নির্বাচনের র্বাচনের মুখ্য দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের হলেও তা কেবল তাদেরই একার দায়িত্ব নয়। এখানে প্রার্থী, ভোটার, রাজনৈতিক দল, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যসহ অংশীজন অনেক। ইসি অনেকটা রেফারির মতো। জানা-বোঝার পরও এ কথাগুলো আবার বলার কারণ পতিত আওয়ামী লীগ সরকার দেড় দশকে জাতীয়-স্থানীয়, এমনকি পেশাজীবী নির্বাচনি ব্যবস্থাকেও শেষ করে দিয়ে গেছে। নির্বাচনকে এনে ঠেকিয়েছে একটা তামাশা-মশকরায়। যে কারণে নির্বাচন কমিশনকে পড়তে হয়েছে মহা ইমানি পরীক্ষায়। জনমানুষের সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ এবং প্রশ্নমুক্ত নির্বাচনের আকাঙ্ক্ষা পূরণের সরাসরি দায় পূরণ করতে হবে এই কমিশনকে।

নির্বাচন প্রশ্নে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। আর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী বলতে মানুষ আগে চেনে পুলিশকে। তারপর সেনা, র‍্যাব, বিজিবি, আনসার। বাস্তবতা হচ্ছে এখনো ট্রমা কাটেনি পুলিশের। গেল সরকার আমলে নানা ক্রিয়াকর্মে পুলিশকে কেবল জনতার প্রতিপক্ষও বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্ষোভের ঐ জায়গা থেকে পুলিশ এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। গেল সরকার নির্বাচনকালীন আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞা থেকেই তাদের খারিজ করে দিয়েছিল। এবার আসন্ন নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু করার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশন 'গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ১৯৭২' সংশোধন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে আবারও অন্তর্ভুক্ত করার উদ্যোগ নিয়েছে।

ভোট দেওয়া ভুলে যাওয়া মানুষের বিশ্বাস, নির্বাচনে সশস্ত্র বাহিনী আইন প্রয়োগকারী সংস্থা হিসেবে দায়িত্ব পালনে সুফল আসবে। এই বিশ্বাস থেকেই ২০০১ সালে সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে আরপিও সংশোধন করে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগগুলো বা সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। কেবল জাতীয় সংসদ নির্বাচনেই নয়, পরবর্তী সময়ে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আইনগুলোতেও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞায় সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। কিন্তু ২০০৮ সালে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সরকার ঐ সংশোধনী অধ্যাদেশে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার সংজ্ঞা থেকে প্রতিরক্ষা কর্ম বিভাগগুলোকে বাদ দেয়। এবার সেখানে আশাবাদের খবর। মানুষ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারবে-এ আশা ও নিশ্চয়তা গণতন্ত্রকামী যে কারো জন্যই অত্যন্ত কাঙ্ক্ষিত। তাই নির্বাচন কমিশনের উদ্যোগটি প্রশংসনীয়। আন্তর্জাতিক মহলও আশা করে আমাদের আগামী নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে। ঢাকায় নির্বাচন ভবনে সাংবাদিকদের কাছে এই প্রত্যাশার কথা জানান ইইউ রাষ্ট্রদূত মাইকেল মিলার। সর্বশেষ অফিসার অ্যাড্রেসে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানও আগামী নির্বাচনে সেনা সদস্যদের আইন অনুযায়ী নিরপেক্ষভাবে দায়িত্ব পালনের জন্য প্রস্তুত হতে বলেছেন।

প্রশ্নমুক্ত, অবাধ নির্বাচনের দাবি বা আশা তখনই আসে, যখন নির্বাচনপ্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বা নাগরিক সমাজের মধ্যে উদ্বেগ থাকে। বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন কমিশন, নির্বাচনি ব্যবস্থা বা ভোটগ্রহণের পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলে, যা 'প্রশ্নহীন' নির্বাচনের দাবিকে আরো জোরালো করে। স্বাধীনতার ৫৩-৫৪ বছরে এ দেশে ভোটের বহু মডেল প্রদর্শন হয়েছে বাংলাদেশে। এখানে গণতন্ত্রের বহু মারপ্যাঁচ। একদলীয়, দ্বিদলীয়, কয়েক দলীয়, বহুদলীয় ইত্যাদি। ভোট আর নির্বাচনেরও এন্তার রকমফের! নামও অনেক। সুষ্ঠু নির্বাচন, নিরপেক্ষ নির্বাচন, অবাধ নির্বাচন, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। ভোটেরও নানা নাম-চিহ্ন। ভোট ক্যু, মিডিয়া ক্যু, বাক্স লুটের ভোট, হ্যাঁ-না ভোট। সূক্ষ্ম কারচুপি, স্কুল কারচুপিরও নানান কলসাইন। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন দেশের প্রথম নির্বাচনে একটি মডেল দেখেছে মানুষ। ব্যালট বাক্স লুট থেকে শুরু করে দলের প্রায় সব প্রার্থীকে জয়ী ঘোষণার নির্বাচনের ঐ মডেল ভোটের জন্য আজীবন সংগ্রামী বঙ্গবন্ধুর ইমেজে চরম আঘাত হানে। পছন্দের খন্দকার মোশতাককে জয়ী দেখাতে ব্যালট বাক্স কুমিল্লা থেকে ঢাকা এনে অধিকতর সঠিক ফলাফল দেওয়ার ঘটনা ব্যাপক আলোচিত-সমালোচিত। এরপর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে হ্যাঁ-না ভোট, আওয়ামী লীগকে নৌকা-মই ইত্যাদি চার ভাগে সিট বণ্টনসহ নানা মডেল শো। এ শোতে আরো নতুনত্ব আসে জেনারেল এরশাদ জমানায়।

নির্বাচনের এই সিরিজ মডেল শোতে প্রথম ব্যতিক্রম আসে এরশাদ পতনের পর '৯১-তে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে। স্বাধীন দেশে প্রথম স্বাধীন নির্বাচনের স্বাদ পায় মানুষ। এর মধ্যেই গন্ডগোল পাকে তখনকার বিএনপি সরকারের মাগুরা ও মীরপুর উপনির্বাচনি মডেলে। এরপর ১৫ ফেব্রুয়ারি মডেল। তারপর বিচারপতি হাবিবুর রহমান, লতিফুর রহমান, ফখরুদ্দিনদের তত্ত্বাবধায়ক জমানায় নির্বাচনের মোটামুটি একটি মডেল চলতে থাকে। এরপর শুরু হয় বাংলাদেশে নির্বাচনি নাশকতা। হতে হতে ২০১৮ সালে এসে দিনের ভোট রাতে সেরে ফেলার নতুন মডেল গড়ার অভিযোগ। চব্বিশে এসে ডামি-আমি। এর আগে, ২০১৪ সালে বিনা ভোটেই ১৫৪ জনকে জয়ী ঘোষণার রেকর্ড। যারা এখন মডেল নির্বাচনের ওয়াদা শোনাচ্ছেন, তারা এক বারও বলছেন না ১৪ বা ১৮ সালের মডেলটি ঠিক ছিল না। বরং ১৫৪ জনকে বিনা ভোটে পাশের পক্ষে জোরালো যুক্তি তাদের। ২০১৮ সালে রাতে ভোট হয়নি, রাতের ভোটের কোনো প্রমাণ নেই বলে দাবিও করছেন। এখন বলছেন, এগুলো ওপরের ইচ্ছায় হয়েছে। গেল প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আওয়াল গ্যারান্টি দিয়ে বলেছিলেন, এবার আর দিনের ভোট রাতে হতে দেওয়া হবে না। তার আগের জনের অঙ্গীকার ছিল ১৮ সালে ১৪ সালের মতো বিনা ভোটে ১৫৪ জনকে পাশ করতে দেবেন না তিনি। কথা রেখেছেন, বিনা ভোটে এমপি হওয়া কমিয়েছেন। কিন্তু ভোট রাতে এগিয়ে এনেছেন। চব্বিশে রাতের ভোট, বিনা ভোটের জায়গায় যোগ হয়েছে ডামি নির্বাচন।

এবারের প্রেক্ষাপট ও বাস্তবতা ভিন্ন। আগের সেই ভোটকাণ্ড অবসানের অপেক্ষা মানুষের। চলমান স্নায়ুযুদ্ধের এ সময়ে একতরফা কিছু করার সুযোগ এখন রুশ-উত্তর কোরিয়ার মতো কিছু দেশ ছাড়া আর কোনো দেশের নেই। সেই হিসেবে বাংলাদেশের সামনের নির্বাচন কেবল বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। নানা কারণে অনেকের চোখ বাংলাদেশের সামনের নির্বাচনের দিকে। বাংলাদেশ পাশের দেশ মিয়ানমার নয়। দক্ষিণ এশিয়ার মালদ্বীপ নয়। আফ্রিকার গৃহযুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ লাইবেরিয়াও নয়। তাই বিনা ভোটের চৌদ্দ নয়, রাতের ভোটের আঠারো নয়। চব্বিশের ডামি-আমি নয়। একটি প্রশ্নমুক্ত, প্রতিযোগিতাময়, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের দায়িত্ব কেবল ইসির ওপর দিয়ে বসে থাকার অবকাশ নেই। সব অংশীজনেরই সেখানে ভূমিকা রাখা আবশ্যক।

নির্বাচনের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে সাত-আটটি মানদণ্ড বেশ আলোচিত। দেশভেদে তা আপেক্ষিক। বিভিন্ন প্রটোকল, ঘোষণা, চুক্তি এবং নানা ধরনের আন্তর্জাতিক নিয়মনীতির আলোকে নির্বাচনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নির্ধারিত হয়। জাতিসংঘের সর্বজনীন মানবাধিকার ঘোষণায় বলা হয়েছে, নির্ধারিত সময় পরপর এবং প্রকৃত নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ হবে। ১৯৯৬ সালের ১২ জুলাই জাতিসংঘের কমিটি মানবাধিকার, ভোটাধিকার ও নির্বাচনসংক্রান্ত একটি ঘোষণা গ্রহণ করেছে।

নির্বাচনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড নির্ধারণের ক্ষেত্রে সেখানে ২৫টি বিষয় গ্রহণ করা হয়েছে। 'দ্য রাইট টু পার্টিসিপেট ইন পাবলিক অ্যাফেয়ার্স, ভোটিং রাইটস অ্যান্ড দ্য রাইট টু ইকুয়াল একসেস টু পাবলিক সার্ভিস'-শিরোনামের ঘোষণায় নির্বাচন ও ভোটাধিকার-সংক্রান্ত নানা বিষয় উল্লেখ করা আছে। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টারের প্রতিষ্ঠিত 'দ্য কার্টার সেন্টার' বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সুসংহত করায় ভূমিকা রাখে। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট-এনডিআইয়ের রিপোর্টে বলছে-এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, লাতিন আমেরিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন দেশের সরকার যৌথভাবে গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও নির্বাচনসংক্রান্ত নানা ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছে। সেখানে বলা আছে, ইনক্লুসিভ বা অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচনের কথা। এনডিআই ভোটার ও প্রার্থীদের অধিকার সুরক্ষাকে গুরুত্ব দেয়। প্রার্থীদের জড়ো হওয়া কিংবা শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকারও গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে দেখা হয় আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে। ১৯৯৪ সালের ২৬ মার্চ প্যারিসে অনুষ্ঠিত ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সর্বসম্মত ঘোষণায় বলা হয়েছে, প্রচারণার জন্য দেশ জুড়ে প্রার্থীরা যাতে নির্বিঘ্নে যেতে পারে, সেটি নিশ্চিত করা জরুরি। এরপর রয়েছে স্বাধীন পর্যবেক্ষণের কথা। নির্বাচনকে প্রশ্নমুক্ত করতে নাগরিকদের ভূমিকা রাখার সুযোগ দেওয়ার তাগিদ রয়েছে সেখানে। সেই সক্ষমতা, রসদ ও সাহস বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের আছে। সেসঙ্গে নির্বাচনকালীন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে সশস্ত্র বাহিনীকে ফিরিয়ে আনা প্রশ্নমুক্ত নির্বাচনের আশাবাদে মাত্রা দিয়েছে।

লেখক: সাংবাদিক-কলামিস্ট

সূত্র, ইত্তেফাক