স্বাধীনতার ৫৪ বছরেও আমরা কি একটি শতভাগ ‘বাংলাদেশপন্থি’ সরকার পেয়েছি? জনগণ বহুবার আশায় বুক বেঁধেছে, কিন্তু প্রতিবারই হতাশ হয়েছে। প্রতিটি সরকার মুখে দেশপ্রেমের বুলি উচ্চারণ করলেও বাস্তবে থেকেছে পরনির্ভর, সুযোগসন্ধানী আর আত্মকেন্দ্রিক। ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত ভারতের নিঃশর্ত সমর্থন নিয়ে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ সরকারের পতন এবং শেখ হাসিনাসহ তাঁর প্রভাবশালী মন্ত্রীদের দেশত্যাগ শুধু তাদের ব্যর্থতা নয়, বরং বাংলাদেশের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বের নগ্ন প্রকাশ।

২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থান মানুষকে নতুন আশার আলো দেখালেও অন্তর্বর্তী সরকারের নাজুকতা প্রমাণ করেছে– বাংলাদেশপন্থি হওয়া মুখের বুলি নয়, বাস্তবতা হতে হবে। বিদেশপন্থি রাজনীতির ছায়া এখনও দেশের মানুষ দেখতে পায়। তাহলে প্রশ্ন, বাংলাদেশপন্থি হওয়া আসলে কী?

বাংলাদেশপন্থি হওয়ার জন্য প্রথমে দেশের মৌলিক সম্পদ ও জনগণের অধিকারের প্রশ্নে দৃঢ় হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে অর্জিত স্বাধীন ভূখণ্ডের সঙ্গে সরাসরি জড়িয়ে আছে চারটি সম্পদ: মাটি, পানি, বায়ু ও মানুষ বা জনশক্তি। এগুলো আমাদের টিকে থাকার ভরসা এবং জনগণের সার্বভৌম অধিকার। অথচ সরকারগুলো ধারাবাহিকভাবে এই সম্পদের কার্যকর ও সুষ্ঠু ব্যবহার এবং রক্ষায় ব্যর্থ। এ ছাড়াও তারা ভূরাজনৈতিক বাস্তবতাকে জনস্বার্থে কাজে লাগাতে পারেনি, বরং বৈশ্বিক শক্তির কাছে দুর্বলতা হিসেবে প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে শ্রমবাজার ও প্রবাসী আয়ের বাস্তবতাকে যথাযথ গুরুত্ব দিতে পারেনি। ফলে শাসক দলগুলো বাংলাদেশপন্থি হওয়ার ক্ষেত্রে ধারাবাহিকভাবে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে। এর সুযোগ নিয়েছে বিভিন্ন রাষ্ট্র। স্বাধীনতার পর থেকেই বৈশ্বিক শক্তিগুলো বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার শুরু করে। আমাদের শাসকগোষ্ঠীর লোভ, অহংকার ও দুর্বলতাকে (ষড়রিপু) কাজে লাগিয়ে তারা নিজেদের স্বার্থ হাসিল করেছে। ফলে বাংলাদেশ কখনোই সম্পূর্ণরূপে জনগণের রাষ্ট্র হয়ে উঠতে পারেনি। একদিকে যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে রাশিয়া-চীন-ভারত, আবার উপসাগরীয় দেশগুলো নিজেদের মতো বাংলাদেশকে ব্যবহার করেছে। তিন দিকে ভারত একদিকে বঙ্গোপসাগর আমাদের কৌশলগত গুরুত্ব বাড়ালেও নেতৃত্ব সেটাকে কাজে লাগাতে পারেনি।

১৯৭৬ সাল থেকে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের শ্রমবাজারে জনশক্তি রপ্তানির মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তম্ভ হয়ে ওঠে প্রবাসী আয়। চব্বিশের গণআন্দোলনে আমরা প্রবাসী বাংলাদেশিদের শক্তির বহিঃপ্রকাশ দেখেছি। অন্তর্বর্তী সরকার যে পূর্ববর্তী সরকারের লুটপাটে বিধ্বস্ত হয়ে পড়া অর্থনীতির ধকল সামলে নিতে পেরেছে, সেখানেও ছিল প্রবাসী বাংলাদেশি। এই যে কোটির ওপর বাংলাদেশি প্রবাসী শ্রমের ঘাম ঝরিয়ে দেশের অর্থনীতিকে টিকিয়ে রাখছে, তাদের মর্যাদা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশি দূতাবাসগুলো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় সক্রিয় ভূমিকা পালন করেনি। সরকারগুলো প্রবাসী শ্রমিকদের মর্যাদা, নিরাপত্তা ও অধিকার রক্ষায় কার্যকর কোনো দীর্ঘমেয়াদি নীতিও গড়ে তুলতে পারেনি।

কেন আমাদের সরকারগুলো বাংলাদেশপন্থি হতে পারেনি, সেটা খুঁজে দেখা দরকার। এক কথায় আমরা হয়তো বলতে পারি, রাজনৈতিক দলগুলোর নেতৃত্ব জনগণের নয়, বরং নিজেদের ও পরিবারের স্বার্থ রক্ষার রাজনীতিতে ব্যস্ত থেকেছে। এ কারণেই তারা প্রকৃত অর্থে বাংলাদেশপন্থি হয়ে উঠতে পারেনি। এই সরল ভাবনার সঙ্গে আরও যে প্রশ্ন সামনে চলে আসে তা হলো, যারা বাংলাদেশপন্থি রাজনীতিক হয়ে উঠতে পারেনি, তারা কেন ক্ষমতায় যাচ্ছে বারবার? আমজনতার আকাঙ্ক্ষা পূরণে কাজ না করেও কী করে তারা ক্ষমতায় যায়? এই বাস্তবতা ভাবতে বাধ্য করে, কীভাবে বাংলাদেশপন্থি হওয়া সম্ভব?

প্রথমত, জনগণের অধিকারকে সর্বোচ্চ স্থান দিতে হবে মাটি, পানি, বায়ু ও জনশক্তিকে সম্পদে রূপান্তরের মাধ্যমে। দ্বিতীয়ত, বিদেশি প্রভাব প্রতিরোধ করে রাষ্ট্রনীতিকে জনস্বার্থে দাঁড় করাতে হবে। তৃতীয়ত, দায়িত্বশীল রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে তুলতে হবে, যারা সত্যিকার অর্থে জনগণের প্রতিনিধি। চতুর্থত, প্রবাসী আয়ের টেকসই ব্যবস্থাপনা এবং প্রবাসীদের মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। সবচেয়ে জরুরি হলো জাতীয় ঐক্য তৈরি করা, যে ঐক্য ১৯৭১-এ বিজয় এনে দিয়েছিল।

বাংলাদেশপন্থি হওয়া মানে কেবল ক্ষমতার চেয়ার দখল নয়। এটি এক কঠিন অঙ্গীকার জনগণের অধিকার রক্ষার সাহস, বিদেশি চাপে নত না হওয়ার দৃঢ়তা এবং দুর্নীতিবাজ অভিজাতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার স্পষ্টতা। যদি সেই বাংলাদেশপন্থি সরকার আমরা গড়তে পারি, তবে বাংলাদেশ শুধু টিকেই থাকবে না, বরং বিশ্বকে দেখাবে– একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্রও নিজের মর্যাদা ও স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারে।

মোহাম্মদ গোলাম নবী: কলাম লেখক; প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক, রাইট টার্ন

সূত্র, সমকাল