তরুণ প্রজন্ম বা জেনজির ক্ষমতা ও শক্তিকে অগ্রাহ্য করে কোনো সরকার যে এখন আর ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না, তা ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কা, ২০২৪ সালে বাংলাদেশ এবং ২০২৫ সালে এসে নেপালের সরকার পতনের ঘটনায় আবার প্রমাণিত হলো।
নেপালের আগে ইন্দোনেশিয়ায় গণবিক্ষোভের প্রবল ঢেউ থেকে সরকার অল্পের জন্য রক্ষা পেলেও সরকারের নৈতিক ভিত্তি নড়বড়ে হয়ে গেছে। সেখানে পার্লামেন্ট সদস্যরা তাদের মাসিক বাড়িভাড়া ভাতা ৩০০০ মার্কিন ডলারে উন্নীত করে বিল পাস করার পর ক্ষোভে ফেটে পড়েন সারা দেশের তরুণ প্রজন্ম ও সাধারণ মানুষ। ২০২৪ সালে বাংলাদেশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের অনুসরণে তারা সারা দেশকে অচল করে দেন। ব্যাপক সহিংসতার মুখে প্রেসিডেন্ট প্রভো সুবিয়ান্তো এই বিল বাতিল করলে পরিস্থিতি শান্ত হয়। অল্পের জন্য রক্ষা পায় সরকার।
শ্রীলঙ্কায় ২০২২ সালে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়। জ্বালানি ও খাদ্যসংকটে অচল হয়ে পড়ে দেশ। জনগণ রাস্তায় নেমে আসে। তারা ক্ষমতাসীন রাজাপাকসে পরিবারের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। জুলাইয়ের টানা আন্দোলনের মুখে প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। এমন ঘটনা প্রমাণ করে, দুর্নীতি, লুটপাট, স্বজনপ্রীতি ও দুঃশাসনের কারণে কোনো শাসক বা সরকার জনগণের আস্থা হারালে তাদের পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা কখনোই সম্ভব হয় না।
নেপালে তরুণ প্রজন্ম বা জেনজিদের মাত্র দুদিনের সহিংস আন্দোলনেই প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির সরকারের পতন ঘটেছে। আন্দোলন দমনে দমন-পীড়ন, হত্যাকাণ্ড ও কারফিউ জারিও বিক্ষোভকারীদের রাজপথ থেকে সরাতে পারেনি। ফলে বাধ্য হয়ে ক্ষমতা ছাড়তে হয়েছে অলিকে। তার পথ ধরে নেপালের প্রেসিডেন্ট রাম চন্দ্র পাওদেলও পদত্যাগ করেছেন বলে গত রাতে টাইমস অব ইন্ডিয়ার খবরে দাবি করা হলেও তা অস্বীকার করে প্রেসিডেন্টের দপ্তরের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, তিনি পদত্যাগ করেননি, নিজ দায়িত্ব পালন সঠিকভাবেই করছেন। প্রেসিডেন্ট বিক্ষোভকারীদের আলোচনায় বসারও আহ্বান জানিয়েছেন।
এই পরিস্থিতিতে দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে সেনাবাহিনী। সেনাপ্রধান জেনারেল অশোক রাজ সিগডেল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া এক ভিডিও বার্তায় বর্তমান সংকটের সমাধানে বিক্ষোভকারীদের আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, জাতীয় ঐক্য ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় সেনাবাহিনী প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
কিন্তু নেপালে হঠাৎ করে সরকারবিরোধী বিক্ষোভ এমন ব্যাপক আকার ধারণ করার কারণ কী? এর প্রাথমিক কারণ হিসেবে বিভিন্ন সরকারের আমল থেকে চলে আসা দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি বর্তমান সময়ে এসে ব্যাপক আকার ধারণ করেছে বলে বলা হচ্ছে। এর সঙ্গে আছে অর্থনৈতিক সংকট, বেকারত্ব ও সামাজিক বৈষম্য। রাজনীতিবিদদের পরিবার বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে; কিন্তু সাধারণ জনগণ দারিদ্র্যের কশাঘাতে জর্জরিত। ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওগুলো এই বৈষম্যকে নগ্নভাবে তুলে ধরেছে।
এছাড়া রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকায় কিছুদিন পরপরই সরকারের পতন ঘটছে, আবার নতুন সরকার ক্ষমতায় আসছে। জোটের রাজনীতির কারণে দেশটিতে রাজনীতিতে সবসময় অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। সরকারের বিরুদ্ধে ১৯৯০ ও ২০০৬ সালের গণআন্দোলনের পরও নেপালের রাজনীতিবিদদের চরিত্রে কোনো পরিবর্তন না আসায় চরম হতাশ দেশটির সাধারণ মানুষ। রাজনীতিবিদদের ওপর তাদের কোনো আস্থা নেই।
চলতি বছরই একাধিক চাঞ্চল্যকর কেলেঙ্কারির ঘটনা জনগণের সামনে আসে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদবিষয়ক মন্ত্রী ঘুস নেওয়ার অভিযোগে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। এছাড়া সাবেক একজন প্রধানমন্ত্রীও দুর্নীতির কারণে ফৌজদারি মামলায় জড়িয়েছেন। বিমানবন্দর নির্মাণকাজে দুর্নীতি, নেপাল টেলিকম প্রকল্পের অর্থ আত্মসাৎ, অভিবাসন দপ্তরে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন কেলেঙ্কারির ঘটনায় সরকার আগে থেকেই চাপের মুখে ছিল।
এছাড়া স্বর্ণ চোরাচালান ও শরণার্থী প্রত্যাবাসন খাতের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতাদের জড়িত থাকার তথ্য জনগণের সামনে আসে। কিন্তু এত দুর্নীতির পরও কোনো মন্ত্রী, এমপি বা বড় ধরনের নেতার তেমন কোনো শাস্তি হয়নি। তবে দলের নিম্নপর্যায়ের নেতাকর্মীরা তাদের এখন নতুন সরকার কীভাবে গঠিত হবে, কারা ক্ষমতায় আসবে, সেটি একটি বড় প্রশ্ন। ছোটখাটো অপরাধের জন্য শাস্তি পান। এসব কিছু মিলিয়েই পরিস্থিতি উত্তপ্তই ছিল। আর এসবের সঙ্গে সাম্প্রতিক একটি দুর্ঘটনা যুক্ত হয়ে পরিস্থিতিকে অগ্নিগর্ভ করে তোলে।
কোশি প্রদেশের অর্থমন্ত্রীর গাড়ির চালক রাস্তায় ১১ বছরের একটি মেয়েকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়ে দ্রুত পালিয়ে যান। কেউ একজন এ ঘটনার ভিডিও ধারণ করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দিলে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়। তারা ওই গাড়িচালকের গ্রেপ্তার দাবি বলেন। কোশি প্রদেশের অর্থমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির দলের একজন নেতা। চাপের মুখে সরকার ওই গাড়িচালককে গ্রেপ্তার করলেও ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তার জামিন হয়ে যায়। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শুরু হয় ব্যাপক সমালোচনা।
দিনের আলোতেই এই দুর্ঘটনা ঘটেছিল। বিক্ষোভরত জেনজিরা এই ভিডিও ফুটেজকে ব্যাপকভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শেয়ার করে। এটি নেপালের সাধারণ মানুষকেও ক্ষুব্ধ করে তোলে। তারা কে পি শর্মা অলির সরকার ও দলকে দায়িত্বজ্ঞানহীন লোকদের একটি গ্রুপ আখ্যায়িত করে।
কিন্তু কে পি শর্মা অলির সরকার মিথ্যা তথ্য ও ঘৃণা ছড়ানোর অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে সারা দেশে ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও মেসেজিং অ্যাপ নিষিদ্ধ করে। অবশ্য এর আগে বিভিন্ন কোম্পানিকে দেশের আইন মেনে নিবন্ধন করার জন্য এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছিল। টিকটক, ভাইভারসহ পাঁচটি অ্যাপ নিবন্ধন করায় এগুলো ছাড়া ফেসবুক, এক্স, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, লিংকডইনসহ অন্যসব অ্যাপ বন্ধ করে দেয় সরকার।
সমালোচকদের মতে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধের মাধ্যমে জনগণের মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে বাধাগ্রস্ত করেছে সরকার, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মূলত অনলাইনে নজরদারি বাড়ানোর জন্যই সরকার এটি করেছে। তারা আরোও অভিযোগ করেন, নেপাল বিশ্বের অন্যতম সেরা পর্যটনকেন্দ্র। দেশের অর্থনীতিও পর্যটনের আয়ের ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল। দেশে যারা পর্যটনশিল্পের সঙ্গে জড়িত, তাদের ব্যবসা পরিচালনার জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অপরিহার্য। অন্যদিকে গ্রামাঞ্চল ও প্রবাসী নেপালিদের যোগাযোগের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
সংগত কারণেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করার সরকারের সিদ্ধান্ত তরুণদের ক্ষুব্ধ করে তোলে। তাদের আন্দোলনের মুখে সোমবার রাতেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে সরকার। কিন্তু সেদিন থেকেই সরকারের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আন্দোলনে নেমে পড়ে তরুণ প্রজন্ম। তারা পুরোনো ধাঁচের রাজনীতি ও রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্নীতিবাজ নেতাদের হাত থেকে মুক্তি চায়। বিশেষ করে দেশের প্রধান তিনটি দল কমিউনিস্ট পার্টি অব নেপাল (সিপিএন) ইউএমএল, নেপালি কংগ্রেস ও সিপিএনের (মাওবাদী) ওপর জেনজিদের ক্ষোভ সবচেয়ে বেশি। এসব দলের পরিবর্তে তারা দেশে নতুন ধারা রাজনীতি চায়।
কিন্তু এখন নতুন সরকার কীভাবে গঠিত হবে, কারা ক্ষমতায় আসবে, তা নিয়ে এখনো কোনো আলোচনা শুরু হয়নি। ধারণা করা হচ্ছে, ছোট দলগুলো জোট গঠন করে নতুন সরকার আসতে পারে। অন্যদিকে, চারবারের প্রধানমন্ত্রী ও কমিউনিস্ট পার্টির নেতা কে পি শর্মা অলি ক্ষমতা ছাড়ার পর দেশেই আছেন, নাকি বিদেশে চলে গেছেন, সে সম্পর্কে এখনো কিছু জানা যায়নি। এই পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী সারা দেশে কারফিউর সময়সীমা আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত বাড়িয়েছে।
নেপালের বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন ভারত। নরেন্দ্র মোদির সরকার নেপাল পরিস্থিতির ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছে। দেশটির অনেক বিশ্লেষক বলছেন, ভারত যেন কোনোভাবেই বাংলাদেশের ভুল নেপালে না করে। ভারতকে অবশ্যই নেপালের ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখতে হবে।
ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে ভাষান্তর : মোতালেব জামালী