আবার উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। যদিও মাঝেমধ্যে অপহরণ, চাঁদাবাজি ও ছোটখাটো সংঘর্ষ অনেক দিন ধরে চলে আসছিল, কিন্তু অতিসম্প্রতি একটি মিথ্যা ধর্ষণের কাহিনি প্রচার করে যেভাবে দাঙ্গা সৃষ্টি করা হয়েছে এবং সন্ত্রাসীরা নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে, তাতে বিষয়টি হেলাফেলাভাবে দেখার অবস্থায় নেই। দেখে-শুনে মনে হচ্ছে, পাহাড়ে আরেকটি রক্তাক্ত সংঘাতের পটভূমি তৈরি করা হচ্ছে।
এখানে উল্লেখ করতে হয়, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যখন তথাকথিত শান্তি বাহিনীকে প্রায় পরাজিত করে ফেলেছে, যখন তারা আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন ১৯৯৭ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তথাকথিত একটি শান্তিচুক্তির নামে তাদের রক্ষা করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ইনসারজেন্সি (বিদ্রোহ) মোকাবিলায় বাংলাদেশ আর্মির ঐতিহাসিক একটি বিজয়কে থামিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আজ সেই চুক্তির ফলে সেই শান্তি বাহিনী ভিন্নরূপে ভিন্ন নামে আবার আবির্ভূত হয়েছে। সে সময় তাদের রাজনৈতিক সংগঠন পার্বত্য জনসংহতি পরিষদের সশস্ত্র সংগঠনের নাম ছিল শান্তি বাহিনী। এখন তারা আবির্ভূত হয়েছে জেএসএস (সন্তু লারমা), জেএসএস (সংস্কার), ইউপিডিএফ (প্রসীত), ইউপিডিএফ (ডেমোক্রেটিক), এমএনপি, কেএনএফ প্রভৃতি নামে।
সবচেয়ে মজার ঘটনা হচ্ছে, শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনীর নীতিনির্ধারকরা সেদেশের এলটিটি ইনসারজেন্সি সম্পূর্ণ পর্যদুস্ত করার জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ নিয়েছিল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর কাছ থেকে। আর এই শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে তারা সফলভাবে এলটিটি ইনসারজেন্সি দমন করতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ আর্মিকে সেই পর্যায়ে পৌঁছানোর আগেই তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তথাকথিত একটি শান্তিচুক্তির মাধ্যমে তা থামিয়ে দেন। তার অর্থ হচ্ছে, তিনি বিদ্রোহকে জিইয়ে রাখার সুযোগ করে দিয়েছিলেন, যার ফলে এখন সেই বিদ্রোহীরা শক্তি সঞ্চয় করে আবার সশস্ত্র সংঘাতে লিপ্ত হয়েছে।
একটি বিষয় সবার স্মরণ রাখা দরকার, এ ধরনের কোনো চুক্তি করার অর্থ এই নয় যে, ইনসারজেন্সি শেষ হয়ে গেল। কারণ বিভিন্ন দেশে এ ধরনের চুক্তির পরও কোনো না কোনো বিদ্রোহী গ্রুপ আপসহীন থেকে যায়, তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে থাকে। যেমন ফিলিপাইনের মিন্দানাওয়ের মুসলিম বিদ্রোহ এবং থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার সীমান্ত অঞ্চলের কমিউনিস্ট বিদ্রোহের কথা উল্লেখ করা যায়। উভয় দেশ বিদ্রোহীদের সঙ্গে সমঝোতায় পৌঁছালেও সশস্ত্র কিছু বিদ্রোহী অস্ত্র সমর্পণ করতে অস্বীকার করেছিল। মূলত ১৯৮০ সালে থাই সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করলে ১৯৮৩ সালে থাই কমিউনিস্ট পার্টি বিদ্রোহের সমাপ্তি টানে। কিন্তু থাইল্যান্ড সীমান্তে মাত্র ৮০ জনের মতো একটি গেরিলা দল যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার ঘোষণা করে। আর সেটা মোকাবিলা করার জন্য এক ব্রিগেড সৈন্য সেখানে মোতায়েন রাখতে হয়েছিল। একই ঘটনা ঘটেছিল ফিলিপাইনের মিন্দানাওয়ে। সেখানে নূর মিশরির নেতৃত্বে সবচেয়ে বড় গেরিলা গ্রুপটি সরকারের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করে মূল রাজনীতির ধারায় ফিরে এলেও আরো অনেকে আন্ডারগ্রাউন্ডে রয়ে গিয়েছিল। এখনো সেখানে সংঘাত রয়ে গেছে।
আর বাংলাদেশ সরকার চুক্তি করার সঙ্গে সঙ্গেই ধরে নিল পার্বত্য চট্টগ্রাম থেকে ইনসারজেন্সির চিরকালের জন্য সমাপ্তি ঘটে গেছে। তাই সরকার চুক্তি অনুযায়ী দ্রুততম সময়ে সব সামরিক ক্যাম্প গুটিয়ে নেয়। কখনো এটা ভেবে দেখা হয়নি যে, এই চুক্তির বাইরে আরো কোনো বিদ্রোহী গ্রুপ বিরাজ করছে কি না, কিংবা ভবিষ্যতে অন্য কোনো সংঘাতময় পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে তা কীভাবে মোকাবিলা করা হবে।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে উল্লেখ করতে হয়, ১৯৭৭ সাল থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র শান্তি বাহিনীর তৎপরতা শুরু হওয়ার পর থেকে তাদের মোকাবিলা করতে সেনাবাহিনী স্থায়ী ক্যাম্প বানাতে শুরু করে। ধীরে ধীরে তা এমন সব দুর্গম এলাকায় স্থাপন করা হয়েছিল, যেখানে সড়কপথে খাদ্য সরবরাহ করাও যেত না। প্রতি সপ্তাহে হেলিকপ্টারে করে রসদ পাঠানো হতো। সাংবাদিক হিসেবে এরকম কয়েকটি ক্যাম্পে যাওয়ার সুযোগ আমার হয়েছিল। এসব ক্যাম্পকে কেন্দ্র করে সেনাবাহিনী গড়ে তুলেছিল একটি চমৎকার গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক। এ কথা সবাই জানেন, এ ধরনের বিদ্রোহ মোকাবিলায় গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এই নিখুঁত গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সেনাবাহিনী একের পর এক সফল অভিযান করায় শান্তি বাহিনী প্রায় আত্মসমর্পণের জায়গায় পৌঁছে গিয়েছিল। আর তখনই ভবিষ্যতের কথা না ভেবে শেখ হাসিনা তথাকথিত শান্তিচুক্তিটি করে বসেন।
এর ফলে পরবর্তী সময়ে সেনা ক্যাম্পগুলো প্রত্যাহারের সঙ্গে সঙ্গে ভেঙে তছনছ হয়ে যায় বহুদিনের গড়ে ওঠা গোয়েন্দা নেটওয়ার্ক। যারা শান্তিচুক্তি মানেনি তাদের কাছে পার্বত্য চট্টগ্রাম হয়ে উঠে নিরাপদ অভয়ারণ্য। এখন তাদের কার্যক্রম শুধু অপহরণ ও লুটপাটের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, বরং তারা সরাসরি বাংলাদেশের নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হওয়ার সাহস দেখাচ্ছে।
মূলত ১৯৯৭ সালের শান্তিচুক্তিটি কেবল অদূরদর্শিতারই পরিচয় বহন করেনি, বরং বাংলাদেশের জন্য আরো বড় ধরনের নিরাপত্তার ঝুঁকি সৃষ্টি করেছে। এটা ছিল একটা দেশবিরোধী বিপর্যয়কর চুক্তি। কিন্তু সে সময় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী যদি শ্রীলঙ্কার মতো পরিপূর্ণভাবে শান্তি বাহিনীকে পরাজিত করে আত্মসমর্পণ করাতে পারত, তাহলে বর্তমানের মতো এতটা বিপজ্জনক অবস্থা তৈরি হতো না। বিশেষ করে সেনা ক্যাম্পগুলো যদি প্রত্যাহার না করা হতো।
এখানে শ্রীলঙ্কার কথা বারবার আনছি এ কারণেই যে, সেখানে সরকার কোনো ধরনের আপসরফা, সমঝোতা, কিংবা কোনো চুক্তির পথে হাঁটেনি। তারা সোজাসাপটা সামরিক শক্তি দিয়েই এলটিটি গেরিলাদের পরাজিত করেছে। অথচ উভয় দেশের বিদ্রোহীদের মদতদাতা একই দেশ।
অথচ অনেকেই জানেন, বাংলাদেশের ১০ ভাগের এক ভাগ জুড়ে পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলার অবস্থান। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি এই তিনটি জেলায় রয়েছে অফুরন্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। প্রতিনিয়ত পর্যটকদের আকৃষ্ট করে পাহাড়ের চূড়ার অদ্ভুত নীরবতা। শুধু তাই নয়, পূর্ব এশিয়ার দিকে যাওয়ার গেটওয়ে হিসেবেও এ অঞ্চলের গুরুত্ব অপরিসীম। সুতরাং কেবল পূর্ব এশিয়া নয়, মিয়ানমারের ভেতর দিয়ে চীনের সঙ্গে ভবিষ্যতে সড়ক যোগাযোগ স্থাপিত হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। আর সেটা হলে বাংলাদেশের অর্থনীতির এক নয়া দিগন্ত উন্মোচিত হবে, যুক্ত হবে পূর্ব এশিয়া ও চীনের বিশাল অর্থনীতির সঙ্গে।
এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের বার্মা অ্যাক্ট, সীমান্তে আরাকান আর্মির মতো নন-স্টেট সশস্ত্র গেরিলা গোষ্ঠীর তৎপরতা, সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ন্যাশনাল ইউনিটি গভর্নমেন্টের (এনইউজি) শক্ত অবস্থান, সেইসঙ্গে আরসা সশস্ত্র গ্রুপ ও রোহিঙ্গা শরণার্থী সমস্যা—অর্থাৎ, সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও অখণ্ডতার প্রতি এরই মধ্যে যে হুমকি সৃষ্টি হয়েছে, তা মোকাবিলা করার জন্য আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী কতখানি প্রস্তুত আছে, তা আমাদের জানা নেই। তার ওপর ইউপিডিএফের এই তৎপরতা আরো বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখা দিয়েছে।
বিশেষ করে ২০২২ সালে অনুমোদিত বার্মা অ্যাক্টের মূল লক্ষ্য হচ্ছে—মিয়ানমারে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা, গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলনকারী সংগঠনগুলোকে সহায়তা প্রদান ও বঙ্গোপসাগরে আধিপত্য বিস্তার করা। কিংবা এটাকে যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনীতির একটি মহাপরিকল্পনা হিসেবে অভিহিত করা যায়, যা নিঃসন্দেহে চীন ও ভারতের জন্য হুমকি তৈরি করবে। যেমন বার্মা অ্যাক্টে মিয়ানমারে বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠার কথা উল্লেখ রয়েছে। এমনকি সেখানে জান্তাবিরোধী এনইউজি সরকারকে সহায়তা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।
অ্যাক্টে দেশটির সামরিক সরকারকে অবৈধ কর্তৃপক্ষ হিসাবে অভিহিত করা হয়েছে। এমনকি যারা মিয়ানমার সরকারকে সহায়তা প্রদান করবে, তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলা হয়েছে। বিশেষ করে রাশিয়া ও চীন সাহায্য দিলে তাদের বিরুদ্ধেও যুক্তরাষ্ট্র পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। তাই রাজনৈতিক ও সামরিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বার্মা অ্যাক্ট কার্যকর করা শুরু হলে মিয়ানমার ও তার আশেপাশের অঞ্চলে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়বে। আর এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে বাংলাদেশকে ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য একটা কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে।
সুতরাং এ রকম একটি পটভূমিতে বাংলাদেশের পক্ষে এই বিশাল অঞ্চলটিকে নিরাপত্তাহীন রাখা কিংবা অবহেলা করার আর কোনো সুযোগ নেই। তাই বাংলাদেশের অর্থনীতি, নিজস্ব নিরাপত্তা ও ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে পার্বত্য চট্টগ্রামে আবার নিশ্ছিদ্র নিরাপত্তা বেষ্টনী গড়ে তোলা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। সেইসঙ্গে এই অঞ্চলে বসবাসকারী বাঙালি ও পাহাড়ি উভয়ের মধ্যে সম্প্রীতি বজায় রাখার সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া উভয় সম্প্রদায়ের জন্য হবে কল্যাণকর।