নোবেলজয়ী ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মালয়েশিয়া সফরের লক্ষ্য ছিল বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থানকে নতুন রূপ দেওয়া। বাংলাদেশকে বড় বড় চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে। এই সফরের লক্ষ্য ছিল পরিষ্কার। সরকারের লক্ষ্য হলো নতুন শক্তিশালী কৌশলগত মিত্র খুঁজে বের করা।

মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম উষ্ণ বার্তা দিয়েছেন। ঢাকার সঙ্গে সম্পর্ককে কুয়ালালামপুর কতটা গুরুত্ব দেয়, সেটা তিনি জানিয়েছেন। এই সফর দুইয়ের সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা বড় পদক্ষেপ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। অতীতে সম্পর্কের মনোযোগ ছিল বাণিজ্যের দিকে। বাংলাদেশ শ্রমিক পাঠাত। মালয়েশিয়া পাম তেল বিক্রি করত। এখন পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। মালয়েশিয়া সমান অংশীদারত্ব চায়। এর মধ্যে থাকবে নিরাপত্তা, উচ্চমূল্যের বাণিজ্য, উচ্চতর শিক্ষা ও প্রযুক্তি। এই সংবর্ধনা একটা বৃহত্তর বার্তা দিয়েছে। আসিয়ানের মধ্যে যে বাংলাদেশের ভূমিকা বাড়ছে, সেটা এখানে উঠে এসেছে। এশিয়া-প্রশান্ত অঞ্চলে বাংলাদেশের উপস্থিতিও সামনে আসছে।

এই সফর থেকে সত্যিকারের অর্জন হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে পাঁচটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। দুই দেশ তিনটি নোটও বিনিময় করেছে। এগুলোর মাধ্যমে দুই দেশের সম্পর্ক পুরোনো সীমা অতিক্রম করে যাবে।

একটি চুক্তি হলো প্রতিরক্ষা। এই চুক্তির অধীনে দুই দেশ যৌথ নৌ ও বিমান মহড়ায় অংশ নেবে। এর মধ্যে প্রযুক্তি হস্তান্তরের বিষয়টিও থাকবে। কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। সাগরে নজরদারির ক্ষেত্রে মালয়েশিয়ার অভিজ্ঞতা অনেক। মালাক্কা প্রণালিতে তারা জলদস্যুদের মোকাবিলা করে আসছে। এখান থেকে বাংলাদেশ শিখতে পারে। কারণ বাংলাদেশকে বঙ্গোপসাগরের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। এই এলাকা দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ জাহাজ পরিবহন রুট গেছে। এই এলাকার মধ্যেই বাংলাদেশের নীল অর্থনীতির প্রতিশ্রুতি লুকিয়ে আছে।

জ্বালানি সম্পর্কটাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। মালয়েশিয়ার কোম্পানি পেট্রোনাস এলএনজিতে এগিয়ে আছে। তারা উপকূলীয় জ্বালানি উন্নয়ন নিয়ে কাজ করে। বাংলাদেশের টার্মিনাল উন্নয়নে তারা সাহায্য করবে। এতে স্টোরেজ বাড়বে। তারা অফশোর বায়ু ও সৌর প্রকল্পের মতো নবায়নযোগ্য খাতে বিনিয়োগ করতে পারে। বাংলাদেশের এখন এই বিনিয়োগ প্রয়োজন। তাদের জ্বালানির দাম স্থিতিশীল হওয়া দরকার। অগ্নিগর্ভ বিশ্ববাজার এড়িয়ে এখন তাদের বিকল্প খোঁজা দরকার।

গবেষণাকেন্দ্রিক একটি সমঝোতা স্মারকের মাধ্যমে আইএসআইএস মালয়েশিয়া ও বিআইআইএসএস যুক্ত হয়েছে। এতে বাংলাদেশের রপ্তানি পণ্যের বিষয়টি আসিয়ানের যেকোনো আলোচনায় উচ্চারিত হবে। ঢাকা রাজনীতিকে রূপ দিতে পারবে। সংযোগ স্থাপন, ডিজিটাল বাণিজ্য, জলবায়ু পরিবর্তন এবং সমুদ্র আইনের মতো বিষয়গুলো সেখানে গুরুত্ব পাবে। বাংলাদেশের স্বার্থের জন্যও এগুলো দরকারি।

হালাল বাজারকেন্দ্রিক চুক্তি বড় দরজা খুলে দিয়েছে। ২০৩০ সাল নাগাদ বৈশ্বিক হালাল বাজারের আকার দাঁড়াবে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলার। মালয়েশিয়ার শীর্ষমানের স্বীকৃতিকে বাংলাদেশ সেখানে ব্যবহার করতে পারবে। এতে মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকার বাজারে রপ্তানি বাড়বে। খাবার, ওষুধ, কসমেটিক্স, ফ্যাশন ও পর্যটনের মতো পণ্য এর আওতায় পড়বে।

শিক্ষাও একটা গতি পাবে। উচ্চশিক্ষা ও কূটনীতিকদের প্রশিক্ষণের ব্যাপারে একটি চুক্তি হয়েছে। সেখানে যৌথ কর্মসূচি থাকবে। ফ্যাকাল্টি বিনিময়ের সুযোগ থাকবে। চুক্তির অধীনে কূটনীতিকদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এতে দক্ষ জনবল বাড়বে। বিশ্বে তারা বাংলাদেশকে আরো ভালোভাবে তুলে ধরতে পারবে।

দুটো চুক্তির মাধ্যমে বেসরকারি ব্যবসায়ীদের যুক্ত করা হয়েছে। এনসিসিআইএমের সঙ্গে এফবিসিসিআই এবং এমআইএমওএসের সঙ্গে বিএমসিসিআইকে যুক্ত করেছে এই দুই চুক্তি। এই চুক্তির অধীনে ব্যবসায়ের চ্যানেল উন্মুক্ত হবে। উচ্চপ্রযুক্তির উৎপাদন, চিপস, আইসিটি পার্ক ও কৃষিপ্রযুক্তির মতো খাতগুলো এখানে সুবিধা পাবে। বাংলাদেশের রপ্তানি খাত এতে আরো প্রসারিত হবে। গার্মেন্টের মধ্যে বাংলাদেশকে সীমিত থাকতে হবে না।

বিনিয়োগকারীদের আস্থা অর্জন

মালয়েশিয়ার পুঁজিপতিদের সঙ্গে ড. ইউনূস ব্যক্তিগতভাবে বৈঠক করেছেন। এই বৈঠক যেকোনো আনুষ্ঠানিক চুক্তির মতোই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সানওয়ে গ্রুপের জেফরি শেয়াহের সঙ্গে কথা বলেছেন। টেকসই শহর নিয়ে আলোচনা করেছেন তারা। যৌথ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা নিয়েও কথা হয়েছে। প্রোপার্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও ডিজিটাল যন্ত্রাংশের মতো খাতগুলোয় বিনিয়োগ করে থাকে সানওয়ে গ্রুপ।

ড. ইউনূস সাইয়েদ মোখতার আল বুখারির সঙ্গেও বৈঠক করেছেন। প্রোটন ও এমএমসি করপোরেশনের স্বত্বাধিকারী তিনি। তাদের আলোচনায় পরিবহন, কার অ্যাসেম্বলি ও বন্দর ইস্যুগুলো প্রাধান্য পেয়েছে।

বাংলাদেশকে একটা উদীয়মান অর্থনীতির দেশ হিসেবে তুলে ধরেছেন ড. ইউনূস। এই দেশের জনসংখ্যায় তরুণ বেশি। শিক্ষার মান এখানে বাড়ছে। মধ্যবিত্ত শ্রেণির বিকাশ হচ্ছে। সরকার সংস্কারের জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছে। মালয়েশিয়ার বিনিয়োগকারীদের কাছে এগুলো আবেদন তৈরি করেছে। তারা আসিয়ানের বাইরেও নতুন বাজার গড়ে তুলতে চায়।

আগ্রহী খাতগুলোর মধ্যে রয়েছে নবায়নযোগ্য, আর্থিক প্রযুক্তি, স্মার্ট খামার ও ইকো-ট্যুরিজমের মতো বিষয়গুলো গুরুত্ব পেয়েছে। মালয়েশিয়ার চাহিদার জন্য বাংলাদেশের নিম্নমূল্যের বাজার সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। উভয়ে মিলে তারা বিশ্বে প্রতিযোগিতা করতে পারবে।

শ্রমিক অভিবাসন : গুণগত মান বাড়ানো

শ্রম সম্পর্কটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মালয়েশিয়ায় প্রায় এক মিলিয়ন বাংলাদেশি কাজ করে। প্রতি বছর তারা বহু বিলিয়ন রেমিট্যান্স পাঠায়। কিন্তু সমস্যা এখনো রয়ে গেছে। অবৈধ নিয়োগকারীরা শ্রমিকদের অপব্যবহার করে। মধ্যস্বত্বভোগীরা প্রতারণা করে। যে কাজগুলো তারা করে, সেগুলো নিম্ন দক্ষতার কাজ। তাদের জন্য সুরক্ষা ব্যবস্থাটাও দুর্বল।

এই সফর মনোযোগ বদলে দিয়েছে। এখানে লক্ষ্য ছিল উন্নততর মানের অভিবাসন। উপদেষ্টা আসিফ নজরুল সরকার পর্যায়ে জনবল নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছেন। এর আওতায় প্রকৌশলী, ডাক্তার এবং আইটি পেশাদারদের মতো দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির কথা বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে আধা দক্ষ জনবল নেওয়ার বিষয়টিও যথারীতি থাকছে। এতে রেমিট্যান্সের মূল্য বেড়ে যাবে। এর মাধ্যমে শুধু শ্রমিক নয়, বরং মেধার উৎস হিসেবেও বাংলাদেশ গুরুত্ব পাবে।

সমস্যাগুলো নিয়ে সফরে আলোচনা হয়েছে। কাগজপত্রবিহীন শ্রমিকদের নিয়মিত করার বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। সামাজিক নিরাপত্তা জোরদারের বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়েছে। এই পদক্ষেপগুলো প্রবাসী জনগোষ্ঠীর অবস্থার উন্নতি করবে। তারা প্রতারণার হাত থেকে বাঁচবে। অভিবাসীদের অর্থনৈতিক ভূমিকাও এর মাধ্যমে আরো জোরদার হবে।

আঞ্চলিক শান্তি ও মানবিক কূটনীতি

মিয়ানমারে শান্তি মিশনের সঙ্গে বাংলাদেশও যুক্ত হয়েছে। অংশীদারদের মধ্যে আরো রয়েছে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও থাইল্যান্ড। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ নিজেকে ইতিবাচক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে।

এই মিশন থেকে অস্ত্রবিরতির চেষ্টা করা হচ্ছে। রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য তারা ত্রাণ পাঠানোর কথা বলেছে। কক্সবাজারে এই মুহূর্তে এক মিলিয়নেরও বেশি শরণার্থী অবস্থান করছে। এটাকে অন্যতম অগ্রাধিকার হিসেবে দেখা হচ্ছে।

মালয়েশিয়া এই মুহূর্তে আসিয়ানের নেতৃত্ব দিচ্ছে। ঢাকার জন্য তাই একটা সুযোগ রয়েছে এখন। সংকটকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরার একটা সুযোগ রয়েছে। চেষ্টা করা হচ্ছে যাতে সহায়তার বোঝা সবাই সমানকে ভাগাভাগি করতে পারে। মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে তারা চাপ দিচ্ছে।

রোহিঙ্গা ইস্যুর বাইরে গিয়েও একটা গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। শান্তি ও মানবিক কাজে বাংলাদেশের অর্জন বেড়েছে। বৈশ্বিক আরো কাজের জন্য বাংলাদেশ তার দরজা খুলে দিয়েছে।

চুক্তি থেকে বাস্তবতায়

সবচেয়ে বড় বিষয় হলো চুক্তিগুলো বাস্তবে রূপ দেওয়া, যৌথ টাস্ক ফোর্স গঠন করা। এই টাস্ক ফোর্স ত্রৈমাসিক প্রতিবেদন দেবে। হালাল পরিকল্পনার গতি বাড়াতে হবে। ২০২৭ সাল নাগাদ রপ্তানিতে নেতৃত্ব দিতে পারবে বাংলাদেশ। দক্ষ অভিবাসন প্রক্রিয়ার বাস্তবায়ন শুরু করতে হবে। এতে রেমিট্যান্সের পরিমাণ যেমন বাড়বে, তেমনি বাড়বে মর্যাদা।

বিআইআইএসএস-আইএসআইএস পর্যায়ে সম্পর্ক গভীর করতে হবে। নৌ নিরাপত্তা, ডিজিটাল নিয়মকানুন এবং জলবায়ুর মতো ইস্যুগুলোয় মনোযোগ দিতে হবে। এতে বাংলাদেশের আঞ্চলিক প্রভাব গড়ে উঠবে। বার্ষিক বিনিয়োগ ফোরাম আয়োজন করতে হবে। পাল্টাপাল্টি বিভিন্ন শহরে এই আয়োজন করতে হবে। ব্যবসার গতি ঠিক রাখতে হবে। আলোচনা যাতে চলমান থাকে, সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

সামাজিক ব্যবসায় নীতি ও কূটনীতি

ড. ইউনূসের যে স্টাইল, সেখানে তার জীবনের পুরো কাজের প্রতিফলন থাকে। তিনি টেকসই, অন্তর্ভুক্তি এবং উদ্ভাবনকে গুরুত্ব দেন। এখন কূটনীতিতেও তিনি সেটা প্রয়োগ করছেন।

ইউনিভার্সিটি কেবাংসান মালয়েশিয়াতে (ইউকেএম) তিনি একটা বক্তৃতা করেছেন। সেখানে সোশ্যাল বিজনেসে তাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট দেওয়া হয়। তিনি সেখানে বলেছেন, অর্থনীতি যেখানে বাড়ছে, সেখানে অবশ্যই অংশীদারত্বের লক্ষ্য হতে হবে সামাজিক চাহিদা পূরণ। মালয়েশিয়ার নীতির সঙ্গে এটা মিলে যায়। তারা শিল্পের সঙ্গে ইসলামিক ব্যাংকিং, হালাল নেতৃত্ব ও আসিয়ান তৎপরতাকে সমন্বিতভাবে এগিয়ে নিচ্ছে।

বার্তাটা খুবই পরিষ্কার। বাংলাদেশ এখন আর শুধু সস্তা শ্রমের উৎস নয়, বাংলাদেশ এখন বৈশ্বিক অর্থনীতিতে মূল্য সংযোজন করতে চায়।

এবারের সফর কোনো ফটোসেশনের সফর ছিল না। এই সফরে বাংলাদেশের উত্থানের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এর ধারাবাহিকতা রক্ষার মাধ্যমে বড় ধরনের অর্জন সম্ভব।

পাঁচ বছরের মধ্যে জ্বালানি নিরাপত্তা অর্জন করতে হবে। হালাল অর্থনীতিতে জোরেশোরে প্রবেশ করতে হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে বাণিজ্য দ্বিগুণ বাড়িয়ে ছয় বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যেতে হবে। দক্ষ জনশক্তি রপ্তানির দিকে যেতে হবে। মানবিক সহায়তা ও শান্তির পক্ষে কণ্ঠ তুলতে হবে।

ইতিহাস হয়তো ২০২৫ সালের আগস্ট মাসকে গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত হিসেবে দেখবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, নেতা ও ব্যবসায়ীদের ওপর এর সাফল্য নির্ভর করবে। তারা যদি সক্রিয় হন, তাহলে এই মিশন বাংলাদেশের আত্মবিশ্বাসী নতুন অধ্যায়ের সূচনা করতে পারে।

সূত্র, আমার দেশ