনও বন্ধ করে দেয়। এর আগে একই বছরের মার্চে যুক্তরাষ্ট্রও নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে রাশিয়া থেকে জ্বালানি আমদানি নিষিদ্ধ এবং দেশটির ব্যাংক ও জ্বালানি কোম্পানিগুলোর সম্পদ জব্দ করে। যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও তাদের মিত্র দেশগুলো রাশিয়ার ওপর ধারাবাহিকভাবে যে ধরনের ব্যাপক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে, তা ইতিহাসে নজিরবিহীন।
অন্যদিকে, গাজায় আগ্রাসন ও গণহত্যার জন্য ইসরাইলের ওপর মাত্র আংশিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়। নেদারল্যান্ডস ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইসরাইলের কাছে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমানের যন্ত্রাংশ সরবরাহ স্থগিত করে। অন্যদিকে, স্পেন চলতি বছরের এপ্রিলে ইসরাইলে গোলাবারুদ সরবরাহের একটি আদেশ বাতিল করে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র ২০২৪ সালের আগস্ট মাসে ইসরাইলের কাছে প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার মূল্যের অস্ত্র, গোলাবারুদ ও সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি করার সম্মতি দেয়। চলমান দুটি সংঘাতে জড়িত দুটি দেশের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে এ ধরনের বৈষম্য নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে এবং এটাকে অনেকেই দুটি সংঘাতের মধ্যে ডাবল স্ট্যান্ডার্ড বা দ্বৈতনীতি অনুসরণ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
ইউক্রেন থেকে রুশ সেনা প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে ২০২২ সালের মার্চে ও ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দুটি প্রস্তাব গৃহীত হয় জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে। অন্যদিকে, গাজায় অস্ত্রবিরতি কার্যকর ও মানবিক করিডোরের আহ্বান জানিয়ে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে দুটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। কিন্তু রাশিয়ার বিরুদ্ধে নেওয়া প্রস্তাব বাস্তবায়নের তুলনায় ইসরাইলের বিরুদ্ধে গৃহীত প্রস্তাব দুটির বাস্তবায়নের গতি ছিল একেবারেই ধীর ও ঢিলেঢালা। যুদ্ধ চলার এ সময় গাজায় প্রতিদিন গড়ে ১৪৬টি ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ করেছে। অথচ যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যায়নেই বলা হয়েছে, গাজায় দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে প্রতিদিন গড়ে অন্তত ৬০০ ত্রাণবাহী ট্রাক প্রবেশ করা প্রয়োজন।
জাতিসংঘ মানবাধিকার হাইকমিশনের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ইসরাইলি বাহিনী গাজায় প্রবেশের জন্য আসা ত্রাণবাহী ট্রাকগুলো সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্টে আটকে রাখে দিনের পর দিন। অনেক সময় সেনারা এসব ট্রাক লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। তারা দিনে সর্বোচ্চ ২৯টি ট্রাক প্রবেশ করতে দেয়, যা বিশাল সাগরে বৃষ্টির এক ফোঁটা পানির মতোই।
অথচ কৃষ্ণসাগর দিয়ে ইউক্রেনের জন্য খাদ্যসামগ্রী আমদানি-রপ্তানির ব্যাপারে সব ধরনের লজিস্টিক সহায়তা দেওয়ার ব্যবস্থা করে রেখেছে পশ্চিমা বিশ্ব। এমনকি ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইউক্রেনের খাদ্য রপ্তানি নিশ্চিত করতে সলিডারিটি লেন প্রতিষ্ঠা করেছে। অথচ গাজায় ত্রাণ প্রবেশে বাধা দিয়ে ইসরাইলের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষ নিয়ে কোনো কথা বলছে না। এটি মানবাধিকার আইনসহ আন্তর্জাতিক সব আইনেরই লঙ্ঘন।
দুটি চলমান সংঘাতের ব্যাপারে পশ্চিমাদের এই দ্বৈতনীতি এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয়। কোনো কোনো বিশ্লেষকের মতে, পশ্চিমা জোট তাদের ‘গণতন্ত্র’-এর বিরুদ্ধে রাশিয়ার সম্প্রসারণবাদী তৎপরতা থামাতে ইউক্রেনকে একটি প্রতিবন্ধক হিসেবে ব্যবহার করছে। সে জন্য তারা ইউক্রেনকে সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে। একই সঙ্গে পশ্চিমারা রাশিয়ার জ্বালানি রপ্তানি বন্ধ করাসহ অসংখ্য অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে রাশিয়ার অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল।
অন্যদিকে, ইসরাইল হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যে তাদের ঘনিষ্ঠ কৌশলগত মিত্র। সে জন্যই তারা ইসরাইলের আইন লঙ্ঘন করা নিয়ে টুঁ শব্দও করছে না। যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের কিছু দেশ ইসরাইলকে প্রতিবছর মোটা অঙ্কের অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে থাকে। এ জন্য এসব দেশকে ইসরাইলও মধ্যপ্রাচ্যে তার ‘প্রধান কৌশলগত মিত্র’ হিসেবে বিবেচনা করে। ফলে ইসরাইল গাজায় অব্যাহতভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করলেও পশ্চিমারা ইহুদি বর্ণবাদী দেশটির বিরুদ্ধে কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা অর্থাৎ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে না।
পশ্চিমাদের এই দ্বিচারিতার মূল কারণ হচ্ছে, পশ্চিমা কিছু মিডিয়া ও রাজনৈতিক এলিটরা ইউরোপীয়দের দুর্দশা বা ভোগান্তিকে একটি সব সময়ই ট্র্যাজেডি হিসেবে বিবেচনা করে। এর বিপরীতে, আরবদের দুর্দশাকে তারা সংঘাতকবলিত এলাকার একটি রুটিন বাস্তবতা বলে মনে করে।
পশ্চিমারা ইসলাম ধর্মকে প্রায়ই একটি ‘সন্ত্রাসী ধর্ম’ হিসেবে আখ্যায়িত করে। ইসলামফোবিয়া বা ইসলামভীতি থেকে তাদের তৈরি করা এই বয়ান এখন পশ্চিমা বিশ্বের পররাষ্ট্রনীতির একটি অনিবার্য অংশ হয়ে উঠেছে। ইসরাইলে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামলায় বিদেশিসহ অন্তত ১২০০ জন নিহত হওয়ার ঘটনা পশ্চিমা মিডিয়ার ফিলিস্তিনবিরোধী অপপ্রচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে।
কিন্তু তারা ১৯৪৮ সালে ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড দখল করে ইসরাইল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা নিয়ে কোনো কথা বলে না। এটি পশ্চিমাদের ইসলামফোবিয়া এবং ধর্মীয় বর্ণবাদী নীতি অনুসরণ ও আচরণের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ। আত্মরক্ষার বৈধ অধিকারী কারা হবে, তা ধর্মীয় বর্ণবাদী এই নীতির মাধ্যমেই নির্ধারণ করে পশ্চিমা বিশ্ব।
ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েন ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউক্রেন নিয়ে দেওয়া এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, ‘তারা আমাদেরই একজন এবং আমরা তাদের আমাদের সঙ্গে রাখতে চাই।’ তার এই বক্তব্য থেকে স্পষ্ট, তারা ইউক্রেনকে কীভাবে ‘খ্রিষ্টান ইউরোপীয় পরিবারের’ অংশ হিসেবে তৈরি করছে। এ জন্যই তারা ইউক্রেনের মানুষের দুর্ভোগকে একটি ট্র্যাজেডি হিসেবে বিবেচনা করে। অন্যদিকে, আরব ও মুসলমানদের দুর্ভোগকে নিয়মিত সংঘাতের পরিণতি বলে মনে করে।
পশ্চিমারা বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে ‘খ্রিষ্টান উপনিবেশবাদ’ প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তারা বর্ণবাদী এই ডাবল স্ট্র্যান্ডার্ড বা দ্বৈতনীতি অনুসরণ করে আসছে। তাদের এই নীতি দুটি বিষয়ের ওপর প্রতিষ্ঠিত। একটি হচ্ছে ভূরাজনৈতিক স্বার্থ এবং অন্যটি হচ্ছে ধর্ম বা বর্ণ। ভূরাজনৈতিক স্বার্থের আলোকেই পশ্চিমারা নির্ধারণ করে কারা তাদের মিত্র হবে এবং কাদেরকে শত্রুর কাতারে ফেলতে হবে।
অন্যদিকে, ধর্ম বা বর্ণের বিষয়টি পশ্চিমাদের তাদের ‘সহযোগী’ খ্রিষ্টান-শ্বেতাঙ্গ ইউরোপীয়দের প্রতি অনেক বেশি সহানুভূতিশীল হতে উদ্বুদ্ধ করে। পশ্চিমাদের এই দুটি নীতি পরস্পরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে চলে এবং বিরোধীদের ঘায়েল করতে একে অন্যের শক্তি বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইন বা নীতিনৈতিকা পশ্চিমাদের কাছে মুখ্য নয়। বরং সাংস্কৃতিক-ধর্মীয় পরিচিতি, কৌশলগত-অর্থনৈতিক-সামরিক স্বার্থ হাসিলে এ দুটি বিষয়ের আলোকেই পশ্চিমারা তাদের নীতিনির্ধারণ করে থাকে।
মডার্ন ডিপ্লোমেসি থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী