অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা ও অধিকৃত পশ্চিম তীরে নতুন ধরনের যুদ্ধের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে ইসরাইল। এই যুদ্ধে মিসাইল ও ড্রোনের প্রধান ভূমিকা নেই, বরং এতে নেতৃত্ব দিচ্ছে কম্পিউটার অ্যালগোরিদম। অ্যালগোরিদম হচ্ছে একটি সমস্যা সমাধানের জন্য ধাপে ধাপে দেওয়া নির্দেশাবলির একটি সেট। এটি কম্পিউটার প্রোগ্রামিং ও গণিতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা একটি নির্দিষ্ট সমস্যা সমাধানের জন্য কম্পিউটারে নির্দেশাবলি দেওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়। এই পদ্ধতিটি কম্পিউটারকে জানায়, কীভাবে ধাপে ধাপে কাজটি সম্পন্ন করতে হবে।
সম্প্রতি তুরস্কের রাজধানী আংকারাভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান দ্য ফাউন্ডেশন ফর পলিটিক্যাল, ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল রিসার্চের (সেতা) ‘ডেডলি অ্যালগোরিদমস : ডেস্ট্রাকটিভ রোল অব আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইন গাজা ওয়ার’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এমন তথ্যই তুলে ধরা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, সামরিক অভিযানে ইসরাইলের আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্রমবর্ধমান ব্যবহার যুদ্ধের গতি-প্রকৃতিই বদলে দিচ্ছে।
যুদ্ধের নতুন এই মডেলে মানুষ নয়, যন্ত্রপাতিই নির্ধারণ করবে—কে বেঁচে থাকবে, আর কে মারা যাবে। এই পরিবর্তন যুদ্ধে বিপুলসংখ্যক সাধারণ মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে, যা আন্তর্জাতিক আইনের বেপরোয়া লঙ্ঘন। এর মাধ্যমে যেকোনো সংঘাতে নিরপরাধ সাধারণ মানুষের জীবন রক্ষা করার প্রয়োজনীয়তার বিষয়টি সামনে চলে আসছে। এই প্রতিবেদনের মূল পয়েন্টটি অত্যন্ত পরিষ্কারÑযুদ্ধে ইসরাইলের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার অনেক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে মানুষের বিচার-বিবেচনাকে কাজে লাগানোর স্থানকে সংকুচিত করেছে, বিশেষ করে গাজায় এটা অহরহই ঘটছে। সেখানে টার্গেট নির্ধারণের পর আক্রমণ করার ক্ষেত্রে ল্যাভেন্ডার ও হাবসোরার মতো উচ্চ প্রযুক্তির এআই সিস্টেম ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু যন্ত্রের নেতৃত্বাধীন এই প্রক্রিয়া প্রায়ই সাধারণ ফিলিস্তিনি ও যোদ্ধাদের মধ্যে পার্থক্য নির্ধারণে ব্যর্থ হচ্ছে। আর এর ফল হচ্ছে বিপুলসংখ্যক সাধারণ ফিলিস্তিনির মৃত্যু।
অনেক দিন ধরেই ইসরাইল তার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে। এর অন্যতম উদাহরণ হচ্ছে দেশটির আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা আয়রন ডোম, যা প্রতিপক্ষের ছোড়া রকেটকে এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে মধ্য আকাশেই থামিয়ে দিতে পারে। একইসঙ্গে আয়রন ডোম ইসরাইলের বিভিন্ন নগরীর নিরাপত্তার জন্যও ব্যবহার করা হয়। কিন্তু আক্রমণে এআই প্রযুক্তির ব্যবহার যখন করা হচ্ছে, তখনই ঘটছে মারাত্মক মানবিক বিপর্যয়। হামাসের ৭ অক্টোবরের হামলার পর গাজায় শুরু করা সামরিক অভিযানে ইসরাইলি বাহিনী তাদের বোমা হামলার টার্গেট নির্ধারণ করতে ল্যাভেন্ডার ও হাবসোরার মতো এআই প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করে।
সেতা ফাউন্ডেশনের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইসরাইলি বাহিনী এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া ব্যবহারের কারণে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে সহিংসতার মাত্রা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে গেছে। গাজায় ইসরাইলের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারভিত্তিক যুদ্ধে সাধারণ ফিলিস্তিনিদের নির্বিচার হত্যাকাণ্ড জবাবদিহির সব সীমা অতিক্রম করেছে।
ইসরাইল ২০২১ সালে প্রথম হাবসোরা প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করে। এই প্রযুক্তিতে ড্রোন, স্যাটেলাইট, যোগাযোগ ব্যবস্থা ও সোশ্যাল মিডিয়া থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে দ্রুততম সময়ে টার্গেট নির্ধারণ করে সেখানে হামলা চালানো হয়। দাবি করা হয়ে থাকে, এই সিস্টেমে নির্ভুলভাবে টার্গেট নির্ধারণ করা সম্ভব হয়। কিন্তু বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। অধিকাংশ হামলা চালানো হয়ে থাকে আনগাইডেড বা অনির্দেশিত বোমা দিয়ে এবং এসব হামলায় বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রমাণ খুব কমই পাওয়া যায়।
অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কঠিন চ্যালেঞ্জঅবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের কঠিন চ্যালেঞ্জ
২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর ইসরাইল তার এআই যুদ্ধ প্রযুক্তির অন্যতম হাতিয়ার ল্যাভেন্ডারের ব্যবহার শুরু করে। এই প্রযুক্তির সহায়তায় ইসরাইল গাজায় বিমান হামলা আগের চেয়ে বহু গুণ বাড়িয়ে দেয়। ল্যাভেন্ডার ২০ সেকেন্ডের মধ্যে টার্গেটকে শনাক্ত করে হামলার অনুমোদন দিতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রায় সময়ই নানা ভুলভ্রান্তি দেখা যায়। ল্যাভেন্ডার প্রযুক্তি গাজায় ৩৭ হাজার ফিলিস্তিনিকে হামাস সদস্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছিল। কিন্তু তাদের বেশির ভাগই ছিল হামাসের একেবারেই নিম্নপর্যায়ের কর্মী, যাদের সংগঠনটির সামরিক তৎপরতার সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা নিশ্চিত করতে পারেনি ল্যাভেন্ডার প্রযুক্তি।
অথচ এসব ফিলিস্তিনির অধিকাংশকেই তাদের বাড়িতে রাতের আঁধারে হত্যা করেছে ইসরাইলি সেনারা। এ সময় নিহতদের পরিবারের সদস্যরাও উপস্থিত ছিল। এখানে উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ২০২৪ সালের ৭ জুলাই নুসেইরাতের জাতিসংঘ স্কুলে ইসরাইলি বিমান হামলায় ২৩ জন নিহত ও ৮০ জনের বেশি আহত হন। কিন্তু পরে ইসরাইল বাহিনী স্বীকার করে, নিহতদের মধ্যে মাত্র আটজন ছিল হামাস সদস্য। হতাহত অন্যদের মধ্যে অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারভিত্তিক এসব হামলার প্রতিটিতেই অন্তত ২০ জন বেসামরিক ফিলিস্তিনি যে নিহত হতে পারে, তা ধরে নিয়েই হামলা চালানো হয়।
হামলার প্রতিটি টার্গেট কী ধরনের হুমকি, তা বিচার-বিশ্লেষণ না করেই হামলাগুলো চালানো হয়। এসব হামলায় সাধারণ ফিলিস্তিনিদের ব্যাপকভাবে হতাহত হওয়ার ঘটনাকে ইসরাইল ‘কোল্যাটারাল ড্যামেজ’ বা আনুষঙ্গিক ক্ষতি হিসেবে হিসেবে ধরে নেয়। যেসব ফিলিস্তিনি ‘হয়্যার ইজ ড্যাডি?’-এর মতো সফটওয়্যার ব্যবহার করেন, তাদেরও এআই সিস্টেমের মাধ্যমে ট্র্যাকিং করা হয়। তারা যখন নিজের বাড়িতে বা ক্যাম্পে প্রবেশ করেন, ঠিক তখনই তাদের ওপর হামলা চালায় ইসরাইলি বাহিনী। এ ধরনের হামলায় নির্দিষ্ট ওই ব্যক্তির সঙ্গে থাকা পরিবারের সদস্য বা অন্যান্য লোকজনও নিহত হন। ফলে অ্যালগোরিদমিক দক্ষতা নামের এই পদ্ধতিটি নিহতদের সংখ্যা কমিয়ে আনার পরিবর্তে কার্যত নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের একটি কৌশল ও হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। এতে হামাস যোদ্ধা নন, এমন অসংখ্য ফিলিস্তিনিকে জীবন দিতে হচ্ছে প্রতিদিনই।
কিন্তু যুদ্ধে এআই ব্যবহারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, এ ধরনের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িতদের কারোই কোনো দায়বদ্ধতা বা জবাবদিহি থাকছে না। একটি মেশিন বা যন্ত্র যখন বেসামরিক নাগরিকদের ওপর গণহত্যা চালায়, তখন এর দায় কে নেবে? ইসরাইলি সামরিক বাহিনী বলছে, সেনা কর্মকর্তারাই এআই চিহ্নিত টার্গেটগুলোয় হামলার অনুমোদন দেন। কিন্তু অনুমোদন দেওয়ার ক্ষেত্রে তারা কখনো যাচাই করে দেখেন না, নির্ধারিত টার্গেটের সঙ্গে কতগুলো নিরপরাধ মানুষ রয়েছেন।
ইসরাইলি সেনা কর্মকর্তাদের এই আচরণের কারণ হচ্ছে ল্যাভেন্ডার ও হাবসোরার মতো এআই প্রযুক্তির ওপর অন্ধ নির্ভরতা। এ ধরনের প্রতিটি হামলার ক্ষেত্রে ২০ জন সাধারণ মানুষ নিহত হওয়াকে ‘গ্রহণযোগ্য’ ধরা হয়। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ডের জন্য কেউই দায়ী নয় বলে গণ্য করা হয়। যুদ্ধের নামে এ ধরনের নির্বিচার হত্যাকাণ্ড বিপজ্জনক নজির স্থাপন করছে। কারণ আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বেসামরিক নাগরিক হত্যার জন্য কেউ না কেউ অবশ্যই দায়ী হবেন।
কিন্তু এআই-ভিত্তিক যুদ্ধে সেই দায়িত্ব কার ঘাড়ে বর্তাবে তা স্পষ্ট নয়। এখানে সৈনিক, সেনা কমান্ডার ও সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার—সবাই হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়েই ইসরাইল ব্লু উলফ, রেড উলফ ও উলফ ব্ল্যাকের মতো এআই প্রযুক্তি দিয়ে অবরুদ্ধ গাজা ও অধিকৃত পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনিদের ওপর সার্বক্ষণিকভাবে নজরদারি করছে।
এই প্রযুক্তি দিয়ে তারা সব ফিলিস্তিনির চেহারা ও চলাফেরার যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করছে। এর মাধ্যমে গাজা ও পশ্চিম তীরকে ফিলিস্তিনিদের জন্য উন্মুক্ত কারাগারে পরিণত করে নির্বিচারে হত্যাকাণ্ড চালাচ্ছে ইসরাইল। গাজাকে ইসরাইল তার এআই-ভিত্তিক যুদ্ধের পরীক্ষাগার বানিয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ইসরাইলের এসব নৃশংসতা নিয়ে কোনো কথাই বলছে না আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়।
লেখক : সিনিয়র গবেষক, আংকারাভিত্তিক প্রতিষ্ঠান ফাউন্ডেশন ফর পলিটিক্যাল, ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল রিসার্চ
ডেইলি সাবাহ থেকে অনুবাদ : মোতালেব জামালী